1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘সাদা কালা’র হাওয়ায় ভাসমান সময় ও হাশিম মাহমুদের ‘দুঃসময়’

ওয়ালিউল বিশ্বাস
২৮ জুলাই ২০২২

ছবির নাম ‘হাওয়া’। যার সুবাসের বাতাস ছড়াচ্ছে একটি গান- ‘সাদা সাদা কালা কালা'। ‘হাওয়া’র প্রচারণার মূল অনুষঙ্গও এখন এই গান।

https://p.dw.com/p/4EkyF
হাশিম মাহমুদ
হাশিম মাহমুদছবি: Waliul Biswas

মূলত এই গানটির কারণে ‘হাওয়া' মুক্তির আগেই তুমুল আলোচনায় চলে এসেছে। বলা যায়, ‘সাদা সাদা কালা কালা' প্রচারণার পাল হয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আগামী ২৯ জুলাই মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমাটিকে৷

দেশের চলচ্চিত্রে গানের তুমুল শ্রোতাপ্রিয় হওয়া নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে এর আগে বহু গানই চলচ্চিত্রের পরিচয় হয়ে উঠেছে। ‘ও রে নীল দরিয়া', ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন', ‘নীল আকাশের নীচে আমি', ‘ভালোবাসার মূল্য কত', ‘সব সখিরে পার করিতে নেবো আনা আনা', ‘আসেন আমার মোক্তার', ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই, মানুষ যদি মোরে নাই বলো, বেঈমান বলো', ‘বারো দিনের শিশুর সনে গো'-র মতো গানগুলো সেই ভূমিকাই পালন করেছিল। তবে সেসবের সঙ্গে ‘সাদা সাদা কালা কালা'-র মূল পার্থক্য হলো, এটা ছবি মুক্তির আগেই সবার মুখে মুখে ফিরছে। এ গানটি দিয়েই চলচ্চিত্র ‘হাওয়া'কে চিনছেন অনেকে৷

কিন্তু এই গানটি যার সৃষ্টি, তাকে কি সবাই চেনেন? হ্যাঁ, হাশিম মাহমুদ। ‍এ গানটির রচয়িতা, সুরকার ও মূল গায়কওতিনি। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ছিল তার বিস্তৃত বিচরণ। কখনো গান, কখনো কবিতা কিংবা আঁকাআঁকি করতেন। সেখানেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি ‘সাদা সাদা কালা কালা' গানটি তৈরি। ২০১০ সালের আড্ডা অনুষ্ঠানে এটি গেয়েছেন হাশিম মাহমুদ। এ শিল্পী বিগত কয়েক বছর ধরে চারুকলায় অনিয়মিত হলেও নিয়মিতই তার গানটি সেখানে শোনা যায়।

হাশিম মাহমুদ বর্তমানে মা জমিলা আক্তারের সঙ্গে থাকেন নারায়ণগঞ্জে, নিজের বাড়িতে। পঞ্চাশোর্ধ এ শিল্পীকে দেখাশোনা করেন তার ছোট ভাই বেলাল আহমেদ৷

হাশিম মাহমুদের বাড়িতে এখন অনেকের আসা-যাওয়া। সবাই তাকে দেখতে যান, কথা বলেন, শোনেন গানও। দেশব্যাপী গানের প্রশংসা এবং নিজের এ খ্যাতিটা উপভোগও করছেন হাশিম মাহমুদ৷

মানুষের প্রতি মানুষের স্নেহ, দয়া- ভালো লাগে:হাশিম মাহমুদ

২৬ জুলাই বিকেলে গিয়ে দেখা গেল বিছানায় বসে কবিতার বই পড়ছেন। পাশের ঘরে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষায় আছেন বেশ কয়েকজন। হাশিম মাহমুদ বললেন, ‘‘খুবই ভালো লাগছে আমার। মানুষের প্রতি মানুষের স্নেহ, দয়া- ভালো লাগে। সাহিত্যের জন্য একটু অবসর লাগে, দরকার। এটা আমি এখন পাচ্ছি না। একটু বসে যে পুরনো দিনের কাব্য-কথা করবো, সে অবসর আমি পাচ্ছি না৷''

তবে বেশিক্ষণ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না এই শিল্পী। প্রসঙ্গের মধ্যে হঠাৎ করেই ভিড় করে নানা কল্পনা। কথার মোড় ঘোরে সেদিকে। ‘সাদা সাদা কালা কালা' গানটি নিয়ে বলার চেষ্টা করলেও খুব বেশি সময় সে প্রসঙ্গে থাকতে পারেননি। জানান, গানটির কালো পাখি একটি আত্মিক বিষয়। আবার তিনি উল্লেখ করেন, কোনো এক মানবীকে নিয়ে গানটি বেঁধেছেন। স্মৃতির চৌকাঠ পেরিয়ে বেশিদূর আর যেতে পারেন না তিনি৷

