1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দলবদলে জনপ্রতিনিধিদের ‘লুকোচুরি' পশ্চিমবঙ্গে

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আইনসভায় একদলের সদস্য। কিন্তু বাইরে অন্যদলের প্রতিনিধি। দলবদলু নেতারা ‘লুকোচুরি' খেলছেন। দলত্যাগ বিরোধী আইন কি ঠুঁটো?

https://p.dw.com/p/4NHFJ
পশ্চিমবঙ্গে দলবদলু
ছবি: Subrata Goswami/DW

রাজনীতিতে দলবদল নতুন বিষয় নয়। পশ্চিমবঙ্গে গত এক দশকে তার ঝোঁক বেড়েছে। এক দলের টিকিটে ভোটে জেতার পর অন্য দলে যোগদান জলভাত হয়ে গেছে।

 কিন্তু রাজ্যের জনপ্রতিনিধিরা দলের মায়া ছাড়তে পারলেও সাংসদ বা বিধায়ক পদের মায়া ছাড়তে পারছেন না। এতে আবার লোকসভা বা বিধানসভার সদস্যপদ খারিজ হওয়ার ভয় থাকে। যদিও দলত্যাগ বিরোধী আইন সেভাবে প্রয়োগ হতে দেখা যায় না।

 এই প্রবণতার সাম্প্রতিকত নজির গড়েছেন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল। গত সোমবার তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে দলে গ্রহণ করেন।

 যদিও সাবেক সাংবাদিক সুমনের তৃণমূলে যোগদান পর্বটি ছিল একটু ব্যতিক্রমী। তাকে অভিষেক উত্তরীয় পরালেও ছিল না ঘাসফুলের পতাকা। যোগদান করলেও প্রকাশ্যে তা স্বীকার করছেন না সুমন। বলছেন এটা ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ'। কিন্তু বিজেপিকে আক্রমণ করে বিবৃতি দিতে ছাড়ছেন না তিনি। জেলার তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে ছবিও দেখা যাচ্ছে বিধায়কের। গত মে মাসে দেখা গিয়েছে, পদ্ম টিকিটে জেতা ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের সময় পতাকা হাতে তোলেননি।

 ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপি ৭৭টি আসনে জেতে। দুই সাংসদ জগন্নাথ সরকার ও নিশীথ প্রামাণিক বিধায়ক পদ ছেড়ে দেন। শান্তিপুর ও দিনহাটার উপনির্বাচনে জেতে তৃণমূল। এরপর একের পর এক দলত্যাগের ধাক্কায় এখন বিজেপি শিবিরে ৬৯ জন আছেন।

আইনসভার অধ্যক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ: বিমলশঙ্কর নন্দ

খাতায়-কলমে অবশ্য বিজেপিতে আছেন ৭৫ জন বিধায়ক। দলবদলু ছয়জন বিধানসভার সদস্যপদ ছাড়েননি। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম মুকুল রায়। বিজেপির টিকিটে জিতে শাসক শিবিরে ভিড়েছেন রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী, বিষ্ণুপুরের তন্ময় ঘোষ, বাগদার বিশ্বজিৎ দাস ও কালিয়াগঞ্জের সৌমেন রায়।

 বিশ্বজিৎ গত মাসে দিদির দূত হয়ে এলাকায় ঘোরার সময় গ্রামবাসীদের প্রশ্নের মুখে পড়েন, আপনি কোন দলে? বাগদার বিধায়ক তৃণমূলের কর্মসূচিতে অংশ নিলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, তিনি বিজেপিতেই আছেন। কৃষ্ণ কল্যাণী এখন বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান। এই পদ বিরোধী বিধায়ককেই দেওয়া হয়। কল্যাণী বিধানসভার ভিতরে বিজেপির সদস্য, কিন্তু তিনি তৃণমূলের কাজকর্মেই যুক্ত আছেন।

