1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রাণহীন এক পহেলা বৈশাখ

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৪ এপ্রিল ২০২০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে রমনা পার্ক শুধু মানুষ আর মানুষ৷ গ্রামগঞ্জে মেলা, ঘরে ঘরে উৎসব৷ এমনই বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের চিরায়িত রূপ৷ এবার ভিন্ন আবহে ‘গৃহবন্দি' এক পহেলা বৈশাখ উৎযাপন করল জাতি৷ 

https://p.dw.com/p/3as2e
The empty Ramna Batamul during Pohela Boishakh due to Coronavirus
ছবি: bdnews24.com

ছিল না রাস্তায় মানুষের ভীড়৷ উৎসবের চেয়ে যেন নিরন্ন মানুষের মুখে আহার তুলে দেওয়া, ভয়-আতঙ্ক দূর করে স্বাভাবিক পৃথিবী ফিরে আসার আকুতি ছিল মানুষের মধ্যে৷

স্বাধীনতার পর থেকে রমনা বটমূলে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গান গেয়ে নতুন বছর বরণের আয়োজন করে আসছে ছায়ানট৷ বাঙালির প্রাণের এই উৎসব আরো রাঙিয়ে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা৷ এছাড়াও সারাদেশেই হয় বিভিন্ন আয়োজন৷ এবার সেসবের কিছুই নেই৷ ঢাকা এখন সুনসান নীরব৷ করোনা ভাইরাসের থাবায় প্রাণহীন পহেলা বৈশাখ৷

৪৯ বছরে ছেদ পড়ল ছায়ানটের অনুষ্ঠান

১৯৭১ সালের পর থেকে কখনই বন্ধ হয়নি ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান৷ শুধুমাত্র ২০০১ সালে তীব্র বাধা এসেছিল অনুষ্ঠান না করতে৷ শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান হয়েছে৷ ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ড. সারওয়ার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠানের কথা তো আমরা ভাবতেই পারি না৷ তবুও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব নিয়ম কানুন মেনে খুবই ছোট্ট পরিসরে বিটিভিতে একটা অনুষ্ঠান হয়েছে৷ কারো কোন বিরোধীতা নেই, তবুও হলো না ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান৷ কেন হল না, কেন আমরা করতে পারিনি- সেটা সবাই জানেন৷ আসলে এই সময়টা আমাদের নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে৷ এখন উৎসব নয়, মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়াই প্রধান চ্যালেঞ্জ৷ সবার একটাই চাওয়া, করোনা যুদ্ধে যেন আমরা জয়ী হতে পারি৷ 

নিসার আহমেদ

মঙ্গল শোভাযাত্রার টাকায় পিপিই

প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভযাত্রার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ৷ ‘‘এবার মঙ্গল বার্তা নিয়ে আসা মঙ্গল শোভাযাত্রাও বাতিল করা হয়েছে জাতির মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই,’’ ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার আহমেদ৷ তিনি বলেন,  ‘‘গত মাসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রথম বৈঠকেই আমি বলেছি, এবার আমরা আয়োজন করব না৷ সেটা সম্ভবও না৷ এটা এক বিরাট কর্মযজ্ঞ৷ শত শত শিক্ষার্থী এই আয়োজনে যুক্ত হতেন৷ এবার তেমনটা কিছুই হয়নি৷’’

অধ্যাপক নিসার বলেন, ‘‘এবার আমরা সকল শিক্ষক বড় অংকের একটা তহবিল তৈরী করে সেটা দিয়ে পিপিই তৈরী করেছি৷ মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমরা এই টাকা খরচ করতাম৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বসে এবং গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বন্ধুদের দিয়ে আমরা তিন হাজার ৩০০ পিস উন্নত মানের পিপিই তৈরী করেছি৷ সেটা বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসকদের দেওয়া হয়েছে৷ এখন আমরা যে যুদ্ধে নেমেছি, এই যুদ্ধের কৌশলটি হচ্ছে আমাদের ঘরে অবস্থান করা৷ এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার এটাই একমাত্র কৌশল৷ আমরা কিন্তু ভয়ে ঘরে অবস্থান করছি না৷ এই যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে আমাদের এটাই মানতে হবে৷ ৩০ বছর পর ৩১ বছরে এসে ছেদ পড়ল মঙ্গল শোভাযাত্রার৷’’  

অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি, ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা

পহেলা বৈশাখ ঘিরে বিরাট এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয় অনেক আগে থেকেই৷ বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা মেলার জন্য অনেক কিছু তৈরী করেন৷ এবার সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছে৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাই এমন মনে করেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিচার্স ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক যে অর্থনীতির ক্ষতিটা হয়ে গেল সেটা কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না৷ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এটা তো বিশেষ উৎসব ঘিরে৷ এই উৎসব তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না৷ শুধুমাত্র এই একটি উৎসব যেখানে শুধু দেশীয় পণ্যই বিক্রি হয়৷ মানুষ মেলায় যায়, দেশীয় পণ্য কেনাকাটা করে৷ গ্রামীণ নারীরা অনেক কিছু তৈরী করেন৷ অনেকেই এই মেলাকে ঘিরে সারা বছরের একটি পরিকল্পনা সাজান৷ তাদের ক্ষতি তো পুষিয়ে দেওয়া যাবে না৷ 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, করোনার কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতিটা হচ্ছে তার মধ্যে পহেলা বৈশাখের ক্ষতি বড় একটা মাত্রা যোগ করবে৷ আমাদের দেশে ৬ কোটি ১০ লাখ শ্রমিক আছেন৷ এর মধ্যে এক কোটি শ্রমিক দিন এনে দিন খায়৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান যারা করেন তাদের সংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ৷ তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ এই ধরনের কর্মকাণ্ডে কুটিরশিল্পে কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা সরকারকে বলেছি, একটি পরিবারে চারজন আছেন এমন একটি পরিবারকে মাসে আট হাজার টাকা হিসেবে দুই মাসের ১৬ হাজার টাকা দিতে৷ তাতে সরকারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লাগবে, যা জিডিপির এক শতাংশ৷ এভাবেই এই ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সহায়তা করা যেতে পারে৷

ড. নাজনীন আহমেদ

ঘরে পহেলা বৈশাখের আয়োজন 

সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘বাঙালির সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ৷ প্রতিটি বাঙালি আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন এই উৎসব৷ এ বছর বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে পহেলা বৈশাখের বাইরের সব অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে৷ সবাই ঘরে ঘরে এই উৎসব পালন করুন৷ আঁধার কেটে নিশ্চয়ই আলো ফুটে উঠবে৷’’

ঘর থেকে কেউ বের হয়নি সত্য৷ কিন্তু ঘরের মধ্যে কি সত্যি পহেলা বৈশাখের আয়োজন হয়েছে৷ রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা ইমরুল হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, এভাবে কি বৈশাখ হয়৷ অন্য আর ১০টা দিনের মতোই বন্দি দিন কেটেছে৷ তবে খাওয়াতে কিছুটা ভিন্নতা ছিল৷ শেওড়াপাড়ার আরেক বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, ‘‘আজ তো ছিল আমরা দোকানের হালখাতা৷ নতুন খাতা খোলা হলো না৷ অনেকেই বাকী রাখেন, হালখাতায় শোধ করেন৷ এখন কিভাবে আমার পাওনা টাকা উঠবে, সেটা নিয়ে দুঃচিন্তায় আছি৷ দোকান বন্ধ, কর্মচারীদের বেতন কিভাবে দেবো? সব মিলিয়ে কষ্টে আছি৷’’

দেখুন ২০১৮ সালের নববর্ষ উদযাপনের ছবি...