1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যৌন হেনস্থা সমাজের দৈনন্দিন বাস্তবতা

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৩ অক্টোবর ২০১৮

ভারতে মি-টু আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে৷ অনেক বিশিষ্ট মানুষের বিরুদ্ধে উঠছে যৌন হেনস্থার অভিযোগ৷ যদিও এই সমাজে যৌন নিগ্রহ একটি দৈনন্দিন বাস্তবতা৷

https://p.dw.com/p/36Rpg
ছবি: Payel Samanta

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ‘মি-টু' আন্দোলনের সূত্রপাত, তা ইদানীং ভারতেও আলোড়ন তুলেছে৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম জে আকবর থেকে বলিউড তারকা নানা পাটেকর ‘মি-টু' সূত্রেই খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন৷ অভিযোগকারীদের মধ্যে রয়েছেন তনুশ্রী দত্তের মতো অভিনেত্রী থেকে মহিলা সাংবাদিকও৷

মোবাইল অ্যাপসে প্যানিক বাটনে চাপ দিলেই স্থানীয় থানা বা ট্র্যাফিক পুলিশের কাছে খবর চলে যাবে
মোবাইল অ্যাপসে প্যানিক বাটনে চাপ দিলেই স্থানীয় থানা বা ট্র্যাফিক পুলিশের কাছে খবর চলে যাবেছবি: Payel Samanta

কিন্তু, এটা হিমশৈলের চূড়া মাত্র৷ সমস্যা আদতে আরও বড় এবং তার অধিকাংশটাই প্রকাশ্যে আসে না৷ প্রকৃতপক্ষে, এই সমাজে যৌন হেনস্থা দৈনন্দিন বাস্তবতা৷ অফিস-কাছারি, রাস্তাঘাট থেকে গণপরিবহনের ট্রেন-ট্যাক্সি-বাস-অটোয় প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে৷ পাশে বসার অছিলায় আপত্তিকর স্পর্শের অভিজ্ঞতা তো মেয়েদের হামেশাই হচ্ছে৷ সল্টলেকের দীপিকা ঘোষ ডয়চে ভেলেকে জানালেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা৷ ‘‘এ অঞ্চলে অটোচালকের ব্যবহার মোটেই ভাল নয়৷ ট্যাক্সিচালকেরাও মাঝে মাঝে খারাপ আচরণ করে, অভব্য যাত্রী তো আছেনই৷ শুধু তাই নয়, ছোটবেলা থেকে আত্মীয়স্বজন কিংবা গৃহশিক্ষক, নানা ভাবে হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে৷''

‘মহিলা হেল্পলাইনের পাশাপাশি লেডিস স্পেশ্যাল ট্রেনটি সম্পূর্ণভাবে মহিলা চালিত করার উদ্যোগও নিয়েছে রেল’

মহানগরের বুকে গণপরিবহণ মহিলাদের পক্ষে কতটা নিরাপদ? বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সুমন গুহ বললেন, ‘‘সবাই খারাপ নয়৷ ১০ শতাংশ ট্যাক্সিচালকের ক্ষেত্রে অভিযোগ এলেও বাকিরা ভালোই হন৷''  মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য তাঁরা ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে দাবি করলেন তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা প্যানিক বাটন চালু করছি এই পুজোয়৷ মোবাইল অ্যাপসে প্যানিক বাটনে চাপ দিলেই স্থানীয় থানা বা ট্র্যাফিক পুলিশের কাছে খবর চলে যাবে৷ কোনও মহিলা সমস্যায় পড়লে হেল্প লাইন নম্বরে ফোন করতেও পারেন৷''

তবে অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বাসে মহিলারা যথেষ্ট সুরক্ষিত থাকেন বলে দাবি করলেন ওয়েস্ট বেঙ্গল বাস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দীপক সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘এত বড় রাজ্যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে৷ তবে মোটের উপর পরিস্থিতি ভালো৷'' রেল পরিষেবায় নারী সুরক্ষার ব্যাপারে ইস্টার্ন রেলওয়ের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘মহিলাদের সঙ্গে কোনও অন্যায় হলে প্রতিবাদ সকলেরই করা উচিত৷ সাধারণ যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে সেটা ভালোই হবে৷ স্টেশন চত্বর এবং ট্রেনের কামরায় যাতে কোনও অঘটন না ঘটে, সেটার দিকে রেল প্রশাসন নজর রেখেছে৷ মহিলা হেল্পলাইনের পাশাপাশি লেডিস স্পেশ্যাল ট্রেনটি সম্পূর্ণভাবে মহিলা চালিত করার উদ্যোগও নিয়েছে রেল৷''

‘যৌন হেনস্থা মহিলার কাছে একটা বড় ট্রমা’

মেট্রো রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ‘‘মহিলাদের নিরাপত্তার স্বার্থে মেট্রো ভবন থেকে ট্রেনে নজরদারি রাখা হয়৷ সিসিটিভিতে নজর রাখা হয় স্টেশনে৷ সাদা পোশাকে মহিলা পুলিশ ও আরপিএফ (রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্স)-এর কর্মীরা  থাকেন৷ কামরার মধ্যে যে হেল্পলাইন নম্বর রয়েছে, সেটিতে যে কোনও সময় যাত্রীরা ফোন করতে পারেন৷ নির্দিষ্ট কামরার নম্বর বলতে পারলে পরের স্টেশনে ট্রেন থামলেই সেই কামরায় হাজির হবেন আরপিএফের কর্মীরা৷''

