ভরণপোষণ না মিললেও সন্তানের বিরুদ্ধে মামলায় অনীহা
১২ মে ২০১৯আর বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় সন্তানের বিরুদ্ধে বাবা-মায়ের মামলা করার ঘটনা বিরল৷ তাহলে প্রশ্ন আসে, এ আইনটি কার্যবর হবে কিভাবে?
২০১৩ সালে পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিষয়ক আইন পাস করে সরকার৷ এই আইন অনুযায়ী সক্ষম সন্তানরা বাবা-মায়ের ভরণপোষণ প্রদান করতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে৷
সক্ষম সন্তান যদি এ দায়িত্ব পালন না করে তাহলে বাবা-মায়েরা ভরণপোষণের দাবিতে সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবেন৷ অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তকে এক লক্ষ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৩ মাসের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে এই আইনে৷ উল্লেখ্য, ভরণপোষণ বিষয়ক এ মামলা আপোশযোগ্য এবং জামিনযোগ্য৷ আর মামলা হবে আদালতে৷
আইনটি প্রণয়নের পর এ নিয়ে বেশ আলোচনা হলেও বাস্তবে এর তেমন প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না৷ আইন প্রণয়নের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত দু-একটি মামলার খবর জানা গেছে৷ প্রথম মামলাটি হয় ২০১৭ সালের মে মাসে কক্সবাজারের একটি আদালতে৷ কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং এলাকার আসিয়া খাতুনের (৮১) পক্ষে মামলাটি করা হয়৷ এই মামলায় তাঁর ছেলে সিরাজ আহমেদ ও দুই নাতি আব্দুল খালেক ও মাহমুদুল হককে তখন গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, সিরাজ তার মাকে ভরণপোষণতো দিতইনা বরং তার দুই ছেলেকে নিয়ে মারধোর করত৷
বাবা-মাকে ভরণপোষণ না দেয়া ও অবহেলা করার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়৷ এমনকি নির্যাতনের ঘটনার খবরও পাওয়া যায়৷ তবে এ বিষয়ে মামলা হওয়ার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না৷
সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর প্রশাসনের উদ্যোগে কিছু ঘটনার নিষ্পত্তি হয় বলে জানা গেছে৷ ২০১৭ সালে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পুটিজান গ্রামে মা মরিয়ম বেগমকে (৯৮) গোয়াল ঘরে থাকতে দেয়ার খবর প্রকাশ হয়৷ খবর প্রকাশের পর স্থানীয় পুলিশ নিজ উদ্যোগে মরিয়মের ছেলে মোখলেছ আমিনকে গ্রেপ্তার করে৷
আইনে পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিষয়ে বলা হয়েছে:
১. প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে৷
২. পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভরণপোষণের বিষয়টি নিশ্চিত করবে৷
৩. পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একইসঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে৷
৪. কোনো সন্তান তার পিতা-মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বসবাসে বাধ্য করতে পারবে না৷
৫. প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে৷
৬. পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ই আলাদা বসবাস করলে সন্তানকে নিয়মিত তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে৷
৭. কোনো পিতা বা মাতা আলাদাভাবে বসবাস করতে চাইলে সন্তানরা তাদের আয় অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত ভাতা দেবেন৷
এ আইনে পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণপোষণের কথাও বলা হয়েছে৷ আইনের এই বিধান মানা সন্তানদের জন্য বাধ্যতামূলক৷ এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ ১ম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য৷
পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ছাড়া এই আইনের কোনো মামলা আমলে নেয়া যাবে না৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচাক নূর খান বলেন, ‘‘আইনটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এই আইনের ভেতরেই বাধা আছে৷ আর তা হলো পিতা-মাতা ছাড়া কেউ অভিযোগ করলে তা আমলে না নেয়ার বিধান৷ বাংলাদেশে যে সামাজিক ব্যবস্থা এবং মূল্যবোধ রয়েছে তাতে ভরণপোষণের মত ঘটনায় সাধারণত বাবা-মা সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করেন না বা করবেন না৷ আর ভরণপোষণের প্রশ্ন সাধারণত তখনই বড় হয়ে দেখা দেয় যখন বাবা-মা শেষ বয়সে কর্মক্ষমতা হারান ও তাঁদের জীবন যাপনের কোনো উপায় থাকেনা৷ এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের পক্ষে মামলা করা কতটা সম্ভব তাও ভেবে দেখা প্রয়োজন৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি সুরাহার জন্য সামাজিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন৷ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে৷ বাবা-মা ছাড়াও অন্য কারো অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে ও তদন্ত করে আদালত বা পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে যেন ব্যবস্থা নিতে পারে সে বিধান করা প্রয়োজন৷ তা না হলে এই আইনটি খুব বেশি কাজে আসবেনা৷''
তবে এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন ব্যারিস্টার মিতি সানজানা৷ তাঁর মতে, ‘‘বাবা-মা'র বাইরে অন্য কারুর মামলা করার বা অভিযোগ করার সুযোগ দেয়া হলে তা আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ ও শান্তি বিনষ্ট করতে পারে৷ পারিবারিক ব্যাপারে আউটসাইডারদের টেনে না আনাই ভালো৷ এখানে পিতা মাতা চাইলে মামলার সুযোগ আছে৷ এটা আপোশযোগ্য৷ এর মানে হলো মিলমিশেরও সুযোগ আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই আইনটি একটি ব্যতিক্রমী ও অস্বাভাবিক আইন৷ পৃথিবীর অন্যকোনো দেশে এ ধরনের আইন নেই৷ দুঃখজনক হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের একটি আইন করতে হয়েছে৷ আমাদের দেশে বাবা-মায়েরা সন্তান জন্মের পর থেকে তাদের লেখাপড়া ও স্বনির্ভর হওয়া পর্যন্ত সন্তানদের সমর্থন দিয়ে যান৷ তারপরও বৃদ্ধ বয়সে তাঁরা অনাদর আর অবহেলার শিকার হন৷ তারা নির্যাতনের শিকার হন বলেও আমরা সংবাদ মাধ্যমে খবর দেখি৷ উন্নত বিশ্বে সন্তানদের ১৮ বছর হলেই বাবা-মায়ের আর কোনো দায়িত্ব থাকেনা৷ সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা আছে৷ সিনিয়র সিটিজেনরা অবহেলার শিকার হননা৷''
তাঁর মতে, ‘‘আইনের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিকভাবে বিষয়টি এ্যাড্রেস করা৷ শুধু আইন করে পারিবারিক শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা যায়না৷ ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে সন্তানদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে৷ পিতা-মাতাকে সম্মানের বিষয়টি শেখাতে হবে৷ নিজেদের জীবনে চর্চা করতে হবে৷'' এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷৷
‘‘সিনিয়র সিটিজেনদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের এগিয়ে আসতে হবে,''বলেন সানজানা৷
এই আইনটি কার্যকরের জন্য এখন বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে৷ বিধিমালা প্রণয়ন কমিটির প্রধান সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নাসির উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আইনটির আলোকে বিধিমালা করছি যাতে আইনটি আরো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়৷ আইনের আওয়তায় কাদেরকে ভরণপোষণ সংক্রান্ত দায়িত্বের মধ্যে আনা যায় যেমন শুধু সন্তান নয় ছেলের স্ত্রী এবং মেয়ের স্বামীতে দায়িত্বের মধ্যে আনা যায় কিনা সেটি দেখা হচ্ছে৷''
নতুন বিধিমালায় বাবা-মা ছাড়াও অন্যদের মামলা করার সুযোগ দেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটি আমাদের ক্ষমতার বাইরে৷ এটি সংসদের এখতিয়ার৷ সংসদ আইন প্রণয়ন করে৷ সংশোধন বা পরিবর্তন করার ক্ষমতাও তার৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সব ধরণের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে আমরা এই আইনটি রাখছি যাতে সারাদেশে এই আইনটির ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা যায়, আইনটি যেন প্রয়োগ করা যায়৷