1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সাকিবের ইচ্ছের সর্বনাশা সুর

নোমান মোহাম্মদ
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে টেস্ট সিরিজের ধবলধোলাই এবং পরপরই সাকিবের টেস্ট ছাপিয়ে আইপিএল বেছে নেয়ার জোড়া ঘটনায় পঞ্জিকার এই বসন্তের শুরুতে বাংলাদেশের ক্রিকেট-ডালে মধুস্বরে কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে না কিছুতেই৷

https://p.dw.com/p/3pdRo
Bangladesch | Cricket | Shakib Al Hasan
ছবি: Getty Images/AFP

বরং কাকের কর্কশ সর্বনাশা স্বরটাই প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে ক্রমশ৷

কী প্রবল আকুতি নিয়ে মহাদেব সাহা লিখেছিলেন, ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও/ মিথ্যা করে হলেও বলো, ভালোবাসি’!

সাকিব আল হাসান একটি চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে৷ করুণার মোড়কে কর্কশ অক্ষরে৷ বিষয়, বাংলাদেশের জার্সিতে এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলতে চান না৷ বরং তখন নিজের সময় সমর্পন করবেন আইপিএলে৷ টেস্ট ক্রিকেটকে মিথ্যা করে ভালোবাসার ‘অভিনয়’ না করে তার ওই সরাসরি চাওয়া৷ বিসিবির সাধ্যে কুলোয়নি নিজেদের সর্বকালের সেরার আবদারকে অস্বীকার করার!

টেস্ট ক্রিকেটটা সাকিব খেলতে চান না৷ অনেক দিন ধরেই খেলতে চান না৷ সে চাওয়ার হাওয়া তীব্রতা পায় বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তার ক্রমবর্ধমান চাহিদায়৷ সাকিবের ভাবনা চাঁচাছোলা; সুস্পষ্ট সরলরৈখিক৷ পাঁচ দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে না হয় আভিজাত্য আছে, কিন্তু গ্ল্যামার কই! ইতিহাসে চিরস্থায়ী হওয়ার হাতছানি আছে, কিন্তু অর্থের ঝনঝনানি কই! পরিসংখ্যানে হলেও '৮০-র দশকের সব্যসাচী চতুষ্টয় ইমরান-বোথাম-কপিল-হ্যাডলিকে ছাড়িয়ে যাবার লোভ আছে, কিন্তু তাতে লাভ কই! তার চেয়ে ভালো, টেস্টকে অগ্রাধিকার তালিকায় পেছনে নিয়ে যাওয়া৷ মনোজগতে প্রচ্ছন্নে থাকা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বরং আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া!

সাকিবের টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দেবার ইচ্ছের কথা বাংলাদেশ ক্রিকেটে ওপেন সিক্রেট৷ সবাই জানেন৷ সঙ্গে আবার মানেন, এ নিয়ে কথা না বাড়ানোই শ্রেয়৷ তাতে যত দিন এই অলরাউন্ডারের সার্ভিস পাওয়া যায় আর কী! সাকিব অবশ্য মাঝেমধ্যেই বিগড়ে ওঠেন৷ ক্রিকেটকর্তাদের কাছে নিজের অবস্থান জানান৷ কখনো অসন্তুষ্টির বাঁশির ফুয়ে, কখনো অবাধ্য সাইরেনে৷ ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে যেমন টেস্ট ক্রিকেট থেকে ৬ মাসের নির্বাসন চেয়েছিলেন৷ বোর্ড মধ্যপন্থা বেছে নিয়ে ওই সফরের দুই টেস্ট থেকে ছুটি দেন সাকিবকে৷

এবারের ছুটিটাও আপাতত দুই টেস্টের জন্যই৷ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এপ্রিলের যে সিরিজের সূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা৷ সাড়ে তিন বছর আগে সাকিবের ছুটি প্রার্থনায় ততটা সোরগোল পড়েনি৷ কারণ, জাতীয় দলের কর্তব্য ফেলে তখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে নাম লেখানোর ব্যাপার ছিল না৷ এবার সেই সংঘর্ষটা হয়ে গেল৷ আর ভবিষ্যতেও যে তা হতে থাকবে, হতেই থাকবে, সেটি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন এক বিসিবি পরিচালক, ‘‘ছুটিটা এখন আপাতত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের জন্য৷ কিন্তু ও জানিয়েছে, বাংলাদেশের সব টেস্ট সিরিজে খেলতে পারবে না৷ ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি খেলবে নিয়মিত, বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটগুলোতেও খেলার অনুমোদন দিতে হবে৷ এরপর শরীরে কুলালে কিছু কিছু টেস্ট খেলবে৷’’ বলে নিজেদের অসহায়ত্বও লুকোন না বোর্ড-প্রতিনিধি, ‘‘এখানে আমাদের কী করার ছিল, বলুন! ওকে ছুটি না দিয়ে টেস্ট খেলতে বাধ্য করলে প্রথমত শতভাগ দিয়ে হয়তো খেলতো না, দ্বিতীয়ত টেস্ট থেকে অবসরের ঘোষণাও দিয়ে দিতে পারতো৷ তখন তো সবাই উল্টো আমাদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো৷’’

