ছাত্র-ছাত্রীদের চুলের স্টাইল নিয়ে কঠোর জাপান
১৩ জুন ২০২২জাপানের বিদ্যালয়ে ছাত্রদের চুলের ছাঁট, স্টাইল, রং নিয়ে কঠোর নিয়ম রয়েছে৷আদালতে ওঠা একটি মামলা এবং সংবাদপত্রের সমালোচনামূলক নিবন্ধে সম্প্রতি এ কথা উঠে এসেছে৷
দক্ষিণ জাপানের ২০ বছর বয়সি এক ব্যক্তি বলেন যে, তিনি কুমামোতো শহরের সেসেইকো হাইস্কুলে ছাত্র থাকাকালীন যে সমস্যায় পড়েছিলেন তা আদালতে জানিয়েছেন৷
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি আদালতকে বলেন যে তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ ২০১৭ সালে স্কুলের স্পোর্টস ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন৷ ‘ঐতিহ্য' মেনে তাকে মাথা ন্যাড়া করতে বাধ্য করা হয়৷ তিনি স্কুল ছেড়ে দেন৷
মাইনিচি সংবাদপত্র রিপোর্ট করেছে যে, একজন শিক্ষক ১৬ বছরের এক ছাত্রীর চুল টেনে ধরে তাকে বকাঝকা করেছেন৷ কোবের একটি উচ্চবিদ্যালয়ে সমস্ত পড়ুয়াদের জন্য যে নিয়ম রয়েছে, সেটি অনুযায়ী ওই ছাত্রীর চুলের রং কালো ছিল না৷
সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে ওই ছাত্রী জানিয়েছিল, পুলের রাসায়নিকের ফলে তার চুলগুলি কিছুটা গাঢ় বাদামি হয়ে গিয়েছিল৷ ওই ক্লাবে সে নিয়মিত সাঁতার কাটতে যায়৷ স্কুল কর্তৃপক্ষ আগে তাকে নিশ্চিত করেছিল যে তার চুলের রংয়ের নিয়ম তার ক্ষেত্রে অনুসরণের প্রয়োজন নেই৷
কিন্তু তারপরেও শিক্ষকের ওই আচরণের ফলে উদ্বেগজনিত রোগে ভুগছে ওই ছাত্রী ৷ দুই সপ্তাহ স্কুলে যেতে পারেনি সে৷
শিক্ষার্থীদের জন্য কঠোর নিয়ম
জাপানের স্কুলগুলি দীর্ঘদিন ধরে পোশাক এবং চেহারাসংক্রান্ত কঠোর নিয়মের জন্য কুখ্যাত৷ এমনকি ছাত্রদের অন্তর্বাসের রং নিয়েও নিয়ম ছিল৷
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই বিধি নিয়ে নানা কথা ওঠায় অনেক স্কুল ধীরে ধীরে কিছু নিয়ম শিথিল করেছে৷ তবে অনেক নিয়ম রয়ে গিয়েছে এবং সমালোচকরা বলছেন যে তারা অন্য যুগের ‘হ্যাংওভার' নিয়ে বসে আছে৷
‘‘আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের বেশিরভাগ পড়ুয়াই চুলে রং করে,'' এমনটাই বলেন সাপোরোর হোক্কাইডো বুনকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের অধ্যাপক মাকোতো ওয়াতানাবে৷ তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে এই ধরনের কঠোর নিয়ম মেনে চলার পর সচেতনভাবেই বিষয়টিকে অবমাননা করে তারা৷''
তার কথায়, ‘‘সমাজ পাল্টে গিয়েছে৷ কিন্তু বিদ্যালয়গুলি এখনও অত্যন্ত রক্ষণশীল৷এটি সত্যি উন্মাদের মতো আচরণ৷ প্রত্যেকেরই সোজা, কালো চুল থাকতে হবে এই কথা কর্তৃপক্ষই বলছে৷ একই সময়ে সরকার বিশ্বায়নের আহ্বান জানাচ্ছে৷এদিকে, জাপানে এখন আরো বেশি বিদেশি নাগরিকরা বাস করেন৷''
ওয়াতানাবে বলেন, পরস্পরবিরোধী, প্রাচীন বিধি নিয়ে ক্রমাগত কাভারেজের কারণে স্কুলগুলি অপ্রয়োজনীয় নিয়মগুলিকে সহজ করতে শুরু করেছে৷
উদাহরণস্বরূপ, একটি স্কুল পড়ুয়াদের চুলে রং করতে নিষেধ করেছিল কিন্তু তারপর স্বাভাবিকভাবে গাঢ় বাদামি চুলের একজন ছাত্রকে চুলে কালো রং করার নির্দেশ দিয়েছিল৷
কী নিয়ম রয়েছে?
