1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জ্বালানি তেলের উত্তাপে বিপর্যস্ত হবে জনজীবন

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৭ আগস্ট ২০২২

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রথম ধাক্কায় বেড়ে গেছে গণপরিবহণের ভাড়া৷ পণ্যপরিবহণের ভাড়া বাড়ানোর দাবি করেছেন ট্রাকমালিকরা৷ লঞ্চ মালিকরা শতভাগ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন৷ ভোজ্য তেলের দাম ২০% বাড়ানোর দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা৷

https://p.dw.com/p/4FEV4
পরিবহণ ভাড়া বাড়ার প্রভাব সব কিছুর উপর কম-বেশি পড়বে৷
পরিবহণ ভাড়া বাড়ার প্রভাব সব কিছুর উপর কম-বেশি পড়বে৷ ছবি: Mortuza Rashed

জ্বালানি তেলের সঙ্গে আমদানি পণ্যেরব্যবসায়ীরা নতুন একটি ইস্যু যোগ করেন দাম বাড়ানোর জন্য৷ তারা ডলারের দাম বাড়াকে নতুন অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন৷

বাস্তবে সবকিছুরই দাম বাড়তে শুরু করেছে৷ আর কৃষিপণ্যসহ নিত্য পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহণ ব্যয় দুইটিই বেড়ে এর সম্মিলিত প্রভাবে সব কিছুরই দাম বাড়বে৷ দাম বাড়ার এই চাপ বইতে হবে সাধারণ মানুষকে৷ সাধারণ মানুষের আয় না বেড়ে মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় কমছে৷
বাংলাদেশে করোনার কারণে তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে৷ আর গত জুন মাসে পিপিআরসি এবং ব্র্যাক এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নতুন করে আরো ২১ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অভিঘাতে আরো অনেক মানুষ নতুন করে দরিদ্র হবেন৷ অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘‘দারিদ্র্য বাড়লেও তত নাও বাড়তে পারে৷ কারণ দেশের মানুষের আয় বাড়া এখনো থেমে যায়নি৷''

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার কমপক্ষে ৩০ ভাগ বেড়ে যাবে৷কিন্তু এই খরচ বাড়ানোর অর্থ তাদের কাছে নেই৷ তাই তারা দ্রব্য এবং সেবার ব্যবহার কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইবে৷ অনেকে আরো বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বেন৷ মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে৷

যেভাবে চেইন এফেক্ট:

সেন্টার ফর পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, জ্বালানি তেলের পর পরিবহণ ভাড়া বাড়ার প্রভাব সব কিছুর উপর কম-বেশি পড়বে৷ কারণ একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত৷ এর একটা চেইন এফেক্ট আছে৷ শিল্প, কৃষি থেকে শুরু করে সবখানেই ধীরে ধীরে এর প্রভাব দেখা যাবে৷

বিশ্লেষকরা বলছেন সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ উৎপাদন ও পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়া৷ আরেকটি কারণ হলো ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ৷ বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে শিল্প ও পোশাক কারখানাগুলো জ্বালানি  তেলভিত্তিক ক্যাপটিভ পাওয়ার ব্যবহার করায় এমনিতেই তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়৷

এখন আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় খরচআরো বেড়ে গেল৷ তাই কিজিএমই এবং বিকেএমইএ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেছে৷ তারা সরকারকে বিকল্প খোঁজার অনুরোধ করেছে৷ এফবিসিসিআইও মনে করে একবারে ৫০ শতাংশেরও বেশি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি৷ তারা জানিয়েছে, এতে শিল্প উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে৷

কৃষিখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে৷ ইউরিয়া সারের দাম আগে কেজিতে ছয় টাকা বাড়ানো হয়েছে৷ আবার বিদ্যুতও পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো, এখন ডিজেলের দাম বাড়ায় কৃষি উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়ে যাবে৷ কারণ কৃষিতে শতরা ৭০ ভাগ পানি সেচ দেয়া হয় ডিজেল থেকে৷ কৃষি উৎপাদন এবং ভাড়া বাড়ায় পরিবহণ খরচ অনেক বেড়ে যাবে৷ এর প্রভাব পড়বে কৃষিপণ্যের বাজারে৷

আর বাংলাদেশের বাজারের বৈশিষ্ট্য হলো, একটির দাম বাড়লে আরেকটির দামও বেড়ে যায় কোনো কারণ না থাকলেও৷

পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির প্রভাব সব কিছুর উপর পড়বে: আহসান মনসুর

কাঁচাবাজারে প্রভাব শুরু হয়ে গিয়েছে:

বেসরকারি চাকুরিজীবী নাজমুল হক তপন ডয়চে ভেলেকে তার রবিবারের কাঁচা বাজারের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সকালে বাজারে গিয়ে দেখি এক আগের সপ্তাহের তুলনায় সব ধরনের শাক সবজি ও মাছের দাম বেড়ে গেছে৷ মাংসের দামও বেড়েছে৷

