সময়মতো মজুরি চান পাটকল শ্রমিকরা
১১ মে ২০১৯বাংলাদেশ জুটমিল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) ২৭টি জুটমিলের প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিকের ১৪ সপ্তাহের অর্থাৎ সাড়ে তিন মাসের বেতন বকেয়া পড়ে আছে৷ সেই সাথে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন বকেয়া আছে চার মাসের৷ বকেয়া মজুরির দাবিতে শ্রমিকরা আগেও কয়েক দফা আন্দোলন করেছিলেন৷ কিন্তু বকেয়া বেতন পাননি তারা৷ তাই ২ মে থেকে জুটমিলগুলোতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ও সড়ক-মহাসড়ক অবরোধের কর্মসূচি পালন করছেন শ্রমিকরা৷
এ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে ঢাকা ও খুলনার জুটমিলগুলোতে৷ জরুরি উৎপাদন বজায় রাখতে চট্টগ্রামের পাটকল শ্রমিকদেরকে দু'সপ্তাহের বকেয়া মজুরি প্রদান করে কারখানা সচল রাখা হয়েছে৷ চট্টগাম অঞ্চলে মোট পাটকল রয়েছে ১১টি মিল৷ সোমবার থেকে চট্টগ্রাম এলাকার জুটমিলগুলোর শ্রমিকরা ধর্মঘটে যোগ দেবেন বলে জানা গেছে৷
শ্রমিকদের ৯ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম হলো বকেয়া মজুরি পরিশোধ, জাতীয় মজুরি কমিশন-২০১৫-এর রোয়েদাদ বাস্তবায়ন, পাটক্রয়ে অর্থবরাদ্দ, অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী করা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বকেয়া পরিশোধ, শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহে মজুরি৷
রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল শ্রমিক (সিবিএ নন-সিবিএ) ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রত্যেকটি পাটকলেই মজুরি বকেয়া আছে৷ গড়ে ১৪ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া আছে৷ আর ২০১৫ সালের নতুন মজুরি সবখানে বাস্তবায়ন হলেও আমরা এখনো পাইনি৷''
তিনি জানান, ‘‘রোজার ঈদের বোনাসসহ শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি, বেতন ভাতা বাবদ প্রায় দু'শ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে৷ এটা আমরা ঈদের আগেই চাই৷ আমাদের দাবি না পর্যন্ত আমাদের এই কর্মসূচি চলবে৷''
খুলনা প্লাটিনাম জুটমিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগেও মোট তিনবার বিজেএমসি ও মন্ত্রণালয় লিখিত চুক্তি করে বকেয়া মজুরি দেয়ার কথা বলেছে৷ বেতন প্রদানের সর্বশেষ তারিখ ছিল ২৫ এপ্রিল৷ সেই তারিখেও দেয়া হয়নি বেতন৷ এরপরও আমারা ধর্মঘটে যেতে চাইনি৷ কিন্তু আমাদের শ্রমিকরা না খেয়ে কাজ করতে পারছেনা৷ স্টার জুটমিলে একজন শ্রমিক না খাওয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ফলে আমরা ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হই৷''
এদিকে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে সরকারের কাছে প্রায় সাড়ে ৩শ' কোটি টাকা চেয়েছে বিজিএমসি৷ নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর করতে আরো টাকা লাগবে বলে জানিয়েছে তারা৷
বিজেএমসি'র চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জুন পর্যন্ত বকেয়া ও পাওনা মেটাতে সরকারের কাছে ৩শ' ৩৮ কোটি টাকা চেয়েছি৷আশা করছি চলতি সপ্তাহের মধ্যে ভর্তুকির টাকা পেয়ে যাবো৷ ভর্তুকি'র টাকা পেলেইে তাদের বকেয়া মজুরি শোধ করে দেব৷ এটা তাদের জানানো হয়েছে৷ এরপরও তারা কারখানা বন্ধ করে, উৎপাদন বন্ধ করে যে ধর্মঘট করছে তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘উৎপাদন বন্ধ থাকায় এখন প্রতিদিন আমরাদেড়-দুই কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়ছি৷ এখন সিরিয়ার অর্ডার ছাড়াও বাংলাদেশ বিমান, খাদ্য বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর চাহিদা অনুযায়ী ব্যাগ সরবরাহ করতে পারছি না৷ চট্টগ্রাম এলাকার মিলগুলো আমরা চালু রাখতে সক্ষম হলেও খুলনা ও ঢাকার মিলগুলো বন্ধ রয়েছে৷''
নতুন স্কেল অনুযায়ী বেতন ভাতা বাড়ানোর দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়েও আমরা সরকারের সাথে বসছি৷ নতুন স্কেল অনুযায়ী তাদের বেতন দ্বিগুন হবে৷ এটা কিভাবে ম্যানেজ করা যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি৷''
সারাদেশে বিজেএমসি'র মালিকিনিধীন মোট ২৭টি জুটমিল রয়েছে৷ মিলগুলোতে মোট শ্রমিক প্রায় ৮০ হাজার৷ বাকিরা মাস্টার রোলে দেনিক মজুরি ভিতিতে কাজ করেন৷
পাটকলগুলোতে শ্রমিকদের বেতন দেয়া হয় সপ্তাহ ভিত্তিতে৷ তবে শ্রমিকরা মাসে গড়ে ১৮ হাজার টাকা মজুরি পান৷ পাটকলগুলোলো অব্যাহত লোকসানের মুখে রয়েছে৷ এ লোকসানের জন্য শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন৷
শ্রমিক নেতা খলিলুর রহমান বলেন,‘‘পাটের অভাবে কলগুলো উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ ভাগ উৎপাদন করতে পারে৷ আর পুরনো যন্ত্রপাতি মেরামত ও আধুনিকায়ন না করায় উৎপাদন ব্যাহত হয়৷ যদি কলগুলোকে আধুনিকায়ন করা হতো তাহলে উৎপাদন বেড়ানো যেত৷''
সিবিএ নেতা শাহানা শারমিন বলেন,‘‘পাটকলগুলোতে লোকসানের মূল কারণ হলো সঠিক সময়ে পাট না কেনা৷ জুন মাসে পাটের দাম সবচেয়ে কম থাকে, তখন পাট কেনা হয়না৷ আর যখন পাট কেনা হয় তখন পাটের দাম অনেক বেশি থাকে৷''
আধুনিকায়ন না করায় এখনো পাটকলগুলো মূলত চট ও চটের ব্যাগ উৎপাদন করে থাকে৷ যে কারণে, বিশ্ববাজরে আধৃনিক পাটজাত পন্যের যে চাহিদা, তা পূরণ করতে পারছে না এই কলগুলো৷
খুলনার খালিশপুর জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজার মোস্তফা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘আমরা কিছু নতুন ধরনের পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করছি৷ এর মধ্যে রয়েছে পরিবেশবান্ধব সোনালী ব্যাগ ও পাট পাতার পানীয়৷ তবে কারখানাগুলো মূলত চট আর ব্যাগই বেশি উৎপাদন করে থাকে৷ আর এই ধর্মঘটের কারণে যেটুকু উৎপদন হতো তাও বন্ধ৷ প্রতিদিন আমার মিলে ২০-২৫ লাখ টাকার উৎপাদন ক্ষতি হচ্ছে৷''
বিজেএমসি চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম দাবি করেন, ‘‘যত ভর্তুকির কথা শোনা যায় আসলে অত ভতুর্কি দিতে হয়না৷ আমরা এ পর্যন্ত তো বেতন ভাতা দিয়েই আসছিলাম৷ তবে কখনো বিক্রির টাকা পেতে দেরি হয়৷ পাট কিনতে হয়৷ এ কারণে সংকট তৈরি হয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘জুটমিলগুলোকে লাভজনক করা সম্ভব৷ এজন্য আমাদের পরিকল্পনা আছে৷ পাট দিয়ে বৈচিত্রময় পন্য উৎপাদনের পরিকল্পনা করছি আমরা৷ এজন্য আমাদের সময় দিতে হবে৷ শ্রমিকরা শ্রম আইনের বাইরে গিয়ে এভাবে ধর্মঘট করলেতো সম্ভব নয়৷''