ওয়াতানাবে বলেন তিনি এতটা নিশ্চিত নয় যে কঠোর নিয়মগুলি দ্রুত পাল্টে যাবে৷ তার মতে, ‘‘জাপানের স্কুলগুলির সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক খুব কম৷ স্বাভাবিক নিয়মেই একটা রক্ষণশীল প্রবণতা রয়েছে তাদের৷ তাই তাদের পক্ষে সবকিছু মেনে নেওয়া সম্ভব নয়৷ তারা জানে না বিশ্বে পরিবর্তন হচ্ছে৷''
এমি ইজাওয়া টোকিওর একটি বিশ্ববিদ্যালয়েপ্রথম বর্ষের পড়ুয়া৷ তার লম্বা চুলের প্রান্তে রুপোলি-ধূসর রং করেছেন তিনি৷ এই মুহূর্তে এটি তরুণ জাপানিদের মধ্যে ফ্যাশন বলা যেতে পারে৷
এমি বলেন, ‘‘উচ্চ বিদ্যালয়ের নিয়মগুলি কঠোর হওয়ার বিষয়ে সত্যিই ভাবিনি কারণ প্রত্যেককে এমনটা মেনে চলতে হতো৷ আমি মেয়েদের স্কুলে পড়তাম৷ আমাদের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম ছিল৷ কানের দুল বা কোনো ধরনের গয়না বা মেকআপ পরতে দেওয়া হয়নি৷''
তার কথায়, ‘‘কেউ নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি৷ স্কুলে পোশাক নিয়ে নিয়ম ভাঙার জন্য কাউকে কিছু বলা হয়েছিল কি না খেয়াল নেই৷ এখন আরো স্বাধীনতা পেয়েছি, আমি খুবই খুশি৷ তবে আমার জন্য, সেই সময়ে নিয়ম মেনে চলা খুব একটা বড় সমস্যা ছিল না কিন্তু আমি এটাও বুঝি যে তরুণ প্রজন্ম স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী৷''
জাপানের শিক্ষক সংগঠনগুলিও স্কুলে পোশাক এবং চুলের স্টাইল নিয়ে নিয়মের অতিরিক্ত বিধিনিষেধের সমালোচনা করেছে৷
ন্যাশনাল টিচার্স ফেডারেশনের একজন মুখপাত্র তামাকি তেরাজাওয়া ডিডাব্লিউ-কে বলেন, তারা পুরনো আমলে পড়ে রয়েছে৷
সামরিক প্রভাব
তেরাজাওয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘বর্তমানে জাপানে যে শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তা মেইজি যুগে শুরু হয়েছিল৷ সেটি সামরিক অনুশাসন মেনে হতো, তাই পোশাকে অভিন্নতা, বাচ্চারা স্কুলে নিয়ে যাওয়া ব্যাগ এবং তাদের চুলের স্টাইল এবং রং পর্যন্ত এক ছিল৷
তেরাজাওয়া জানান, সেই সময়ে, সরকার বলেছিল যে জাতির উন্নয়নের জন্য সমাজে অভিন্নতা প্রয়োজন, কিন্তু এটি ১০০ বছরেরও বেশি আগের নিয়ম এবং জাপান তার থেকে এখন অনেক আলাদা৷ তবে কিছু নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে এবং শিশুদেরকে নিজের মতো হতে দেওয়া হয়েছে৷ বিশেষ করে বিদেশ থেকে আসা শিশুদের ক্ষেত্রে বা যাদের বাবা-মা বিদেশি, কিন্তু জাপানে বসতি স্থাপন করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে নিয়ম বদল হয়েছে৷
তার মতে, ‘‘রক্ষণশীল স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ক্রমাগত প্রতিরোধ দেখতে পাচ্ছি এবং এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলবে বলে মনে হয়৷তবে নতুন প্রজন্মের তরুণ শিক্ষকরা এখন স্কুলে প্রবেশ করছে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে৷আমরা আশা করি তারা স্কুলের পরিবেশে একটু বেশি স্বস্তি দিতে পারবে৷ স্কুল আরো একটু উন্মুক্ত হবে৷''
জুলিয়ান রাইয়াল/আরকেসি