এই শিল্পীর বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জেই। স্থানীয় সংগঠন ‘শাপলা'র মাধ্যমে হাশিম মাহমুদ ও তার ভাই-বোনদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদার্পণ। তখন থেকেই গান, ছড়া ও ছোট গল্প লিখতেন তিনি। আঁকাআঁকিতে ‘প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান' না থাকলেও নিজের ছড়ার পাশে এর দৃশ্যপট পেন্সিলে ফুটিয়ে তুলতেন। অল্প বয়সেই দৈনিক দিনকাল নামের পত্রিকায় তার লেখা ছোট গল্প ‘বিলুর এই সব দিনরাত্রি' ছাপা হয়৷

Bangladesch Band Boiragi
বৈরাগী ব্যান্ডের একটি স্মরণীয় মুহূর্তছবি: Private

হাশিম মাহমুদের বোন দিলারা মাসুম ময়না বলেন, ‘‘নারায়ণগঞ্জেই নিয়মিত সাংস্কৃতিককাজে যুক্ত থাকতেন হাশিম মাহমুদ। নব্বইয়ের দশকে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকামুখী হলেন তিনি। তখন তার দিনলিপিটা এলোমেলো হয়ে গেল। হয়ত সকালে ঢাকা যেতেন, আসতে আসতে সন্ধ্যা, রাত। তখন থেকেই তার স্বপ্ন দেখা শুরু। তখনও তিনি কিন্তু খুবই প্রাণোচ্ছ্বল ছিলেন। অনেক কিছু দেখতেন, আমাদের এসে তা বলতেন। গান গেয়ে টাকা আয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু প্রয়োজন পড়লে আমাদের কাছ থেকে নিতেন। আমরা মজা করে বলতাম, ‘তুমি তো অনেক বড় স্টার হয়ে যাচ্ছো। কিন্তু তোমাকে কেউ টাকা দেয় না?' তিনি হাসতেন। বলতেন, আমি অনেক বড় স্টার হয়ে যাবো। তোমরা চিন্তাই করতে পারবা না, বাসায় এত লোক আসবে! আমরা সেসময়টাতে অনেক গান-গল্প করতাম। এখন আফসোস হয়, সেই গানগুলো আমরা সংগ্রহ করিনি বলে। হাশিম মাহমুদ তাৎক্ষণিক লিখতে পারতেন। আড্ডার মধ্যে ভাইবোনদের নিয়ে দুষ্টুমি করেও গান বাঁধতেন৷''

সাত ভাই-বোনের মধ্যে হাশিম মাহমুদ পঞ্চম। অন্যরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে বিএ অনার্স পাশের পর বাবা মো. আবুল হাসেম তাকে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু সেখানে থিতু হতে পারেননি। ফিরে আসেন নিজের পরিচিত সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। গানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও আছে তার। ছায়ানট থেকে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর পড়াশোনা করেন। তবে সেখানেও অস্থিরতা ভর করে। তৃতীয় বর্ষে আর নিয়মিত হতে পারেননি। সেখানেই বছর খানেক শিখেছেন নজরুল ও শাস্ত্রীয় সংগীত। বিএ অনার্স পড়ার সময়ই ১৯৯১ সালের একুশের বইমেলায় ছড়ার বই প্রকাশ করেন। বইয়ের নাম ‘ধপাস'। বইয়ে ছড়ার পাশে আঁকা ছবিগুলোও তার৷

Bangladesch Der Musiker und Komponist Hashim Mahmud und seine Schwester Delara Masum Moyna
বোনের সঙ্গে হাশিম মাহমুদছবি: Waliul Biswas

সেই সময়ই, ৯১-৯২' সালের দিকে হাশিম মাহমুদ ও তার বন্ধুরা মিলে তৈরি করেন গানের দল ‘বৈরাগী'। টিএসসিতে নিয়মিত গান করতেন তারা। ঢাকার বাইরেও কনসার্ট করেছেন। নরসিংদী শহর, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলার বকুলতলা, কলাভবনের মল চত্বর ও মতিঝিলের এজিবি কলোনিসহ বেশকিছু স্থানে হাশিমসহ দলটির সদস্যরা পরিবেশনায় অংশ নেন৷

দলটির অন্যতম সংগঠক ছিলেন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম শেখ চঞ্চল। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। হাশিম মাহমুদের পরিবারের মতে, দলটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তিনিই৷

‘বৈরাগী' দলের এই সদস্য বলেন, ‘‘আমি গাই গাইতে পারতাম না। সংগঠক হিসেবে যুক্ত ছিলাম। চারুকলার ছাত্র ছিলাম। হাশিমসহ অনেকেই সেই সময় ডিপার্টমেন্টে আসতো। তার গানের মাধ্যমেই তার সঙ্গে পরিচয়। এক সময় মনে হলো, আমরা তো দল তৈরি করতে পারি! ৯১-৯২ সালেই হয় আমাদের কার্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে ‘বৈরাগী' আত্মপ্রকাশ করে। সব গান নিজেদের ছিল না। অঙ্কুরে তো! চার-পাঁচটা গান নিজেদের ছিল। অন্য গানও হাশিম করতো। ফোক গানটা বেশি গাইতো। ২০২১ সালে হাশিমের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়। তখন আমি ফেসবুকে দিয়েছিলাম তার গাওয়া গান ‘ফুল ফুটেছে গন্ধে সারা মন'। খুবই রেসপন্স পেয়েছিলাম৷''

