1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সংকটে পর্যটন সেক্টর, বন্ধ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান

সমীর কুমার দে ঢাকা
৫ জুন ২০২১

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান পর্যটন খাত এখন এক গভীর সংকটে। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে একের পর এক ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

https://p.dw.com/p/3uSt3
Bangladesch Strand von Patenga
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, চট্টগ্রাম।ছবি: Mortuza Rashed/DW

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (এটাব)-এর হিসেবে করোনা মহামারিতে হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে৷ সংগঠনটির আরো দাবি, এ সময়ে পুরোপুরি বেকায় হয়েছে এক লাখের বেশি মানুষ৷ সরকারের তরফ থেকে এই সেক্টরকে বাঁচাতে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ তাদের৷

অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (এটাব) সভাপতি মনসুর কালাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই সেক্টরকে বাঁচাতে আমরা সরকারের কাছে নানা ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম৷ কিন্তু আমাদের কোনো প্রস্তাবই রাখা হয়নি৷  আমাদের সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে৷ আমরা প্রাথমিক যে হিসাব করেছি, তাতে আমাদের ১২ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে৷ বেকার হয়েছে লাখেরও বেশি প্রত্যক্ষ কর্মী৷ পরোক্ষভাবে কাজ হারিয়েছেন আরো বহু মানুষ৷’’

শুধু কক্সবাজারেই ট্যুরিজমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৩০ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন বলে জানালেন কক্সবাজার ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস ফেডারেশনের মহাসচিব আবুল কাশেম সিকদার৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সরকারের কাছে মালিকদের জন্য কিছু চাইনি, শুধু বলেছি, এখানে যারা কাজ করে এরা এক-একজন শিল্পী৷ শিল্পী না বাঁচলে শিল্প বাঁচবে না৷ ফলে চাকরিচ্যুত এই কর্মীদের সরকারের সামাজিক সুরক্ষা তহবিলের আওতায় প্রণোদনার কথা বলেছি৷ সুবিধা না পেলে একজন মালিকও না খেয়ে মারা যাবে না৷ কিন্তু এই শিল্পীগুলো একদিনে তৈরি হয় না৷ বছরের পর বছর তাদের প্রশিক্ষন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে৷ কীভাবে ট্যুরিস্টদের সঙ্গে মিশতে হয়, কথা বলতে হয়, এগুলো তাদের শেখানো হয়েছে৷ এখন তারা চাকরি হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন৷ তাই যখন করোনা থাকবে না, তখন এই শিল্পীদের আমরা কোথায় পাবো? কক্সবাজারে ৪০০টির মতো হোটেল-গেস্ট হাউস আছে৷ সেগুলোতে এখন সিকিউটি গার্ড ছাড়া কারো চাকরি নেই৷’’

মহামারি চলে গেলে হয়ত আবারও ঘুরে দাঁড়াবে পর্যটন৷ কিন্তু গত ৩০ বছরে এই সেক্টরে যে দক্ষ কর্মী তৈরি হয়েছিল, তাদের হয়ত আর পাওয়া যাবে না৷ ফলে নতুন করে দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে আরো ১৫ বছর লাগবে৷ বলছিলেন ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)-এর সভাপতি রাফিউজ্জামান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বছর ৫ লাখের বেশি বিদেশী ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে আসেন৷ আমাদের কর্মীরা তাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করা থেকে শুরু করে ঘুরিয়ে দেখানো এবং সর্বশেষ বিদায় দেওয়া পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন৷ ওই ট্যুর গাইড যেভাবে উপস্থাপন করেন, সেভাবেই বিদেশিরা বাংলাদেশকে চেনে৷ ফলে এরা এক-একজন বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর৷ এই লোকগুলো চলে গেলে এই সেক্টর বাঁচবে না৷ আমরা যে গবেষণা করেছি, তাতে আমাদের ক্ষতি ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা৷’’

‘১২ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে’