জালাল আহমেদ চৌধুরী

ক্রিকেট কোচ ও বিশ্লেষক জালাল আহমেদ চৌধুরী অবশ্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন সবাইকে৷ সাকিবকে; বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে; দেশের ক্রিকেটপাগল জনগণকেও, ‘‘সাদা চোখে সাকিবের এটি অন্যায় আবদার৷ যা আমরা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছি৷ ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ না করেও সাকিবকে দেশের হয়ে খেলার জন্য অনুপ্রাণিত করার মতো সামর্থ্য হয়তো ক্রিকেট বোর্ডের নেই৷ মানুষ তো অনেক সময় দেশের জন্য হাসতে হাসতে নিজের প্রাণও দিয়ে দেন৷ এটি আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি; আরো অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি৷ সাকিবের ব্যাপারটায় কোনো কার্যকারণ নিশ্চয়ই আছে, যে কারণে তা মানতে বোর্ড রাজি হয়েছে৷ এটি যদি মিরাজ বলতো, আমার মনে হয় বোর্ড সভাপতি ওকে দুটো থাপ্পড় দিতেন৷ কিন্তু যেহেতু সাকিব, সে কারণে বোর্ড মেনে নিয়েছে৷ এবং আমরা যারা দেশবাসী, তারাও এর বিরুদ্ধে তেমনভাবে সোচ্চার হচ্ছি না৷ কারণ, সাকিব৷ গ্রাম্য একটি কথা আছে, দুধ দেয়া গাইয়ের লাথিও ভালো৷ সাকিবের ব্যাপারটি তেমনই৷’’

সাকিবের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান করেও তার অমন সিদ্ধান্ত যে পছন্দ হয়নি, তা জানাতে অপকট জালাল আহমেদ চৌধুরী, ‘‘এখানে (বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলে) খেলে সে যা পাবে আর না খেলে যা পাবে, সেটির ব্যক্তিগত হিসাব সাকিবের আছে৷ হিসাবটা আমরা করলে তো হবে না৷ সে ওই হিসাব করে দেখছে, ওখানে (আইপিএলে) বেশি লাভবান হবে৷ মানুষ তো লাভের পেছনেই ঘোরে৷ সেই লাভের লোভ এক্ষেত্রে দেশপ্রেমকেও অতিক্রম করেছে৷ এটি আমার বোধ৷ কিন্তু এ বোধ সাকিবের না থাকলে কিছু করার নেই৷ তার তো ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে৷’’

সাকিবের আবদার বোর্ডের হজম করার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবও শ্লেষাত্মকভাবে দেখেন জালাল আহমেদ চৌধুরী, ‘‘সাকিবের এই ব্যাপারের প্রভাব বলতে দেখি, সাধনা করলে বা প্রতিভা থাকলে পুরনো যে কথাটি আছে ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়' এই ব্যাপারগুলোও উল্টে দেয়া যায়৷ কর্তৃত্বে যারা আছেন, তাদের উপরও কর্তৃত্ব করা যায়৷ কাউকে না কাউকে তা ক্ষমতা অর্জন কিংবা প্রতিভা বিকাশের উচ্চতম স্তর হিসেবে নেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে৷’’

ক্রিকেট দুনিয়ায় বর্তমান বাস্তবতায় তা অনেক দেশের ক্রিকেটারই করে দেখিয়েছেন৷ ক্যারিবিয়ান সমুদ্র সন্তানরা সবচেয়ে বড় উদাহরণ৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের কোনো কর্তৃত্ব নেই তাদের উপর৷ বরং গেইল-পোলার্ড-নারিনদের ইচ্ছেদাস যেন বোর্ড৷ নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেটে চালু করলেন হয়তো সে ধারা৷ সেটি প্রথায় পরিবর্তিত হয়ে যাবে যদি তার পরের সারির কিংবা পরের প্রজন্মের ক্রিকেটাররা ব্যাট-বলের অর্জনে সাকিবের স্তরে পৌঁছতে পারেন৷

তাতে হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বিত্ত বাড়বে, ব্যক্তিস্বাধীনতার কেতাবি প্রশয়ে অর্থের ঝংকার উঠবে৷ কিন্তু ব্যক্তি ছাপিয়ে দেশের ক্রিকেটের লাভ হবে কতটা? এদেশের ক্রিকেটে আসবে কি বসন্ত?

উত্তর সময়ের হাতে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান