1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

খান সাহেবদের কানা নীতি

২৫ জুন ২০২১

কোথাও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নারী হলে সেক্ষেত্রে তার পরিবর্তে পুরুষ কর্মকর্তা দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেয়ার সুপারিশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি৷

https://p.dw.com/p/3vYnv
‘সরকারি ও প্রশাসনিক পর্যায়ে নারীদের অবনমন করার এই মানসিকতা নতুন কিছু নয়৷’
‘সরকারি ও প্রশাসনিক পর্যায়ে নারীদের অবনমন করার এই মানসিকতা নতুন কিছু নয়৷’ছবি: bdnews24.com

কোথাও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নারী হলে সেক্ষেত্রে তার পরিবর্তে পুরুষ কর্মকর্তা দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেয়ার সুপারিশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি৷ ধর্মীয় অজুহাত দেখিয়ে গত ১৩ জুন সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে এই সুপারিশ করা হয়৷ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে সুপারিশটি আর আলোর মুখ দেখেনি৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলভিত্তি সাম্যবাদের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এমন সুপারিশে অনেকেই বিস্মিত ও হতবাক হয়েছেন৷ কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন সুপারিশে অবাক হওয়ার মতো কি বিশেষ কিছু আছে? কারণ সরকারি ও প্রশাসনিক পর্যায়ে নারীদের অবনমন করার এই মানসিকতা নতুন কিছু নয়৷

প্রসঙ্গটিকে সহজেই অনুধাবনযোগ্য করার জন্য দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়৷ যে সংসদীয় কমিটি সুপারিশটি করেছে তার সভাপতি হলেন শাজাহান খান৷ নারীদের খাটো করে দেখার অভিব্যক্তি তার কাছ থেকে এই প্রথম নয়৷ ২০১৬ সালে তিনি যখন নৌপরিবহনমন্ত্রী ছিলেন তখন নারী লাঞ্ছনাকারীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ মিলনায়তনে আয়োজিত ‘সংগ্রামী নারী সংবর্ধনা' অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘পয়লা বৈশাখ আমাদের বাঙালি জাতির জীবনে বছরের প্রথম দিন৷ এই পয়লা বৈশাখে অনেক মানুষ রাস্তায় থাকে৷ এই কোটি কোটি মানুষের দেশে ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষ থাকে৷ তার মধ্যে এমন কী ঘটনা ঘটেছে, যা সংবাদ হওয়ার মতো? একটা টুকিটাকি ঘটনা হতেই পারে৷ এতগুলো মানুষের মধ্যে এটা তেমন কোনো বিষয়ই না' ( প্রথম আলো, ৯ মার্চ ২০১৬)৷

২০২০ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছিলেন, সামাজিক ও শারীরিক বাস্তবতায় ধর্মীয় কারণে নারীরা নিকাহ্ রেজিস্ট্রার বা কাজি হতে পারবেন না চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত রায়ের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীরা মাসের একটি নির্দিষ্ট সময় ‘ফিজিক্যাল ডিসকোয়ালিফেশনে' থাকেন৷ সেক্ষেত্রে মুসলিম বিবাহ হচ্ছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আমাদের দেশে বেশিরভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে৷ ওই সময়ে নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না এবং তারা নামাজও পড়তে পারেন না৷ সুতরাং বিয়ে যেহেতু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেহেতু এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নারীদের দিয়ে নিকাহ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন সম্ভব না৷

এভাবে কখনও শারীরিক অক্ষমতা আবার কখনও ধর্মীয় অজুহাতের দোহাই দিয়ে পদে পদে নারীকে আটকে রাখতে চাই৷ কখনও বলছি, নারী ম্যারেজ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না, কখনও বলছি নারী ইউএনও গার্ড অব অনার দিতে পারবে না৷ শরৎচন্দ্র যথার্থই বলেছিলেন, "যে ধর্ম বুনিয়াদ গড়িয়াছে আদিম জননী ইভের পাপের উপর, যে ধর্ম সংসারের সমস্ত অধঃপতনের মূলে নারীকে বসাইয়া দিয়াছে, সে ধর্ম সত্য বলিয়া যে-কেহ অন্তরের মধ্যে বিশ্বাস করিয়াছে, তাহার সাধ্য নয় নারীজাতিকে শ্রদ্ধার চোখে দ্যাখে৷” সমস্যাটি মূলে আছে তাই এই দেখার বা দৃষ্টিভঙ্গির৷ নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে বড় অন্তরায় হলো দৃষ্টিভঙ্গির৷ ধর্মীয় অনুশাসনের দোহাই দিয়ে সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আসা সরকারি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলোকে জায়েজ করা হয়৷ সমাজপতিসহ সমাজের বেশিরভাগ পুরুষের এই দৃষ্টিভঙ্গি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, "দেখ, স্ত্রীপুরুষে যেরূপ স্বভাবগত বৈষম্য, ইংরেজ বাঙ্গালিতেও সেইরূপ৷ ইংরজে বলবান, বাঙ্গালি দুর্ব্বল; ইংরেজ সাহসী, বাঙ্গালি ভিরু; ইংরেজ ক্লেশসহিষ্ণু, বাঙ্গালি কোমল; ইত্যাদি ইত্যাদি৷ যদি এই সকল প্রকৃতিগত বৈষম্য হেতু অধিকার বৈষম্য ন্যায্য হইত, তবে আমরা ইংরেজ বাঙ্গালি মধ্যে সামান্য অধিকার বৈষম্য দেখিয়া এত চীৎকার করি কেন? যদি স্ত্রী দাসী, পুরুষ প্রভু, ইহাই বিচারসঙ্গত হয়, তবে বাঙ্গালি দাস, ইংরেজ প্রভু এটিও বিচারসঙ্গত হইবে৷”

একথা সত্যি যে, সরকারি, বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে গত এক দশকে বাংলাদেশে নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বেশ সাফল্য এসেছে৷ তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে৷ এ রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৪৮তম৷ নারী উন্নয়ন সূচকে অবস্থান পঞ্চম৷ কিন্তু মুদ্রার আরেক পিঠে নারীকে আমরা তেঁতুলের সাথে তুলনা করতে দেখি৷ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সমতার কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ অথচ সংবিধান প্রণেতাদের মুখে আমরা শুনছি নারীদের অক্ষমতার কথা, নারী-পুরুষের অসমতাকে প্রাধ্যান্য দেয়ার যুক্তি৷ প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতায় আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ৷ দলটির সংবিধানের ১০ ও ২৮ অনুচ্ছেদে ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ' এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকে মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ অথচ দলটিরই একজন সাংসদ যখন নীতি-নির্ধারণী স্তরে ধর্মীয় অজুহাতে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতির সুপারিশ করেন তখন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা বোঝার জন্য বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না৷

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: bdnews24.com

একটি জাতি বা রাষ্ট্র কতটুকু সভ্য তার অনেকগুলো নির্ণায়ক আছে৷ তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হলো শিশু ও নারীর প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ এবং ‍তাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের দৃষ্টিভঙ্গি৷ প্রতি বছর ৮ মার্চ নারীদের অধিকার নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় উঠে, পোশাকের দোকানে ছাড়ের উৎসব চলে আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মায়াভরা বিজ্ঞাপনে টিভি-পত্রিকা ভরে যায়৷ কিন্তু অর্থ বা পোশাক কিংবা বাহারি পণ্য সভ্যতার সূচক হতে পারে না৷ সভ্যতা কতটুকু এগিয়েছে, একটি রাষ্ট্র বা জাতি কতটুকু মানসিকভাবে শক্তিশালী তার জন্য দরকার সমাজের মানসপটের দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা ও স্পষ্টতা৷ জাতীয় সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের চেতনা যদি না ছড়ায় তাহলে অর্জনগুলো সাময়িক থেকে যাবে৷ তাই বঙ্কিম যুগেও সমাজে নারীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতেন দেড়শ বছর পরেও সেই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং অধিকারহীনতা কমেনি৷ সময়ের ব্যবধানে সমস্যাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা এখনও বিদ্যমান৷ দৃষ্টভঙ্গিগত সমস্যার কারণে এখনও কোথাও কোথাও নারীশিশুর জন্ম এক আতঙ্কের নাম৷ এ সমস্যার কারণে নারীকে এখনও আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়৷ বলা হয়, নারী এটা পারবে না, ওটা পারবে না৷ সীমারেখা টানার চেষ্টা করা হয় নারীর গতিবিধির ওপর৷  

উন্নয়নসহ সর্বস্তরের কর্মকাণ্ডে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ এবং সমঅধিকার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়ন যে সম্ভব নয় তা এখন স্বতঃসিদ্ধ৷ কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজে নারীর অবস্থানের টেকসই পরিবর্তনের জন্য সরকার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারক আর প্রভাবশালীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে৷ নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রতি আমাদের নীতিনির্ধাকরা যতদিন সংবেদনশীল হয়ে না উঠবেন ততদিন নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি অস্পষ্টই থেকে যাবে৷ কারণ শকট বা গাড়ির চালক তো তারা৷ বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ”যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে৷” সমাজের নীতিনির্ধারক খান সাহেবরা যদি শকটের চাকার ভারসাম্যতার গুরুত্ব না বুঝেন, একচক্ষুবিশিষ্ট কানা লোকের মত আচরণ করেন কিংবা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন না ঘটে তাহলে শরৎচন্দ্রের মত আক্ষেপের সুরে বলতে হবে, যেদিন নারী হয়ে যাবে দুর্লভ, সেদিনই সমাজ অনুধাবন করতে পারবে নারীর যথার্থ মূল্য৷