প্রতি বছর অন্তত তিনবার পরিবার নিয়ে বিদেশে ঘুরতে যান ঢাকার ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের স্বত্ত্বাধিকারী রাশেদুল করিম মুন্না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অস্টেলিয়ায় ছিলাম৷ এরপর আর বিদেশে ঘুরতে যাইনি৷ আমি দুই ঈদে ও বছরের শেষে মোট তিনবার পরিবারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে বিদেশে ঘুরতে যাই৷’’ করোনাকালে পরিবারের সঙ্গে কীভাবে সময় কাটিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘কোভিড শুরু হওয়ার পর খুব সাহস নিয়ে দুই বার দেশের মধ্যেই ঘুরতে গেছি৷ সেখানে গিয়ে আমি দেখেছি, দেশেই বিদেশি মানের ভালো গেস্ট হাউজ আছে৷ তাদের মানও অনেক ভালো৷ দেশে দু'টি ট্যুর করার পর আমার মনে হয়েছে, এদিকে নজর দেওয়া গেলে দেশের ভেতরেই টুরিজমটাকে অনেক দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব৷ ভালো মানের রিসোর্ট পেলে দেশের মধ্যেই তো ঘুরতে যেতে পারি৷’’

ট্যুরিজম বন্ধ হওয়ায় দেশের বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে৷ পল্টনের আল্টিমেট ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অফিস ভাড়া দিয়ে আর চালাতে পারছিলাম না৷ ফলে কর্মীদের বিদায় দিয়ে সবকিছু বাসায় নিয়ে এসেছি৷ মার্কেটে বেশ কিছু বকেয়া রয়েছে৷ এখন সেগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করছি৷’‘ বাংলামটরের লেক্সাস ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অজিত কুমার সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনার প্রথম দফায় আমি কাউকে বাদ দেইনি৷ কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় কিছু কর্মীকে বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছি৷ কোনোভাবে এখন টিকে থাকার চেষ্টা করি৷ আশায় দিন গুনছি, কখন সুদিন ফিরবে৷ আমরা চাইলে হয়ত সরকারের কাছ থেকে কম সুদে কিছু ঋণ নিতে পারতাম৷ কিন্তু টাকা নিয়ে কী করবো? এই টাকা কোথায় খাটাবো? ফলে আমরা প্রণোদনার টাকা পাওয়ার চেষ্টাই করিনি৷’’

এদিকে, দেশের পর্যটন শিল্পকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে নতুন আইন করতে যাচ্ছে সরকার৷ গত ৩ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বিল উপস্থাপন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী৷ বিলটির ব্যাপারে আপত্তি জানান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, বেসরকারি ট্যুর অপারেটররা দেশের পর্যটন কার্যক্রমকে একটি জায়গায় নিয়ে এসেছে৷ তাদের কার্যক্রম ব্যহত করতে এ আইনটি করা হচ্ছে৷ পরে বিলটি যাচাই-বাছাই করে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়৷

করোনার মহামারি বাংলাদেশের কুয়াকাটা সৈকতেও ধাক্কা দিয়েছে৷ কুয়াকাটার ‘হোটেল কুয়াকাটা ইন'-এর মালিক মো. সোহেল বলেন, ‘‘করোনা শুরুর পর সবকিছুই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ মাঝে মাস দুই-তিনেকের জন্য কিছুটা চালু হলেও এখন আবার সব বন্ধ হয়ে গেছে৷ আমরা বাধ্য হয়েই সব কর্মীকে বিদায় করে দিয়েছি৷ টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ৷’‘ তবে এই করোনা সেন্টমার্টিনে খুব একটা ধাক্কা দেয়নি বলে জানালেন সেন্টমান্টিন হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সেন্টমার্টিনে মূলত প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৬ মাস ট্যুরিস্টরা আসে৷ গত বছর মার্চ পর্যন্ত আমরা চালাতে পেরেছি৷ তারপর নভেম্বর কিন্তু চালু হয়েছিল৷ এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত চালানো যায়নি৷ কিন্তু মার্চ পর্যন্ত চলেছে৷ ফলে এখানে খুব একটা ধাক্কা লাগেনি৷ এখানে যারা কাজ করেন, তারা সবাই বাইরে থেকে আসা মানুষ৷ তবে এখানে বসবাস করা ২৬০ জনের মতো মানুষ এখন কষ্টে আছে৷’’

