1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লক্ষ্মণরেখা মানতেই হবে সাংসদদের

৬ আগস্ট ২০২১

লোকসভা, রাজ্যসভা, বিধানসভায় বিরোধ তো হবেই। তার কি একটা সীমা থাকা দরকার? সরকারেরও দায় থাকে বিতর্কের পরিবেশ তৈরি করার।

https://p.dw.com/p/3ydDh
পেগাসাস ও কৃষক বিক্ষোভ নিয়ে বিরোধীদের প্রতিবাদের জেরে সংসদ কার্যত অচল থাকছে। ছবি: picture-alliance/dpa/STR

গণতন্ত্রে প্রতিবাদ থাকবে, প্রতিবাদের সুযোগ থাকবে, প্রতিবাদের চরিত্রও বদলাবে, এটা জানা কথা। কিন্তু সেই প্রতিবাদও কি কখনো কখনো গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়? আঘাত করে গণতন্ত্রকেই? সম্প্রতি সংসদে যা হয়েছে, তারপর এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

এই নিয়ে পরপর তৃতীয় সপ্তাহ বিরোধীদের প্রতিবাদে কার্যত অচল থেকেছে সংসদ। আর সেখানে বিরোধীদের মধ্যে তৃণমূলের বিক্ষোভ ছিল কিছু ক্ষেত্রে অভিনব এবং কিছু ক্ষেত্রে খুবই চড়া সুরে বাঁধা। প্রথমে রাজ্যসভায় মন্ত্রীর হাত থেকে কাগজপত্র ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ। তার জন্য তাকে অধিবেশনের বাকি দিনগুলির জন্য সাসপেন্ড করা হয়।

এরপর দিন দুয়েক আগে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য ছয় তৃণমূল সাংসদকে একদিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। তারপর তৃণমূলের সাংসদ ও নিরাপত্তাকর্মীরদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয় বলে অভিযোগ। সেখানেই কাচ ভেঙে একজন নিরাপত্তা রক্ষীর কাঁধে লেগেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ বলেছেন, কাচ ভেঙে অধিবেশন কক্ষে ঢোকাটা নিন্দনীয়।

কিন্তু যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে, তৃণমূলের সেই সাংসদ অর্পিতা ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''সাসপেন্ড করার পর আমরা বাইরে বেরিয়ে যাই। রাজ্যসভার অধিবেশন দিনের মতো মুলতুবি হয়ে যাওয়ার পর আমরা আমাদের ব্যাগ ও কাগজপত্র নিয়ে আসার জন্য ভিতরে ঢুকতে চাই। কিন্তু মার্শালরা দরজা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েন।'' অর্পিতার বক্তব্য, ''অধিবেশন শেষ হয়ে যাওয়া মানে সাসপেনশনও শেষ হয়ে যাওয়া। তা সত্ত্বেও আমাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। জয়া বচ্চন, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বাম সাংসদরা এসে বলার পরেও নয়। সেখানে কোনো মেয়ে মার্শালও ছিলেন না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমরা যখন ঢুকতে যাই, তখন একটা ছোট কাচ ভাঙে।'' অর্পিতা জানিয়েছেন, ''এরমধ্যে তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ওব্রায়েনরা রাজ্যসভার সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে জানতে চান, সাসপেনশন আছে না নেই। তিনি জানান নেই। তারপর সেখান থেকে বার্তা আসে। আমরা ঢুকতে পারি।''

এই প্রতিবাদ, সাসপেনশন, অধিবেশন শেষে ভিতরে ঢুকতে চাওয়া, বাধা দেয়া এবং কাচ ভাঙার ঘটনা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এখানে কার দোষ, কার দায় এই সব বিতর্কের মধ্যে ঢোকার কোনো দরকার নেই। শুধু এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে, প্রতিবাদ তো হবেই। কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করলেই তার ধাক্কা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গিয়ে লাগতে পারে। ফলে কোনো একপক্ষ নয়, দায়টা সরকার, বিরোধী সকলের ক্ষেত্রেই কমবেশি সমান। আর আজকাল এই টিভি, ডিজিটাল মিডিয়ার রমরমার যুগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই সীমারেখা মুছে যাচ্ছে।

ইউপিএ-র আমলে যখন দিনের পর দিন বিজেপি সংসদ অচল করে রেখেছে, সেসময় সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলিরা বলেছেন, এটা সংসদীয় প্রতিবাদের অঙ্গ। অর্থাৎ, এইভাবে অধিবেশন অচল করে সরকারের উপর চাপ দেয়া কোনো অন্যায় নয়। তারপর বিজেপি যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখন বিরোধীরা একই অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। সেই সময় বিজেপি-র পক্ষ থেকে গেল গেল রব তোলা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেতে বাধা দেয় পুলিশ। তিনি সোজা চলে আসেন বিধানসভায়। অভিযোগ ছিল, তাকে পুলিশ নিগ্রহ করেছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, এরপরই তৃণমূলের বিধায়করা বিধানসভায় মাইক ভেঙে দেন, রেকর্ডবুক নষ্ট করার চেষ্টা করেন, আসবাব ছুঁড়ে ভেঙে দেন, নয়জন বিধায়ক সহ ১৩ জন আহত হন। তারও আগে রাজ্যে একটি ধর্ষণের প্রতিবাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাইটার্সে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে বসে পড়েন। তাকে জোর করে উঠিয়ে পুলিশ লালবাজারে নিয়ে গিয়েছিল। তখন মমতা বলেছিলেন, তার চুলের মুঠি ধরে পুলিশ নিয়ে এসেছে।

প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র মনে করেন, মমতা যেভাবে প্রতিবাদ করেছেন, তা সবসময় কপিবুক হয়নি, অনেক সময়ই সীমা লঙ্ঘন করেছে। আবার এটাও সত্য, ওইভাবে আন্দোলন না করলে তিনি সিপিএমকে সরাতে পারতেন না। সিপিএমও তখন যা করছিল, তার অনেক কিছুই নিয়মের আওতায় পড়ে না।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে।ছবি: privat

প্রশ্ন হলো, প্রতিবাদ জানানোর, প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনেক উপায় গণতন্ত্রে আছে। সেই সব অস্ত্রকে হাতিয়ার না করে এরকম চরম জায়গায় প্রতিবাদকে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক? যখন বিরোধী আসনে থাকে রাজনৈতিক দলগুলি, তখন তারা বলে অবশ্যই ঠিক। আবার তারাই যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন বলে একেবারেই ঠিক নয়। ঠিক-ভুলের সংজ্ঞা তো ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় দুই রকম হতে পারে না।

অটলবিহারী বাজপেয়ী, প্রণব মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়রা ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখানো পছন্দ করতেন না। তারা সবসময় একটা সীমার মধ্যে থাকা পছন্দ করতেন। তারা বলতেন, সংসদ হলো আলোচনার জায়গা, বিতর্কের জায়গা। বিক্ষোভ হলো শেষ অস্ত্র। এবার বিরোধীদের অভিযোগ হলো, পেগাসাস দিয়ে ফোনে আড়িপাতার বিষয়টি সরকার কোনো আলোচনা করতেই রাজি নয়। তাহলে বিরোধীরা কি করবে? চুপ করে বসে থাকবে না কি প্রতিবাদ দেখাবে? আর সেই প্রতিবাদ চুপচাপ হলে তো প্রচারেই আসবে না। সেজন্যই তারা কখনো কখনো উচ্চকিত প্রতিবাদ করেন। সরকারকে এইভাবেই চাপে রাখা যায়। মানুষের মনে ধারণা তৈরি হয়। আর রাজনীতি তো মানুষের মনে ধারণা তৈরির খেলা।

এ সবই হয়ত ঠিক কথা। কিন্তু এটাও ঠিক, গণতন্ত্রের ভিতটা দুর্বল হয়ে গেলে তখন যে ক্ষতিটা হবে, তা সামাল দেয়া দুষ্কর হবে। ফলে সরকার-বিরোধী, ক্ষমতাসীন, ক্ষমতাহীন, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসতে পারেন এমন দলের, এককথায় সকলের উচিত হবে, লক্ষ্মণরেখা বজায় রাখা। না হলে পরে অনুতাপ করেও কিছু করা যাবে না।