বিক্রেতারা জ্বালানি  তেল ও ডলারের দাম বাড়াকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এমনিতেই করোনায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত৷ বাজারদরে ঊর্ধ্বগতি আগে থেকেই ছিল৷ এবার আবার নতুন করে সব কিছুর দাম বাড়তে শুরু করায় কীভাবে হিসাব মিলাবো, বুঝতে পারছিনা৷

তার কথায়, ‘‘আমাদের বেতন বাড়েনি তাই আগেই অনেক খাতে খরচ কমিয়ে কোনোভাবে সংসার চালিয়েছি৷ এবার কোথায় খরচ কমাব, সেটাই বের করতে পারছিনা৷ খরচ কমানো আর জায়গা নাই৷ দিনে এক বেলা না খেয়ে থেকে খরচ কমানো এখন একমাত্র পথ মনে হচ্ছে৷''

একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক সাবিহা ইসলাম বলেন, ‘‘আমি থাকি মিরপুরে৷ কিন্তু আমার স্কুল পুরান ঢাকায়৷ এখন তো বাস ভাড়া দিতেই টাকা শেষ হয়ে যাবে৷ সরকার বাড়তি যে বাস ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে তার চেয়েও ৩০-৪০ ভাগ বেশি নিচ্ছে৷ এগুলো দেখার কেউ নেই৷ তিনিও সকালে কাঁচাবাজারের অভিজ্ঞাতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘এর আগে তো বাড়তি খরচের চাপ ঋণ করে সামাল দিয়েছি৷ এবার আর সম্ভব হবেনা৷ পুরনো ঋণ শোধ করবো, কীভাবে তাই ভেবে পাচ্ছি না৷ নতুন ঋণ নেব কীভাবে!''

‘‘সব কিছুর দামই শতকরা ৩০-৪০ ভাগ বেড়ে যাচ্ছে’’

কলাবাগানের নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ী মিন্টু মিয়া জানান, ‘‘চাল, ডাল, চিনিসহ সব কিছুর দামই বাড়তে শুরু করেছে৷ পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহণ খরচ বেড়ে গেছে৷''

তার কথায়, ‘‘এখনো আগের আনা পণ্য আমরা বিক্রি করছি৷ নতুন পণ্য আসলে আরো দাম বাড়তে পারে৷''

আরেকজন ব্যবসায়ী রহিম মিয়া বলেন, ‘‘ভোজ্য তেল আমদানিকারকরা যে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম ২০ ভাড়া বাড়ানোর দাবি করেছেন তাতে বাজার অস্থির হওয়ায় আশঙ্কা আছে৷ কারণ অনেকেই এখন দাম বাড়বে এই আশায় ভোজ্য তেলের বিক্রি কমিয়ে দেবেন৷ ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট শুরু হতে পারে৷''

পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে ?

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ সভাপতি এস এম নাজের হোসেন মনে করেন, ‘‘সব কিছুর দামই শতকরা ৩০-৪০ ভাগ বেড়ে যাচ্ছে৷ মানুষের খরচও এই হারে বাড়বে৷ কিন্তু এই খরচ মেটানোর টাকা সাধারণ মানুষের হাতে নাই৷ তাই যে ভোগ কমিয়ে খরচ ঠিক রাখার চেষ্টা করবে৷ কাউকে একবেলা না খেয়ে থাকতেও হতে পারে৷ আর মানুষ নতুন করে আরো বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে৷ তার কথায়, ‘‘সব মিলিয়ে শতকরা দুইভাগের বেশি মূল্যস্ফীতি হবে৷''

তার কথায়, ‘‘বাংলাদেশের মানুষের এটা গা সওয়া হয়ে গেছে৷ এখন বেঁচে থাকাই তার কাছে আসল কথা৷ কীভাবে বেঁচে আছে তা ভাবছে না৷'' ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি আরো শতকরা দুই-তিন ভাগ বেড়ে যেতে পারে৷ তবে মানুষের আয় এখনো বাড়ছে৷ ফলে যতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে ততটা নাও পড়তে পারে৷

তার কথায়, ‘‘সরকার ধাপে ধাপে ব্যবস্থাগুলো নিতে পারত৷ এখন একসঙ্গে অনেকগুলো ব্যবস্থা নেয়ায় তার প্রতিক্রিয়া বেশি হচ্ছে৷ সরকারের কাছে আগে অনেক সিগন্যাল থাকলেও আমলে নেয়নি৷ এখন বাধ্য হয়ে সবকিছু একসঙ্গে করছে৷ ঢাকার অবমূল্যায়ন সরকার করতে চায়নি৷ কিন্তু এছাড়া আর কোনো পথ তার কাছে খোলা ছিল না৷ জ্বালানি তেলের দাম সরকার অনেক আগেই আন্তর্জাতিক বাজারের উপর ছেড়ে দিতে পারত৷ আর বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও সরকার সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোয়নি৷

তার মতে, ‘‘ দুর্নীতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনাসহ আরো অনেক অনিয়মের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