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের যে বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী, সেখানে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন৷ নতুন অর্থবছরে তিনি এ খাতের জন্য ৪ হাজার ৩২ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন৷ এটি মোট প্রস্তাবিত বাজেটের শূন্য দশমিক ৬৬ শতাংশ৷ ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন খাতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৯৮৪ টাকা৷ এটি বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি৷

বাজেট প্রতিক্রিয়ায় ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)-এর সভাপতি রাফিউজ্জামান বলেন, ‘‘প্রতিবছর আমরা দেখি বাজেটে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয় তার ৭০ ভাগই ব্যয় হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নানা প্রকল্পে৷ অল্প কিছু পায় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন৷ সরকার যদি আসলেই পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে চায়, এতে বরাদ্দ বেশি দিতে হবে৷ পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে৷ বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে না টানতে পারলে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়৷’’

 ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সরকারের কাছে কিছু দাবি করেছিলাম৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার সংসদে যে বাজেট পেশ হলো সেখানে তার কোনো প্রতিফলন নেই৷ আমরা কিছু চার্জ আর ফুয়েলের দাম কমাতে বলেছিলাম৷ সেগুলোর কিছুই বাজেটে নেই৷ ফলে আমরা টিকে থাকতে পারবো কিনা জানি না৷’’

‘দেশেই বিদেশি মানের ভালো গেস্ট হাউজ আছে’

তবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক যুগ্ম সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনা মহামারি শুরুর পর আমরা এই সেক্টরকে বাঁচাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি৷ এর মধ্যে এই সেক্টরের ক্ষতি নিরূপন করতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকনোমিকস (বিআইডিএস)-এর সঙ্গে চুক্তি করেছি৷ আগামী দুই মাসের মধ্যে তাদের কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার কথা৷ ট্যুরিজমের সংজ্ঞায় কারা পড়বে সেটাও নির্ধারণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ট্যুরিজম বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে আমরা কাজ করছি৷ ইতিমধ্যে ট্যুরিজম সেক্টর থেকে চাকরি যাওয়া ৩০০ জনের তালিকা করে জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো হয়েছে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় তাদের আনার জন্য৷ এছাড়া কীভাবে এই সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেটার জন্য দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছি৷ এখন পর্যন্ত আমরা ৫০টির মতো বৈঠক করেছি৷’‘

বাংলাদেশের ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস কোম্পানিগুলো সাধারণত ট্যুরিস্ট ভিসা, বিজনেস ভিসা, মেডিকেল ভিসা, হজ ও উমরাহ ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা প্রসেস এবং ট্যুর প্যাকেজ, ট্যুর কনসালট্যান্সি ও এয়ার টিকেটিংয়ের কাজ করে থাকে৷ ইউরোপ-অ্যামেরিকার দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে প্রতি মাসে হাজার হাজার বাংলাদেশি নাগরিক ভ্রমণ করে৷ দিন দিন বাড়ছিল ভ্রমণকারীর সংখ্যা৷ সেইসঙ্গে বাড়ছিল এ খাতের উদ্যোক্তার সংখ্যা ও বিনিয়োগও৷ গত দুই দশকে এই খাতে নতুন করে অন্তত দুই হাজার উদ্যোক্তা তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন৷ ফলে ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস খাতে তৈরি হয়েছিল প্রচুর নতুন কর্মসংস্থান৷

ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, করোনা শুরুর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে পাঁচ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে এসেছিল৷ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ভ্রমণে গিয়েছেন ১৩ লাখ মানুষ৷ পাশাপাশি দেশের মধ্যে ঘুরে বেড়ান ২০ লাখেরও বেশি মানুষ৷ করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজন বিদেশি পর্যটকও বাংলাদেশে ঘুরতে আসেননি৷