 এ ধরনের ‘লুকোচুরি' গড়াচ্ছে আইনের চৌকাঠেও। ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী, কৃষ্ণনগর উত্তরের বিধায়ক মুকুল রায়ের পদ খারিজের আর্জি আদালতে জানায় বিজেপি। এ নিয়ে বিধানসভায় দফায় দফায় শুনানি করেন অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষমেশ মুকুলকে বিজেপির বিধায়ক হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হয়েছে, তার আনুগত্য যেদিকেই থাকুক। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বা সব্যসাচী দত্তের মতো নেতারা বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে হেরে যাওয়ায় তাদের তৃণমূলে ফেরা নিয়ে এ ধরনের সমস্যা হয়নি।

 একসময় তৃণমূলের ‘চাণক্য‘ ও ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড‘ মুকুলের মামলা বুঝিয়ে দেয়, অন্যান্য দলবদলু বিধায়কদের কী পরিণতি হতে পারে। এই নেতারা বিধায়ক পদ ধরে রাখতে বিজেপির সঙ্গে দূরত্বের কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাই বলেছেন, ‘বিজেপিতে আছেন ৭৫ জন বিধায়কই।‘

 খাতায়-কলমে এই দাবি ঠিক হতে পারে, তবে কার্যত বিজেপির শক্তিক্ষয় হয়েই চলেছে। লাঠি না ভেঙে সাপ মারার কৌশল নেওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না সুমন কাঞ্জিলালদের। এসব রুখতে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে ১৯৮৫ সালে সংসদে দলত্যাগ বিরোধী আইন পাশ হয়। পরে তা আরো কঠোর করেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী।

এই নিস্পৃহতা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর: শুভাশিস মৈত্র

 কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশজুড়ে আয়ারাম-গয়ারামদের অপরাজনীতি চলছে। এতে সংসদীয় ব্যবস্থা কলঙ্কিত হচ্ছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা। কিন্তু দলত্যাগ বিরোধী আইন কেন যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না? রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘'এক্ষেত্রে আইনসভার অধ্যক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাকেই দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগ করতে হয়। আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের পর্যাপ্ত সংস্থান আছে, কিন্তু ফাঁক থেকে যাচ্ছে প্রয়োগে।‘'

 দলত্যাগ নিয়ে যে বিজেপি নিশানা করছে তৃণমূলকে, তারা জাতীয় ক্ষেত্রে একের পর এক রাজ্যে বিধায়কদের দলে টেনে ক্ষমতায় এসেছে। যদিও বিজেপির ব্যাখ্যা, মধ্যপ্রদেশ বা কর্নাটকের বিধায়করা পদ ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো বিধায়ক পদত্যাগ করে নতুন দলের টিকিটে ভোটে লড়লে দলত্যাগ বিরোধী আইনের কোপে পড়েন না। একই ভাবে যদি কোনো দলে বড়সড় ভাঙন হয়, দুই-তৃতীয়াংশের বেশি জনপ্রতিনিধি দল ছাড়েন, সেক্ষেত্রেও এই আইন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

 কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কিংবা বিজেপি, পদ রেখেই চলছে দলবদল। শুভেন্দু অধিকারীর পিতা শিশির ও ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী তৃণমূলের টিকিটে জিতে লোকসভার সদস্য। কিন্তু তারা সাংসদ পদ না ছেড়ে এখন পদ্ম শিবিরে। তাই তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের মন্তব্য, ‘'আপনার বাবা ও ভাইকে দলত্যাগ বিরোধী আইনের কথা বলুন।‘'

 মতের অমিল হলে পথ বদলেই যেতে পারে। কিন্তু নতুন পথের কথা সোচ্চারে  না বলা আদর্শহীনতারই নামান্তর, এমনটাই মত পর্যবেক্ষকদের। একইসঙ্গে এটা কি জনমতের অবজ্ঞা নয়? প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘'জনতা উদাসীন, নিস্পৃহ হয়ে পড়ছে। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশে যারা দলবদল করে পদ ছেড়ে ভোটে দাঁড়ালেন, তাদের আবার অন্য প্রতীকে একই ভোটাররা নির্বাচিত করেছেন। এই নিস্পৃহতা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর।