1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লিঙ্গীয় সমতা বনাম নারী-বিদ্বেষ

জোবাইদা নাসরীন
২৫ জুন ২০২১

শুধুমাত্র শ্রম বাজারেই নারীর নজরকাড়া অংশগ্রহণই নয়, বাংলাদেশে নারীরা প্রশাসনের  বিভিন্ন পদসহ সরকারি বিভিন্ন বাহিনীতে তাদের যোগ্যতা এবং কর্মদক্ষতা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে৷

https://p.dw.com/p/3vYqS
‘সমাজে নারীকে ঘৃণা করার যে রাজনীতি, সেটি আমরা নানাভাবে দেখতে পাই’
‘সমাজে নারীকে ঘৃণা করার যে রাজনীতি, সেটি আমরা নানাভাবে দেখতে পাই’ছবি: bdnews24.com

এবং নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গীয় সমতা উন্নয়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ যখন অন্য দেশের জন্য উদাহরণ হিসেবে কাজ করছে, ঠিক তখনই কিছু কিছু সুপারিশ, সিদ্ধান্তে বেশ অবাক হতে হয়৷ নিশ্চিতভাবেই এটি আনেক বেশি বিস্ময়ের এবং একই সাথে ক্ষোভেরও৷ যারা নীতি নির্ধারক, তারাই করেছেন এই সুপারিশ৷

বিষয়টি হলো; বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার' দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের না রাখার জন্য সুপারিশ করে খোদ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি৷ যার পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সচিবালয় থেকে প্রেরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, "বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার' প্রদানের ক্ষেত্রে দিনের বেলায় আয়োজন করা এবং মহিলা ইউএনওর বিকল্প ব্যক্তি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়৷”

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করে স্থানীয় জেলা অথবা উপজেলা প্রশাসন৷ নিয়মানুযায়ী  জেলার ডিসি বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে থাকেন৷ এই চর্চিত নিয়মের অংশ হিসেবে মৃত ব্যক্তির কফিনে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান৷ এই গার্ড অব অনারে সেই প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তার লিঙ্গীয় পরিচয়কেই নিয়েই এই বৈষম্যগত ভাবনা৷ এ বিষয়ে নানা মহল থেকে সমালোচনা এবং তর্ক -বিতর্ক উত্থাপিত হলে এবং সংসদীয় কমিটির এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতার ফলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক অবশ্য সংসদীয় কমিটিতে আসা এ ধরনের প্রস্তাবকে এ মুহূর্তে গুরুত্ব দিতে রাজি নন বলে আমরা গণমাধ্যমসূত্রে জেনেছি৷

এই ধরনের সুপারিশ সংবিধানের যে লিঙ্গীয় সমতার অঙ্গীকার আছে তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা আছে৷ সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে একেবারে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে৷' ২৯(২) অনুচ্ছেদে আরো বিবৃত আছে, ‘‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না, কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না৷'' সাংসদের কাজই হলো সংবিধান অনুসরণ করা এবং কোনো ধরনের বৈষম্যকে আস্কারা না দিয়ে যদি কোথাও সেই ধরনের ঘটনা ঘটার পূর্বাভাসও থাকে তাহলে সেটির প্রয়োজনীয় সংশোধন করা৷ এখানে আরো মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত এবং সুপারিশ বাংলাদেশের জাতীয় নারী নীতি ২০১১-এর বিপরীতে অবস্থান ঘোষণা করে৷

শুধুমাত্র সংবিধানেই নয়, আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, যে বৈষম্যের প্রতিবাদে এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং সমতা নিশ্চিত করাই পঞ্চাশ বয়সি বাংলাদেশের মূল স্বপ্ন হওয়ার কথা৷ কিন্তু ঘটছে উল্টোটা৷ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হতে পারে কেন সাংসদরা সংবিধানের এই সমতার ধারাকে উপেক্ষা করছেন?

এত কিছুকে অগ্রাহ্য করে কেন এই ধরনের ঘটনা বারবার হচ্ছে? এটি যে শুধু এবারই হয়েছে তা নয়৷ কয়েক মাস আগেও একই কারণ হাজির করে নারীদের কাজী হওয়ার বিষয়ে বিতর্ক তোলা হয়েছিল৷ এর মূলে আসলে যে বিষয়টি কাজ করছে, সেটি হলো মিসেজিনি ( নারী বিদ্বেষ)৷ অর্থাৎ, নারীর প্রতি আমাদের জারি থাকা বিদ্বেষ আমরা নানাভাবে হাজির করি৷ বর্তমানে এর প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ধর্ম৷ ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা তৈরি করে নারীকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ এটি যে নারী-বিদ্বেষী মনোভাবেরই কাজ তা আরো খোলাসা হয়ে ওঠে যখন আমরা সকলেই স্পষ্টভাবে জানি যে, গার্ড অব অনার কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়, এবং এটি জানাজার অংশও নয়৷ এটি রাষ্ট্রের বীর সন্তানদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানানোর একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ামাত্র৷ সেখানে লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য করার সুযোগ কোনোভাবেই নেই৷

আরো মনোযোগ দিয়ে যদি বিষয়গুলোকে বিশ্লষণ করি তাহলে আরো কিছু বিষয় হাজির হয়, যেগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে জোরালোভাবেই যুক্ত৷ একদিকে ধর্ষনসহ সকল নারী নিপীড়নের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনেকটা প্রশ্নহীনভাবেই হাজির থাকছে ভিকটিম ব্লেমিং, অন্যদিকে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়া এবং রাখার প্রস্তাব আনা হচ্ছে৷ আপাতভাবে মনে হবে এগুলো আলাদা আলাদা জায়গা থেকেই হচ্ছে৷ কিন্তু বিষয়গুলো একই মতাদর্শিক জায়গা থেকেই উৎপাদিত হচ্ছে৷

জোবাইদা নাসরীন, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জোবাইদা নাসরীন, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: Zobaida Nasreen

কীভাবে? নারী গার্ড অব আনারে থাকতে পারবে না, নারী কাজী হতে পারবে না, নারী রাতে বের হতে পারবে না৷ নারী অমুক-তমুক জায়গায় গেল কেন? এসবের জবাব আপনি কার কাছ থেকে চাইছেন? কারণ, আমরা জেনে গেছি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের দাপুটে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শিক অবস্থান থেকেই আপনি পশ্নগুলো করছেন এবং এর উত্তরও সেই মতাদর্শ থেকেই আসছে৷ আর মনে করবেন না নারী মানেই পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে কথা বলবে৷ নারীদের স্বরেও ভর করে একই মতাদর্শের বুলি৷

আপনি যখন অপরাধীকে প্রশ্ন না করে অপরাধের শিকার নারীকে নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তার মানে হলো– আপনি এই বিষয়টিই প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন যে, বাংলাদেশে এখন এই অবস্থা যে যেখানে-সেখানে যখন-তখন একজন নারী ধর্ষণের শিকার হতে পারেন৷ আর সেই ধর্ষক আপনিও হতে পারেন৷ ঠিক একইভাবে আপনি যথন নারী-বিদ্বেষী অবস্থান থেকে নারীর শরীরীয় ‘পবিত্র' ‘অপবিত্র' নিয়ে প্রশ্ন তুলে নারীকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনায় থাকেন, তখন স্পষ্টতই বোঝা যায যে আপনি আদতে নারী-বিদ্বেষী মানুষই নন, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে থেকেও আপনি নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শনে ভূমিকা রাখছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷

ছোটবেলায় পড়া ‘বীরপুরুষ' কবিতার মতো করে মা'কে রক্ষা করার অঙ্গীকার ‘দামাল' ছেলেদের নিয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, কিন্তু সেই মা রূপী স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও সেই বীরাঙ্গনা মায়েদের সামাজিকভাবে ‘পবিত্র', ‘অপবিত্রতা'র দোহাই তুলে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল এবং তাঁরা নানা হেনস্থার শিকার হয়েছেন৷ খুবই মজার বিষয়, সমাজ এবং সংস্কৃতি ভেদে মা এবং বোন সন্মানিত হলেও নারী সত্তার সাথে এই চরিত্রগুলো এক কল্পিত সংঘর্ষ তৈরি করে, যার কারণে সমাজে মা আদৃত এবং সম্মানিত হলেও নারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং ঘৃণা ভীষণভাবে জারি থাকে৷ অর্থাৎ, সমাজে নারীকে ঘৃণা করার যে রাজনীতি, সেটি আমরা নানাভাবে দেখতে পাই৷ বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারীকে হেয় করে নানা ধরনের কৌতুক, মিম এবং এর পাশাপাশি নারীকে হেয় করা ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে অনেকটাই প্রশ্নহীনভাবে নারীর প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের কৌতুক বা মিম লোকজন ‘ফান' বা ‘মজা' হিসেবেই দেখে এবং ‘হা হা' রিঅ্যাক্ট দিয়ে শেয়ার করতে থাকে৷ এ বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন করাকে ‘আপনার কি কোনো সেন্স অব হিউমার নেই' জাতীয় কথাবার্তা বলে থামিয়ে দেওয়া হয়৷

অন্যদিকে সমাজে আদৃত সম্পর্কগুলোর মধ্যে মা এবং বোন নিয়ে ‘ডি সেক্সুয়ালাইজড একটা মিথ আছে, যার কারণে রাস্তাঘাটে একজন আপনার গায়ে হাত দিলে আপনি কঠোরভাবে প্রতিবাদ করতে গেলে, ‘হঠাৎ করে শুনতে পাবেন, ‘আমাদের তো মা -বোন আছে' জাতীয় বাণী৷কিন্তু নারীর প্রতি জারি থাকা বিদ্বেষ এতটাই প্রকট যে, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, সন্মান, অনেকটাই তাৎক্ষণিক বিষয় মনে হয়, কারণ যখন খোদ সংসদ থেকেই তো নারীর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শনের বিভিন্ন তরিকা বিভিন্ন সাজে হাজির করা হয়৷ কখনো ধর্মের মোড়কে, কখনো সংস্কৃতির মোড়কে, কিংবা কখনো কখনো নিরাপত্তার খোলসে৷