1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঈদ ও উৎসবের অর্থনীতি

২১ এপ্রিল ২০২৩

পবিত্র রমজান মাস শেষ হতে চলেছে৷ রমজান শেষ হওয়া মানেই ঈদুল ফিতর৷ বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুই ধর্মীয় উৎসবের একটি৷

https://p.dw.com/p/4QPGa
Bangladesch Islam l Eid-ul-Fitr, Fest des Fastenbrechens in Dhaka
ফাইল ফটো৷ছবি: Stringer/AA/picture alliance

আর এই উৎসবের দিনটিকে কেন্দ্র করে মুসলিম-প্রধান দেশগুলোতে আবর্তিত হয় বড় ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড৷ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯১ শতাংশ মুসলমান হওয়ায় বাংলাদেশেও ঈদুল ফিতর বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব৷ আর এই উৎসব উদযাপনের জন্য বেশ লম্বা প্রস্তুতি নেয়া হয় যা গোটা রমজান মাসেই প্রতিফলিত হয়৷ রমজান মাসের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা পালন তথা সারাদিন পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকা, রাত জেগে কুরআন তেলাওয়াত ও ইবাদত-বন্দেগি করার পরও মুসলমানরা কম-বেশি ঈদ-কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন৷ যতো সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে, জমে উঠতে থাকে ঈদের বাজার৷

ঈদ বাজারের এই জমজমাট ধারা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছিল চার বছর আগে৷ সেটা ২০২০ সালে যখন বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসজনিত মহামারীর কারণে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ধস নেমেছিল৷ ২০২১ সালেও মন্দাদশা বজায় ছিল৷ উৎপাদক-পরিবেশেক-বিক্রেতা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ তবে সেই ক্ষতি বেশ অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে ২০২২ সালে যখন অর্থনীতিতে গতি ফিরে এসেছে, বাজার চাঙ্গা হয়েছে ও বেচাবিক্রি বেড়েছ৷ এ বছরও সেই চাঙ্গাভাব বজায় রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়৷ তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাত এখানে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে৷ 

এমনিতেই ঈদকে সামনে রেখে যখন বিভিন্ন পণ্য ও সেবার সামগ্রিক চাহিদা বেড়ে যায়, তখন তা চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি করে৷ এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে চলমান ব্যয়জনিত  উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ৷ গত বছর মার্চ মাসে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ যা এপ্রিলে সামান্য বেড়ে হয়ে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ৷  আর এ বছর মার্চ মাসে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ যা ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ৷ এপ্রিল মাস শেষ হওয়ার পর এ মাসের হিসেব পাওয়া যাবে৷ তবে তা মার্চ মাসের চেয়ে বেশি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷

বস্তুত, জুলাই মাস থেকে মূল্যস্ফীতির ধারা ক্রমেই উর্ধ্বমুখী হতে দেখা গেছে৷ এই ধারাবাহিকতায় নিত্যপণ্যের বাজার দফায় দফায় চড়া হয়েছে৷ বেড়ে গেছে খাদ্য, পরিবহন, জ্বালানির দাম৷ ফলে জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশকে ক্রমাগত লড়াই করতে হয়েছে ও হচ্ছে নিত্যদিনের খাদ্য-পুষ্টি ও জীবনযাত্রার মান ধরে রাখার জন্য৷ এভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নির্দির্ষ্ট ও নিম্নআয়ের মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে উৎসব উদযাপনে অংশ নেয়ার সুযোগ অনেক সীমিত করে ফেলেছে৷

তবে, রমজান মাসে সামর্থ্যবান ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অনেকেই জাকাত আদায় করেন এবং দান-সাদকাহ করেন৷ আর এই জাকাত ও সাদকাহ-র মাধ্যমে নিম্নআয়ের ও গরিব মানুষদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কিছুটা উপকৃত হন, কিছুটা স্বস্তি পান৷

রমজান মাসেই জাকাত প্রদানের কোনো বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই, বরং এক চন্দ্রবছর পূর্ণ হলে (তা যে মাসেই হোক) যে মুসলমানের কাছে নিসাব পরিমাণ [সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে ৫২ ভরি রূপা] বা ন্যূনতম ব্যয়যোগ্য সম্পদ থাকবে, তাকেই নিসাবের বাড়তি সম্পদের ওপর জাকাত আদায় করতে হবে৷   তবে অনেকেই প্রতিবছর পহেলা রমজানকে জাকাতের হিসেব করার জন্য বেছে নেন এবং তদানুসারে রমজান মাসে জাকাত প্রদান করে থাকেন৷  বিভিন্ন  দাতব্য প্রতিষ্ঠান [যেমন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম, সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট, আস্সুন্নাহ ফাউন্ডেশন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ইত্যাদি] জাকাতের অর্থ সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য দেশজুড়ে কাজ করে৷ এসব প্রতিষ্ঠান জাকাতযোগ্য গরিব ও অভাবীদের নগদ টাকার পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস কিনে দেয় ৷ কাউকে কাউকে আয়-উপার্জনের জন্য জাকাতের টাকা ছোটখাট ব্যবসার পুঁজি হিসেবে দেয়, আবার কাউকে কাউকে রিকশা, ভ্যানগাড়ি, সেলাই মেশিন ইত্যাদি কিনে দেয়৷

আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিক
আসজাদুল কিবরিয়া, সাংবাদিকছবি: Privat

বছরজুড়ে এসব কাজ চললেও রমজানের সময় ঈদকে সামনে রেখে একটা বাড়তি প্রয়াস দেখা দেয় জাকাত ও সাদকাহর অর্থ বিতরণের৷ ফলে, অনেক সুবিধাবঞ্চিত, অভাবী ও প্রান্তিক মানুষের মুখে ঈদের সময় কিছুটা হাসি ফোটে৷ আবার ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাজের আগেই সামর্থ্যবান মুসলমানদের সাদাকাতুল ফিতরা আদায় করতে হয় নির্ধারিত হারে৷ বঞ্চিত বা প্রান্তিক মানুষ এই ফিতরার অর্থ বা খাবার পেয়ে থাকেন৷

আবার ঈদের আগে প্রবাসী বাংলাদেশিরা পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন উৎসবে খরচ করার জন্য৷ অনেকেই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছু বাড়তি অর্থ পাঠানোয় তা অনেক পরিবারের জন্যই একটু স্বস্তি বয়ে এনেছে৷

কিছু পরিসংখ্যান

ঈদকে ঘিরে ঠিক কি পরিমাণ বা কতো টাকার কেনাবেচা হয়, তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা বেশ কঠিন৷ ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি অনুমিত হিসেবে বলা হয়েছিল যে বাংলাদেশে ঈদ অর্থনীতির আয়তন এক হাজার ২০০ কোটি ডলার (বা ঐ সময়ের বাজারমূল্যে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা)৷ গত বছর বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি একটা হিসেব দিয়ে বলেছিল যে এক লাখ ৫০ হাজার কোটি থেকে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে ঈদ ও পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে৷

ঈদকে ঘিরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়, তা প্রতিফলিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও৷ যেমন: গত বছর ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছিল মে মাসের প্রথম সপ্তাহে (মে ৩, ২০২৩)৷ আর এপ্রিল মাসে মুদ্রা সরবরাহ (এম-২) মার্চ মাসের চেয়ে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল ১৬ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা৷ আবার অর্থনীতির নগদভিত্তি (ক্যাশ বেজ অভ দ্য ইকোনমি) মার্চ মাসের চেয়ে প্রায় ছয় শতাংশ বেড়ে হয়েছিল তিন লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকায়৷ পরের মাসে বা মে মাসে আবার নেমে আসে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায়৷

পয়লা বৈশাখের সংযোগ

ঈদুল ফিতরে দেশীয় পোশাক শিল্প বা ফ্যাশন হাউজগুলো সারা বছরের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবসা করে থাকে৷ কারণ, নতুন কাপড় হলো ঈদের অপিরহার্য একটি অংশ৷ এরপর ফ্যাশন হাউজগুলোর জন্য ব্যবসার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হয় পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে৷ গত দেড় দশকে পয়লা বৈশাখকে ঘিরে কেনাকাটার যে ধূম পড়ে, তার পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে৷ তবে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে এটি একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে৷ ২০২১ সালেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি৷ তবে ২০২২ সালে  বৈশাখী কেনাকাটা খানিকটা ঘুরে দাঁড়ালেও প্রায় তিন সপ্তাহ পর ঈদ হওয়ায় মূল ব্যবসাটা সেদিকেও কেন্দ্রিভূত ছিল৷ আর এ বছরও পয়লা বৈশাখের দেড় সপ্তাহের মধ্যে ঈদ উদযাপিত হতে যাওয়ায়  বাংলা নববর্ষকেন্দ্রিক ব্যবসায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে৷ তারপরও পয়লা বৈশাখের উৎসব ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বজায় ছিল৷ বলা যায়, ঈদের পাশাপাশি এটি সহাবস্থান করছে বা ঈদ উৎসবের সাথে অনেকটাই মিশে গিয়েছে৷ যে কারণে, তেমন দৃশ্যমান না হলেও বৈশাখী বিকিকিনি মন্দ হয়নি৷ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঈদের পাশাপাশি বৈশাখী উৎসব ভাতা পাওয়ায় তা ব্যয় করেছেন এই সময়েই৷

প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব

ঈদ তথা উৎসবের অর্থনীতি দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে৷ এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না যদিও এর পরিমাণগত দিকটি নির্ণয় করা কঠিন৷ সরকারি নীতি-পরিকল্পনা ও নীতি-নির্ধারণী বিভাগের গবেষণা শাখা থেকে এ নিয়ে কাজ হতে পারে৷ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও কাজ করতে পারে৷ এর মধ্য থেকে উৎসবের অর্থনীতির একটি তথ্য-উপাত্তভিত্তিক বড় ছবি বেরিয়ে আসতে পারে যা আবার ব্যবহৃত হতে পারে উৎসবের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নীতি-সহায়তা দিয়ে জোরদার করায়৷ 

[লেখক ঢাকাভিত্তিক দি ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের পরিকল্পনা সম্পাদক৷ মতামত নিজস্ব৷ ]

asjadulk@gmail.com

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান