1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৩ মার্চ ২০২৪

ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ'কে এখন সোমালিয়া উপকূলের দিকে নেওয়া হচ্ছে৷ বুধবার সকালে জাহাজটির অবস্থান সোমালিয়া উপকূল থেকে ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল৷

https://p.dw.com/p/4dTV1
সাগরে টহলরত নিরাপত্তারক্ষীরা
নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও বেপরোয়া সোমালিয়ার জলদস্যুরা৷ ফাইল ফটো৷ ছবি: Jackson Njehia/AP/picture alliance

মঙ্গলবার দুপুরে জাহাজটি দস্যুদের কবলে পড়লেও বুধবার বিকেল পর্যন্ত কোনো ধরনের মুক্তিপণ দাবি করেনি জলদস্যুরা৷ তবে আটকে পড়া ক্রুরা অডিও বার্তায় জানিয়েছে, মুক্তিপণ দিয়েই তাদের মুক্ত করতে হবে৷ জাহাজ থেকে নাবিক ও ক্রুদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে পররাষ্ট্র ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়৷ পাশাপাশি প্রস্তুতি নিচ্ছে জাহাজটির মালিক কর্তৃপক্ষ কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম গ্রুপ)৷

মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যাওয়ার পথে জাহাজটিতে হামলা চালায় দস্যুরা৷ এ সময় জাহাজে থাকা বাংলাদেশি ২৩ নাবিক ও ক্রুকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে তারা৷ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শতাধিক জলদস্যু জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়৷ জাহাজে উঠেই তারা সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়৷ তবে দস্যুদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বুধবার সকাল ৭টা পর্যন্ত বার্তা পাঠিয়েছেন জিম্মি নাবিকেরা৷ ওই বার্তার সূত্র ধরে নাবিক ও ক্রুরা নিরাপদে আছেন বলে নিশ্চিত করেছে কেএসআরএম গ্রুপ৷

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য

বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে এক সেমিনার শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, ‘‘আমরা থার্ড পার্টির মাধ্যমে চেষ্টা করছি এবং যেখানে জানানো প্রয়োজন, আমরা সেখানে জানিয়েছি৷ তবে জলদস্যুদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করা যায়নি৷'' তিনি বলেন, ‘‘ইতোমধ্যে রিপোর্টিং সেন্টার ইন কুয়ালালামপুর, ইন্ডিয়ান ফিউশন সেন্টার ইন নিউ দিল্লি, তারপর সিঙ্গাপুর, ইউএসএ, ইউকে, চায়নাসহ সকল এরিয়াল নেভাল শিপে আমরা রিপোর্ট করেছি৷ অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমেও আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি৷ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে৷ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অত্যন্ত কনসার্ন৷ বিষয়টি মন্ত্রিসভায়ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছে৷’’

‘সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করছি'

কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বুধবার বিকেলে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আজ সকালেও নাবিকেরা আমাদের বার্তা পাঠিয়েছেন যে, তারা ভালো আছেন৷ আমরা দেখেছি, জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ সকাল পর্যন্ত ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল৷ এখন পর্যন্ত হয়ত, আরও এগিয়েছে তারা৷’’

আমরা থার্ড পার্টির মাধ্যমে চেষ্টা করছি: হাছান মাহমুদ

কোনো ধরনের মুক্তিপণ কি তারা দাবি করেছে? জানতে চাইলে জনাব ইসলাম বলেন, ‘‘জলদস্যুদের একটা কৌশল হলো, তারা নিরাপদে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করে না৷ এখনও যেহেতু তারা তাদের আস্তানায় পৌঁছতে পারেনি, ফলে কোনো যোগাযোগও করেনি৷ আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করছি৷ নাবিক ও ক্রুদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে আমাদের যা করণীয় আমরা সেটা করব৷'' 

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সভা

বুধবার দুপুরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক যৌথ সভায় সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজের ২৩ নাবিকের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন সুস্থভাবে তাদের ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা করার জন্য৷ আমরা কাজ করছি৷ তবে নির্দিষ্ট করে সময় বলা যাচ্ছে না৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌবাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সব পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তৎপরতা চালানো হচ্ছে৷ আমাদের প্রথম গুরুত্ব হলো যারা নাবিক আছেন, এবং সঙ্গে অন্য কেউ থাকলে তাদের জীবন নিরাপদ রাখা৷ নাবিকদের রক্ষা করা, উদ্ধার করা৷’’

নাবিকদের মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে কতদিন লাগতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘যে-কোনো মূল্যে নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে আমরা বদ্ধপরিকর৷ জলদস্যুদের সঙ্গে থেকে কখন তারা মুক্তি পাবে সেটা বলা মুশকিল৷ আমরা কাজ করছি৷ তবে নির্দিষ্ট করে সময় বলা যাচ্ছে না৷’’

