ডেনিমে সাফল্য, চ্যালেঞ্জও অনেক
৯ মে ২০১৮ডেনিম রপ্তানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে শীর্ষস্থান দখল করেছে বাংলাদেশ৷ চীনকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশের এই শীর্ষ অবস্থান দেশের ডেমিন প্রস্তুতকারকদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে৷ এখানে ভূমিকা রেখেছে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মপরিবেশের উন্নয়ন৷
ইউরোপের বাজারে এখন যত ডেনিম রপ্তানি হয়, তার শতকরা ২৭ ভাগ যায় বাংলাদেশ থেকে৷ আগে চীন এই বাজারে শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ তাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ডেনিমে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়৷ মোট রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ শতকরা ১৪ দশমিক ২ ভাগ৷ বাংলাদেশের আগে রয়েছে চীন এবং মেক্সিকো৷
ইউরোপিয় কমিশনের পরিসংখ্যান ডিরেক্টরেট ইউরোস্ট্যাট-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ইউরোর ডেনিম জিনস রপ্তানি করেছে৷ এরপর ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ইউরো৷ এছাড়া রপ্তানি বেড়েছে ০ দশমিক ৫৮ ভাগ৷ তবে বাংলদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কেরর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি, ৪ দশমিক ৩৬ ভাগ৷
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ডেনিম রপ্তানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৫ ভাগ৷ ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৪৬৩ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ডেনিম রপ্তানি হয়েছে৷ ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০৭ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলারে৷ চীন ২০১৭ সালে ৯২১ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলারের ডেনিম যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করলেও, রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৪১ ভাগ৷ মেক্সিকোরও একই অবস্থা৷ তাদের রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৯ ভাগ৷ অর্থাৎ মোট রপ্তানি করেছে ৭৯৩ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলারের ডেনিম৷
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম৷ তাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে শতকরা ১৩ ভাগ এবং ৭ দশমিক ৯ ভাগ৷ তারা ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যথাক্রমে ২১৩ দশমিক ৭ এবং ২০৭ দশমিক ২৮ মিলিয়ন ডলারের ডেনিম রপ্তানি করেছে৷
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কারকদের সংগঠন বিজিএমই-এর সভাপতি সিদ্দিুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ডেনিমের ভালো ‘ফেব্রিক' তৈরি হয়৷ আধুনিক কারখানা এবং ভালো ওয়াশিং প্ল্যান্ট থাকায় ডেনিমে আমরা ভালো করছি৷''
বাংলাদেশে এখন ৩১টি বড় ডেনিম ফ্যাক্টরি আছে৷ বাংলাদেশ থেকে ব্লু ডেনিম ট্রাউজার্স, স্কার্ট, জ্যাকেট, স্যুট-কোট, প্লে স্যুট রপ্তানি হয়৷ আমাদের ক্রেতারা হলো: এইচঅ্যান্ডএম, ইউনিকলো, টেস্কো, লেভিস, ডিসেল, ওয়াংলার, জি-স্টার, এস অলিভার, হুগো বস ও গ্যাপ৷
এনভয় টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম মুর্শেদি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ডেনিমে সফলতার প্রধান কারণ উদ্যোক্তাদের সাহস৷ কারণ ছোট আকারের একটি ডেনিম ফ্যাক্টরি করতেও ৫০০-১০০০ কোটি টাকা লাগে৷ এর সঙ্গে সরকারের পলিসি সাপোর্ট কাজ করেছে৷ বাংলাদেশে ডেনিম ফেব্রিক্স-এর কাঁচামাল আছে৷ আমরাই ভালো কাপড় তৈরি করায় কম সময়ে এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে জিন্স দিতে পারি৷ আমাদের কারখানাগুলো অত্যাধুনিক এবং ওয়াশিং-এর ক্ষেত্রেও আমরা ভালো করছি৷''
তিনি বলেন, ‘‘ডেমিন শুধু কাপড় নয়, এটা একটা ফ্যাশান৷ ওয়াশিং-এর মাধ্যম এই ফ্যাশানকে তুলে ধরা হয়৷ তাছাড়া এর ক্রেতা সবাই৷ বারাক ওবামাও পরেন, আবার আমাদের দেশের একজন লোডারও পরেন৷ সাংবাদিকও পরেন, আমিও পরি৷ এর কোনো সিজন নেই, কারণ ১২ মাসই সিজন৷ এ সব দিক খেয়াল রেখে আমরা সময়মত চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছি বলে ডেনিমের চাহিদা বাড়ছে এবং আরো বাড়বে৷''