আমি হাশিম ভাইকে খুঁজে বের করি:আরফান মৃধা শিবলু

অধ্যাপক চঞ্চলের মতোই নব্বইয়ের দশক ও পরবর্তী সময়ে চারুকলার শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে ফিরেছে হাশিমের ‘সাদা সাদা কালা কালা' গান। সেই সূত্রেই ‘হাওয়া' ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন হাশিম মাহমুদের গান প্রসঙ্গে জানতেন। তার অনুরোধেই সিনেমাতে এটি গেয়েছেন, অভিনয়ও করেছেন আরফান মৃধা শিবলু। ১৯৯৮ সালে হাশিম মাহমুদের সঙ্গে শিবলুর পরিচয়। তখনই তিনি গানটি শিল্পীর মুখে শুনেছিলেন৷

‘‘পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন ভাই বলেছিলেন, সিনেমাতে আমাকে দিয়ে একটি গান গাওয়াবেন। কিন্তু কোন গান- তা তিনি বলেননি। তিনি হঠাৎ বললেন, ‘হাশিম ভাইয়ের এই গানটা রেডি করো, এটা তাকে দিয়েই গাওয়াবো।' শুনে তো আমি প্রচণ্ড খুশি যে, উনার দরাজ গলা আবার শুনতে পাবো। এরপর আমি হাশিম ভাইকে খুঁজে বের করি। তাকে বলে ঢাকার বেশ কিছু স্টুডিওতে নিয়ে যাই। কিন্তু তিনি শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ ছিলেন, যার ফলে ঠিকমতো ডেলিভারি দিতে পারছিলেন না। অনেকবার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। এরপর সুমন ভাই বললেন, ‘শিবলু, তুমি যেহেতু হাশিম ভাইয়ের সঙ্গে মিশেছো, গানটি তুমিই গাও।' এভাবেই গানের সঙ্গে আমার যুক্ত হওয়া। শুরু থেকেই জানতাম, এটি জনপ্রিয়তা পাবে। কিন্তু সারা দেশব্যাপী মানুষের মুখে মুখে এভাবে ফিরবে- তা ভাবিনি''- বললেন আরফান মৃধা শিবলু৷

 শিল্পীকে সারাটা জীবন আগলে রেখেছেন তার ছোট ভাই বেলাল আহমেদ৷
শিল্পীকে সারাটা জীবন আগলে রেখেছেন তার ছোট ভাই বেলাল আহমেদ৷ ছবি: Waliul Biswas

‘সাদা সাদা সাদা কালা' গানটি নিয়ে এখন নানাভাবে বিশ্লেষণও হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন চলচ্চিত্র  ও লোকগানের গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়জী। তার ভাষ্য হলো, ‘‘গানটির ছন্দ বেশ ভালো। মানুষ ভিন্নতা পছন্দ করে। হাশিম মাহমুদের গানের মধ্যে সে বিষয়টি আছে। আমার ধারণা, এ কারণেই এটি শ্রোতামহলে প্রশংসিত হচ্ছে। তার জন্য শুভ কামনা থাকলো৷’'

তবে এত প্রশংসা, এত ভিউ- সবকিছুর বাইরে পরিবারের সদস্যরা চাইছেন হাশিম মাহমুদের সুস্থতা। এ শিল্পীকে সারাটা জীবন আগলে রেখেছেন তার ছোট ভাই বেলাল আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তিনি বেশ অসুস্থ। হঠাৎ করেই তিনি সব ভুলে যান আবার কিছুক্ষণ পর মনে পড়ে। আগে কোনো প্রসঙ্গে ১ ঘণ্টা মনোযোগ রাখতে পারতেন। এখন সেটা পারেন না। দু-তিন মিনিট পর তিনি জায়গায় থাকতে পারছেন না। ওখান থেকে সরে যাচ্ছেন। আমি আমার ভাইয়ের শুধু সুস্থতা চাই। এখন হাশিম মাহমুদকে অনেক মানুষ দেখছেন, ভিউ হচ্ছে। দিনশেষে হাশিম মাহমুদের তাতে কী আসে যাচ্ছে? প্রাপ্তিটা যদি এমন হয়, আমার ভাই দৃপ্ত পায়ে হাঁটছেন, আবার গান গাইছেন, আবার চারুকলায় যাচ্ছেন, শিল্প-সত্তা বিকশিত করতে পারছেন- আমি সেটাই চাই। টাকা-পয়সা নয়, আমরা একটি পথ দেখতে চাই, যা ধরে এগুলে ভাই আমার সুস্থ হবেন৷''