জিম্মি আছেন যারা

জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া নাবিকদের মধ্যে সাতজন বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ক্যাডেট৷ তারা হলেন, মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ (৫৮), চিফ অফিসার মো. আতিকুল্লাহ খান (৩৯), সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী (৩৬), থার্ড অফিসার মো. তরিকুল ইসলাম (২৯), ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসাইন (৩৪), চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান (৪৫) ও ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান (২৩)৷ এ ছাড়া জাহাজে অন্য জিম্মিরা হলেন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম (৩৮), থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিন (৩৩), চতুর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ (৩০), ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ (৩৫), নাবিক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক (২৯), নাবিক আসিফুর রহমান (২৫), নাবিক মো. সাজ্জাদ হোসাইন (২৯), নাবিক মাহামুদ জয় (২৪), নাবিক মো. নাজমুল হক (২৩), অয়েলার আইনুল হক (৩০), অয়েলার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন (৩১), অয়েলার মো. আলী হোসাইন (২৬), ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসাইন শাকিল (৩৪), চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম (৩৪), জেনারেল স্টুয়ার্ড মোহাম্মদ নুর উদ্দিন (২৮) ও ফিল্টার মোহাম্মদ ছালে আহমেদ (৪৭)৷  

প্রথমে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফোনে জিম্মি করার কথা জানায়: জোৎস্না বেগম

‘আমার ছেলে যেন সুস্থভাবে ফিরে আসে'

চরম উৎকন্ঠায় আছেন ২৩ নাবিকের পরিবার৷ ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কখন যোগাযোগ হয়েছে জানতে চাইলে চতুর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জোৎস্না বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথমে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফোন করে জানায়, তাদের জাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যুরা জিম্মি করেছে৷ তাদের জাহাজের ব্রিজের ওখানে রেখেছে৷ এরপর রাত ১১টার দিকে ম্যাসেজ দিয়েছে৷ সেখানে বলেছে, তাদের জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ জাহাজে পানি কম আছে৷ আবার দস্যুরা উঠেছে ৫০-৬০ জনের মতো৷ ফলে পানির সংকট হতে পারে৷ প্রথমে জানিয়েছিল, তারা রোজা আছে, কিন্তু কিছু খায়নি৷ পরে জানিয়েছে, দস্যুরা বিরানি রান্না করে তাদের দিয়েছে৷ এখন আর আমরা কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারছি না৷ আজ ওদের অফিসে গিয়েছিলাম৷ তারা বলেছে, যে-কোনো মূল্যে আমার সন্তানসহ জিম্মি সবাইকে ফিরিয়ে আনবে৷ ফোন করে কেউ কান্নাকাটি করলে আমরা যেন ভয় না পাই সেটাও তারা আমাদের বলেছে৷ আমি চাই, যে-কোনো মূল্যে আমার ছেলে যেন সুস্থভাবে ফিরে আসে৷''

যেভাবে জাহাজে আক্রমণ করে দস্যুরা

জাহাজে থাকা এক নাবিক প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠায়৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, জাহাজটিকে আক্রমণ করে শতাধিক জলদস্যু৷ তারা প্রত্যেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ছিল৷ প্রথমে একটি স্পিডবোট দৃশ্যমান হলেও পরে বিভিন্ন দিক থেকে এসে হামলা চালায় একাধিক স্পিডবোট৷ আক্রমণের ১৫ মিনিট আগে বিষয়টি টের পান নাবিকরা৷ সঙ্গে সঙ্গে তারা বিষয়টি মালিকপক্ষকে জানান৷ পরে ১৫ মিনিটের মধ্যে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়৷ ভারী অস্ত্র তাক করে মই বেয়ে জাহাজে উঠে যায় তারা৷ এরপর চিফ মাস্টার ও ইঞ্জিনিয়ারসহ সব নাবিক ও ক্রুকে একে একে জিম্মি করে৷ এরপর জাহাজটি সোমালি উপকূলের দিকে নিয়ে যেতে থাকে তারা৷ জাহাজে উঠেই সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়৷

আগেও দস্যুদের কবলে পড়েছে বাংলাদেশি জাহাজ

এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরব সাগরে সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল কেএসআরএম গ্রুপের আরেক জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি'৷ ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রেখেছিল জলদস্যুরা৷ সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ এসব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়৷ ১৫ মার্চ অক্ষত অবস্থায় তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন৷ তবে বড় অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়েই তাদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছিল মালিকপক্ষকে৷

নাবিকেরা আমাদের বার্তা পাঠিয়েছেন যে, তারা ভালো আছেন: মিজানুল ইসলাম

ভারতীয় নাবিক উদ্ধার

গত ৫ জানুয়ারি ভারতের একটি বাণিজ্যিক জাহাজ অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে দস্যুরা৷ নাবিকসহ ওই জাহাজে ১৫ ভারতীয় নাবিক ও ক্রু ছিলেন৷ তাদের উদ্ধার করতে যায় ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ আইএনএস চেন্নাই৷ অভিযানে অংশ নেয় ভারতের সবচেয়ে চৌকস নৌ কমান্ডো বাহিনী মার্কোস৷ আকাশপথে নজরদারি চালায় নৌসেনার বিমানও৷ ‘এমভি লীলা নরফোক' নামে ভারতের ওই বাণিজ্যিক জাহাজটি লাইবেরিয়া থেকে যাওয়ার পথে জলদস্যুদের কবলে পড়ে৷

মূলত আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যে নিয়োজিত জাহাজকে টার্গেট করে জলদুস্যরা৷ মাঝে কিছু বছর তাদের উপদ্রব কমলেও গত কয়েক মাসে ফের তৎপর হয়ে উঠেছে জলদস্যুরা৷