সব পরিবহণের হেল্পলাইন রাখা হয়েছে বটে, কিন্তু কতজন মহিলাই বা এ ধরনের অভিজ্ঞতার পর মুখ খোলেন? থানায় অভিযোগ জানানো দূরের কথা! অভিযোগ না জানালে সেটা হিসাবে আসে না, যৌন নিগ্রহের ঘটনা বলে স্বীকৃত বা নথিভুক্ত হয় না৷

সবচেয়ে করুণ পরিস্থিতি হয় কর্মক্ষেত্রে যৌন লাঞ্ছনার শিকার মহিলাদের৷ কাজের ক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ যখন হয়, তখন একজন নিম্ন আয়ের মহিলার মতো সেলিব্রিটিরাও একইরকম সঙ্কটে পড়তে পারেন, এমনটাই মত নারী আন্দোলনের কর্মী, অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষের৷ তিনি বলেন, ‘‘অভিনেত্রীরাও এ ধরনের অভিজ্ঞতার সামনে পড়লে অসহায় বোধ করতে পারেন৷ তাঁরা বিখ্যাত মানুষ হলেও কাজ হারানোর ভয় তাঁদেরও রয়েছে৷

‘১০ শতাংশ ট্যাক্সিচালকের ক্ষেত্রে অভিযোগ এলেও বাকিরা ভালোই হন’

উচ্চমানের জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে আমাদের থেকে তাঁদের আরও বেশি উপার্জন করতে হয়৷'' এ জন্য পুরুষদের শুধু দায়ী করতে রাজি নন শাশ্বতী৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘পুরুষতন্ত্র মানে শুধু পুরুষ নয়, এর মধ্যে মহিলারাও আছেন৷ আপনার নিগ্রহ হলে বাড়ির মা ও বৌদিরা সবার আগে প্রশ্ন তুলবেন, তুই ওর কাছে গিয়েছিলি কেন? জানিস তো লোকটা পাজি! অর্থাৎ মহিলারাই অপদস্থ হওয়ার পর মেয়েটিকে ভয় পেতে শেখায়৷'' তবে সমাজ প্রতিবাদী নারীকে এখন বাহবা দিচ্ছে, যদিও প্রতিবাদের জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে বলে মত শাশ্বতীর৷

সম্প্রতি যে অভিযোগগুলি উঠছে, অনেকে বলছেন, সেগুলি প্রচার পাওয়ার চেষ্টা৷ তাই ‘মি-টু' নামে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে৷ অভিযোগ থাকলে এতদিন মুখ বন্ধ করে ছিলেন কেন? পরিচালক ও অভিনেত্রী সুদেষ্ণা রায় বলেন, ‘‘যৌন হেনস্থা মহিলার কাছে একটা বড় ট্রমা৷ তাই সঙ্গে সঙ্গে মুখ খোলা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না৷ নিগৃহীতা যদি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ২০ বছর আগের ঘটনার কথা বলেন, তাতে দোষের কিছু নেই৷ তখন সাহস হয়নি, এখন ফোরাম পাওয়া গিয়েছে, তাই সাহস করে বলতে পারছেন মহিলারা৷'' একসময় সাংবাদিকতার পেশায় জড়িয়ে থাকা সুদেষ্ণা বলেন, মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মহিলা সাংবাদিকদের অভিযোগ মিথ্যা নয়৷ একই কথা শিল্পী অভিজিতের ক্ষেত্রে খাটে৷''

‘এই বিষয়টা নিয়ে আরও বেশি আলোচনার দরকার ছিল’

কর্মস্থলে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থা রুখতে সুপ্রিম কোর্ট বিশাখা কমিটি তৈরির নির্দেশ দিয়েছে৷ কিন্তু, তাতে কি মহিলাদের কাজের সুযোগ দেওয়া থেকে পদোন্নতি, এমন নানা প্রলোভন দেখিয়ে যৌন হেনস্থার প্রবণতা কমেছে? রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই বিষয়টা নিয়ে আরও বেশি আলোচনার দরকার ছিল৷ এর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না৷ এই কমিটি গঠনের দায়িত্ব থাকছে সেই ব্যক্তির হাতে যিনি মহিলা কর্মীকে নিয়োগ করছেন৷ আবার কর্ণধার হিসেবে মহিলারা থাকলেও, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সেই নারী ক্ষমতায় থেকে পুরুষেরই সমমনস্ক হয়ে ওঠেন৷ তাই হেনস্থার সমাধান হয় না৷''

মহিলাদের মধ্যে থেকেই মি-টু নিয়ে একটা ভিন্নস্বর শোনা যাচ্ছে৷ অনেক পুরুষের মতোই তাঁরাও বলছেন, কিছুটা একতরফা হইচই হচ্ছে৷ দমদম পুরসভার জনপ্রতিনিধি ও আইনজীবী রিঙ্কু দে বলেন, ‘‘প্রতিবাদ হওয়া অবশ্যই দরকার৷ আমরা প্রতিনিয়ত এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি৷ কিন্তু, একইসঙ্গে আমাদের নিজেদেরও পরিমার্জিত করতে হবে৷ অনেক ক্ষেত্রে মহিলারা এমন পোশাক পরেন, যেটা শোভন নয়৷''

আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য