কেন আরো বাড়বে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কম সময়ে ক্রেতাকে ডেনিম সরবরাহ করতে পারি৷ ‘লিড টাইম' একটা বড় ব্যাপার৷ আমাদের নিজেদের কাপড় দিয়েই আমরা কাজ করি৷ এর সঙ্গে আমাদের ‘টেকনিকাল নো হাউ' অনেক বেড়েছে৷ ওয়াশিং-এ আমরা এগিয়ে রয়েছি৷ সব মিলিয়ে ডেনিমে আমাদের সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল৷''
তিনি অবশ্য সামনে চ্যালেঞ্জের কথাও বলেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের প্রতিযোগিতায় অনেক চ্যালেঞ্জ আছে৷ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু সমন্বয় করছে৷ যেমন জ্বালানি তেলের দাম ভারত ও শ্রীলঙ্কা নিয়মিত সমন্বয় করে৷ অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও আমাদের দেশে উলটে বাড়ে৷ ডলারের বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও আমরা সমন্বয় না করায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি৷''
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘এখন বিদ্যুতের সমস্যা নেই৷ তবে পলিসিসহ অন্য সমস্যা আছে৷ ভিয়েতনাম টিটিপি ফ্যাক্টরির কথা বলে কিছুটা এগিয়ে গেছে৷ ডেনিমের এই সাফল্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে৷''
মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান টেকনিভোর মতে, বিশ্বে ডেনিমের বাজার ৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের৷ ২০২০ সাল নাগাদ এই শিল্পের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ ভাগ৷ এশিয়া-প্রশন্তমহাসাগরীয় অঞ্চল ডেনিমের সবেচয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বাজার৷ বাংলাদেশের জন্য এই বাজারে বড় সুযোগ অপেক্ষা করছে৷ সেই সুযোগ কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার জন্যই বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডেনিম এক্সপো৷
ডেনিম এক্সপোর প্রবর্তক এবং সিইও মোস্তাফিজ উদ্দিন মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশকে ডিজাইন উন্নয়ন এবং নতুনত্বের মাধ্যমে ডেনিমে অবস্থান সংহত করতে হবে৷ এই খাতে এখন আরো বিনিয়োগ এবং গবেষণা বাড়াতে হবে ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে মাথায় রেখে৷''
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এখন ভ্যালু অ্যাডিশনের দিকে যেতে হবে৷ আমরা এখন একটি জিন্স প্যান্টবিক্রি করি ৫ থেকে ৬ ডলারে৷ আর দোকানে বিক্রি হয় ১০ থেকে ১৯ ডলারে৷ আমাদের এই কোয়ানটিটির পরিবর্তে এখন সাসটেইনিবিলিটির দিকে যেতে হবে৷ কারণ এখন প্রশ্ন উঠছে, একটি জিন্স তৈরিতে কতটুকু পানি ব্যবহার করা হয়৷ সেটা পরিবেশ বান্ধব কিনা৷ কেমন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে? ‘ওয়ার্কিং এনভায়রনমেন্ট' কেমন? আমাদের এখন ১৯ ডলার থেকে ২৯ ডলারের উৎপাদনে যেতে হবে৷''
কীভাবে ‘ভ্যালু অ্যাডিশন' সম্ভব? তাছাড়া প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতা কেন অতিরিক্ত দাম দেবে? এ সব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ইনোভেশন, ডিজাইন, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইননিবিলিটি – এই চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিলে আমরা ভ্যালু অ্যাডিশন করতে পারব৷ পানির ব্যববহার কমাতে হবে৷ কেমিকালের ব্যবহার কমাতে হবে৷ নতুনত্ব আনতে হবে৷ নতুন নতুন ডিজাইনের দিকে নজর দিতে হবে৷''
দেশে বর্তমানে ৩১টি ডেনিম কারখানায় ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা৷ কারখানাগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা সব মিলিয়ে প্রায় ৪৩ কোটি ৫০ লাখ গজ৷ ডেনিম ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউরোরেপ ৭১ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ ভাগ, চিন ৫৮ ভাগ এবং জাপানে ৫৮ ভাগ মানুষ নিয়মিত ডেনিম পণ্য ব্যবহার করেন৷
জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফ্রেব্রিক্স-এর অনল রায়হান মনে মনে করেন, ‘‘এখানকার পানি, ইন্ডিগো কালার এবং প্রতিজোগিতামূলক দাম ডেনিমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশের পানি এবং আবহাওয়া ডেনিমের জন্য ভালো৷ তবে ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়া এক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে৷ তাই আমাদের অবস্থান ধরে রেখে এগিয়ে যেতে সরকারের কিছু ‘পলিসি সাপোর্ট' লাগবে৷ এখন যারা নন ডেনিম ফেব্রিকে আছেন, তারাও ডেনিমের মার্কেটটা বুঝতে চাইছেন৷ ফলে এবার ডেনিম এক্সপোতে অনেকেই আগ্রহী হয়েছেন৷