সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরাবৃত্তি বন্ধ হোক
স্বস্তি আর অস্বস্তির এমন মেশানো অনুভূতি বহুদিন হয়নি। স্বস্তি, কারণ বিজেপি নেতা অশ্বীনি উপাধ্যায় সহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে দিল্লি পুলিশ। যন্তরমন্তরে হেট স্পিচ দেওয়ার কারণে। মুসলিম-বিরোধী স্লোগান দেওয়ার অপরাধে। অস্বস্তি, কারণ হঠাৎ করে বছর দেড়েক আগের অভিজ্ঞতা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বার বার। সে বড় মর্মান্তিক অনুভূতি।
দেড় বছর আগে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ভয়াবহ দাঙ্গার ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে। মনে পড়ে, খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কীভাবে মৃত্যুর মুখে পড়তে হয়েছিল সহকর্মী গৌতমদা এবং আমায়। এখনো মনে পড়ে, কীভাবে একের পর এক চ্যানেলে সে সময় কীভাবে হিন্দুত্ববাদী নেতাদের হেট স্পিচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা চালানো হতো। ভুলিনি মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের 'গোলি মারো সালো কো' স্লোগান। ভুলিনি, আরেক বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের কর্মকাণ্ড। অন্যায় ভাষণ। লোকজন জড়ো করা। যেখান থেকে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ে। জীবনহানি। আতঙ্কের কাহিনি। ঘরবাড়ি লুঠ। চরম ভয়াবহতা।
দিল্লি দাঙ্গার পরে কী ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। কেন ওই বিজেপি নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি? এ প্রশ্ন এখনো বিভিন্ন সময় সামনে চলে আসে। তবে করোনাকালের পরিস্থিতি দিল্লি দাঙ্গার সেই ক্ষতে খানিকটা মলমের প্রলেপ দিয়েছে। মানুষ এখন ভয়াবহ ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টায় মগ্ন।
আতঙ্ক থেমে থাকে না। দিল্লি দাঙ্গার দেড় বছরের মাথায় রাজধানীতে আবার শুরু হয়েছে উসকানি দেওয়ার অপচেষ্টা। আসরে আবার কিছু হিন্দুত্ববাদী নেতা। কিছুদিন আগে হরিয়ানায় রীতিমতো সভা করে মুসলিম-বিরোধী হেট স্পিচ দেওয়া হয়েছে প্রকাশ্যে। বিজেপির তাতে অবশ্য সরাসরি যোগ ছিল না। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বন্দুক তাক করেছিল যে যুবক, জামিন পেয়ে সেও যোগ দিয়েছিল সেই আসরে। আর এবার সরাসরি যন্তরমন্তর। সংসদ ভবন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিজেপি নেতা অশ্বীনি উপাধ্যায় যা বলেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। দেড় বছর কপিল মিশ্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে ব্যবস্থা নেয়নি, এবার অশ্বীনিদের ক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এটুকু দেখে সামান্য হলেও স্বস্তি বোধ হচ্ছে।
কিন্তু কোন প্রয়োজনে হরিয়ানা-দিল্লিতে আবার মুসলিম-বিরোধী স্লোগান সামনে চলে আসছে? কেন হঠাৎ বিষয়গুলি আবার আলোকবৃত্তে? উত্তর জলের মতো স্পষ্ট। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন। গত পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশে শাসন করেছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। হিন্দুত্ববাদী প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে উত্তরপ্রদেশের আকাশে বাতাসে। যোগী এবং বিজেপির ভক্ত যেমন বেড়েছে, তেমন যোগী এবং বিজেপি বিরোধিতাও ক্রমশ শক্ত হয়েছে। পাঁচ বছর আগে উত্তরপ্রদেশ জয় বিজেপির পক্ষে যতটা সহজ ছিল, এখন আর ততটা সহজ নয়। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ কৃষকরা দিল্লির সীমানায় বসে আছেন প্রায় এক বছর হতে চলল। জাতপাত এবং ধর্মের সমীকরণে বাঁধা উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে তাই এখন সাম্প্রদায়িক তাস খেলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ সেখানে যত শক্ত হবে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির তত সুবিধা। মুসলিম ভোট যদি বিরোধীদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়, আর হিন্দু ভোটের সিংহভাগ যদি শুধুমাত্র গেরুয়া শিবিরে পড়ে, তাহলে বিজেপির জয় ঠেকানো যাবে না। এই সহজ সমীকরণের ব্যবহারিক রূপই দেখা যাচ্ছে দিল্লির রাস্তায়, হরিয়ানার গ্রামে। উত্তরপ্রদেশ লাগায়ো দিল্লিতে যদি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি হয়, তাহলে তার রেশ গিয়ে পড়বে উত্তরপ্রদেশে-- এটাই অঙ্ক।
কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গেও একই রাজনৈতিক সমীকরণ সাজানোর চেষ্টা করেছিল গেরুয়া শিবির। সফল হয়নি। তবে মনে রাখা দরকার, পশ্চিমবঙ্গ আর হিন্দি বলয় এক নয়। তাই ভয় করছে। সত্যিই ভয় করছে।
কথায় বলে ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। দেড় বছর আগের চিত্রের পুনরাবৃত্তি যেন ঘটে।