1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মানুষের সামান্য কষ্টটা রাষ্ট্রের জন্য বড় বিনিয়োগ'

সমীর কুমার দে ঢাকা
১২ আগস্ট ২০২২

বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷ হঠাৎ করেই এই মূল্য বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ কী বলছে৷ কোন পরিকল্পনা থেকে এটা বাড়ানো হল? কিভাবে মানুষ এটা সামলাবে?

https://p.dw.com/p/4FT0T
ছবি: Yegor Aleyev/TASS/dpa/picture alliance

এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে  কথা বলেছেন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ৷

ডয়চে ভেলে : গত আট বছরে বিপিসি লাভ করেছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা৷ তার একটা বড় অংশ তো স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখেছে৷ সেই টাকা ভর্তুকি দিয়ে কী এখন জনগণকে স্বস্তি দেওয়া যেত না?

ড. সেলিম মাহমুদ : এই তথ্যটা পুরোটাই ভুল৷ ভুল এই জন্য যে, বিপিসি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হলেও বাণিজ্যিক সংস্থা৷ তার নিজস্ব একটা ব্যালান্স শিট আছে, অর্থাৎ তার আয় ব্যয় প্রকল্প সবকিছুই ব্যালান্স শিটের মধ্যে আছে৷ পৃথিবীর কোথাও ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি সেক্টর চলে না৷ আমরা এক সময় ভর্তুকি দিয়ে চালাতাম, তখন সম্ভব ছিল৷ তখন ইকোনমির সাইজও ছোট ছিল, জ্বালানি সেক্টরের সাইজও ছোট ছিল৷ ২০০৯ সাল থেকে এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে৷ ব্যাপক মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয়েছে৷ সরকারিভাবে এই জনপদে ১৯১০ সাল থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১০০ বছরে ৪৭ ভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানো গেছে৷ আর শেখ হাসিনার সরকার মাত্র ১৩ বছরে বাকী ৫৩ ভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে৷ আর এই কাজটা করতে গিয়ে আর্থিক, প্রশাসনিক, অবকাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তন করতে হয়েছে৷ বিদ্যুৎ তো শুধু বিদ্যুৎ না, এর পেছনে জ্বালানি, অবকাঠামো আরও অনেক কিছু৷ এত বড় সেক্টরকে এখন আর আপনি ভর্তুকি দিয়ে চালাতে পারবেন না৷ ভর্তুকি নির্ভর করে একটি রাষ্ট্রের সক্ষমতার উপরে৷ ক্যানাডা, অষ্ট্রেলিয়াসহ অনেক উন্নত রাষ্ট্র যেখানে জনসংখ্যা আমাদের চেয়ে কম আর তাদের সক্ষমতা অনেক বেশি৷ তারাও কিন্তু ভর্তুকি দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না৷ ডিজেলে আমরা যে দামটা বাড়ালাম সেটা কিন্তু আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সমান হল৷ এটা কিন্তু একটা বেঞ্চমার্ক ধরেই করা হয়েছে৷

বিদেশ থেকে তেল আমদানি পর্যায়ে ৩৪ শতাংশ এবং পরে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা মিলে আরো ১৭ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হয়৷ ফলে তেলের মূল্য আর শুল্ক প্রায় সমান হয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে শুল্কে ছাড় দিয়ে কী দামের সমন্বয় করা যেত না?

আমাদের তো পৃথিবীর বেস্ট প্র্যাকটিসটা মেনে চলতে হবে৷ পৃথিবীর কোন দেশ সেটা বাদ দিচ্ছে না, অন্য কোন ব্যবস্থাও নিচ্ছে না তাহলে আমি কেন সেই ব্যবস্থা নেব৷ আমাকে তো একটা আন্তর্জাতিক সিস্টেমের মধ্যে চলতে হয়৷ ভারতসহ পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র কি এই ভ্যাট বা সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি বাদ দিয়েছে, না৷ এটা দেওয়া সম্ভব না৷ তাহলে রাষ্ট্র চলবে না৷ বিপিসি এক সময় ইসলামি ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তেল কিনেছে৷ দাতা সংস্থাগুলোও তেল কেনার জন্য ঋণ দিত৷ বিপিসি কিন্তু আলাদা এবং স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান৷ তাকে কিন্তু পুরানো ঋণ সমন্বয় করতে হয়৷ ২০১৪ সাল থেকে তেলের দাম কমেছে৷ কিন্তু তার আগে বিপিসির যে লস ছিল সেটা তো সমন্বয় করতে হয়েছে৷ ফলে কয়েকবছর পর বিপিসি এলো লাভে৷ বিপিসি যখন একটু স্বাভাবিক হতে শুরু করল এলো কোভিড এবং পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ৷ তখন আবার লস করতে শুরু করল৷ ভারতে কিন্তু মাসে স্বংয়ক্রিয়ভাবে সমন্বয় হয়৷ পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিদিন সমন্বয় হয়৷ আমরা আস্তে আস্তে সেদিকে যাচ্ছি৷ আমাদের যেতে হবে৷ যে কোন ভালো কাজে প্রথমে একটু অজনপ্রিয় হতে হয়৷ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি কিন্তু অজনপ্রিয় কাজ৷  

বিদেশ থেকে গুডওয়েল এনে দেশে পরিশোধন করলে দাম প্রতি লিটারে দুই থেকে ছয় টাকা কম পড়ে৷ ২০১২ সাল থেকে রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট করার চিন্তা করছে সরকার৷ কখনও নিজের টাকা, কখনও বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে৷ কিন্তু এখনও হয়নি৷ এটা করতে বাধা কোথায়?

এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে, একটা প্রকল্পও আছে৷ সরকার কিন্তু চেষ্টা করছে প্রাইভেট সেক্টরেও আরও দু'একটা বড় রিফাইনারি করার জন্য৷ এর বাইরেও আরও কয়েকটা বিষয় আছে৷ অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, আমি যখন বড় প্রোডাকশনে যাব তখন কস্ট অনেক কমে যাবে৷ সর্বশেষ গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, আমরা বড় রিফাইনারি না করে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন দিয়ে তেল আনি তাহলে আমাদের অনেক ইনভেস্টমেন্ট কস্ট কমে যায়৷ ইন্ডিয়া কিন্তু তেলের মার্কেটিংয়ের জন্য বিশ্বখ্যাত৷ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়ও পাইপলাইনের প্রজেক্টও আছে৷ সারা পৃথিবীতে এখন একটা অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু এই ঝুঁকির বাইরে নয়৷ তর্কের খাতিরে বলি, তেল থেকে এখন যে অতিরিক্ত অর্থ সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে, সেটা কার টাকা, জনগণের টাকা৷ জনগনকে স্বস্তি দেওয়ার জন্যই তো এই টাকা খরচ করা হবে৷ আমার কোষাগার যদি শক্তিশালী না হয়, তাহলে বিপদের দিনে আমি মানুষকে সাপোর্ট দেবো কিভাবে?

যে কোন ভালো কাজে প্রথমে একটু অজনপ্রিয় হতে হয়: ড. সেলিম মাহমুদ

বিপিসি ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছর থেকে লাভ করা শুরু করেছে৷ এর আগে তো সরকার ভর্তুকি দিয়ে আসছিল৷ এর মধ্যে তো বিপিসি আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছে এই ভর্তুকি নিয়ে৷ এখন কি সরকার বলেছে যে, আর বিপিসিকে ভর্তুকি দেবে না? 

আইন অনুযায়ী পৃথিবীর কোন দেশেই ভর্তুকি দেওয়ার কথা না৷ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তো প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজের মতো করে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে৷ আমাদের প্রতিমন্ত্রী কিন্তু ব্যালান্সশিটের একটা অংশ পড়ে শুনিয়েছেন৷ যদি মূল্য না বাড়ানো হতো, তাহলে যে ২২ হাজার কোটি টাকা আছে সেটা আগস্টের পরে কিন্তু শেষ হয়ে যেত৷ লাভ-ক্ষতি কোন ভালো অনুশীলন না৷ যেটা গুড প্র্যাকটিস সেটা হল টেকসই পদ্ধতি৷ পৃথিবীর অনেক দেশ জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতো৷ ভারতসহ সেই দেশগুলো কিন্তু সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছে৷

আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তো অনেক আগে থেকেই বলছে বিশ্ব বাজারের সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয় করতে৷ আপনারা কী এখন সেই পথে যাচ্ছেন?

২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে ছিলাম৷ আমি যেহেতু লিগ্যাল এক্সপার্ট ছিলাম তাই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত৷ এই প্রস্তাবটা ২০১২-২০১৩ সালের দিকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিল৷ তারা বলেছিল, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের মূল্য নির্ধারণ করতে৷ এখন আসল কথাটা বলি, ওই সময় সরকার আইএমএফের কথায় রাজি হয়নি৷ সরকার চেয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে যদি তেলের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায় তাহলে আমাদের মানুষ তো কষ্ট পাবে৷ সরকার প্রটেকশন দিয়ে যাবে৷

এখন তাহলে সরকার সেই পলিসি কেন পরিবর্তন করল?

এইটার সাইজ এখন এত বড় হয়ে গেছে যে, এটা সামলানো এখন সম্ভব না৷ আইএমএফের প্রস্তাব যেটা ছিল, পৃথিবীর সব দেশই কিন্তু সেই অনুযায়ী চালাচ্ছে৷ আমাদেরও এই পথে যেতে হবে৷ এছাড়া কোন উপায় নেই৷ আপনি যে সেন্টিমেন্টের কথা বলছেন সেটা কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ধারণ করে৷ আমরা সেটাকে অস্বীকার করি না৷ যে কোন পরিস্থিতিতে ভর্তুকি দিয়ে জনগণকে সহায়তা করা৷ কিন্তু ওইটারও তো একটা লিমিট আছে৷ কিছু কিছু মানুষ মনে করে সরকারের কোন গুপ্তধন আছে৷ সরকারের কাছে সমুদ্রের পানির মতো টাকা আছে৷ সরকারের নিজস্ব তো একটা ব্যালান্সশিট আছে৷

এনার্জি রেগুলটরি কমিশনের গণশুনানি করে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার বিধান আছে৷ কিন্তু আমরা দেখছি, সরকার নির্বাহী আদেশে তেলের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ সরকার এটা মানছে না কেন?

বিধান মানা হচ্ছে না, এটা সঠিক নয়৷ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তিন ধরনের জিনিস নিয়ে কাজ করে৷ একটা হচ্ছে বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল৷ বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ কিন্তু কমিশন করছে৷ পৃথিবীর কোন দেশেই তেলের মূল্য সমন্বয় কিন্তু রেগুলটরি কমিশন করে না৷

তাহলে এই বিধান রাখা হয়েছে কেন?

এটা বৃহৎ পরিসরে রাখা হয়েছিল৷ আমাদের বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের জন্য রেগুলেশন আছে৷ প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রেও রেগুলেশন আছে৷ কিন্তু জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে রেগুলেশন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন কোনদিন করেনি৷ এটা না থাকার কারণে সরকার আগের ব্যবস্থা অর্থাৎ বৃটিশ বা পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা পদ্ধতি অনুসরণ করছে৷ আইনে আছে কমিশন করার পর তাদের যে কাজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে সেই কাজ আর সরকার করবে না৷ কিন্তু এই কমিশন তেলের ক্ষেত্রে কোন রেগুলেশন করেনি৷ ফলে আগের ব্যবস্থা অনুযায়ি সরকার এটা করছে৷ এটা আন্তর্জাতিক ভাবেই চলে৷ বৈশ্বিক বাস্তবতায় যেহেতু এখানে আর ভর্তুকি দেওয়া যাচ্ছে না, ফলে ভারতের মতো আমাদের সমন্বয়ে যেতে হবে৷

আমাদের এখানে কতদিনে সমন্বয় করার পরিকল্পনা আছে?

এখন সময় এসেছে রেগুলেশন ফ্রেমওয়ার্কটা করার৷ ভারতেও কিন্তু বিদ্যুতের ফ্রেমওয়ার্ক আছে৷ সেটা তেলের মতো৷ মূল্য যখন বৃদ্ধি হয় তখন কিন্তু প্রাইস শক হয়৷ এটা কিন্তু কেউ টের পাই না৷ পকেট থেকে যখন ১০ টাকার জায়গায় ১২ টাকা দিচ্ছে তখন গায়ে লাগে না৷ কিন্তু আমি যখন ঘোষণা দিয়ে করব তখন কিন্তু প্রতিক্রিয়া হয়৷ অনেকে বলছেন এত টাকা কেন বাড়ানো হল? আপনি যদি একটু একটু করে বাড়ান, যতবার বাড়াবেন ততবার প্রাইস শক হবে, দ্রব্যমূল্য বাড়বে৷ ফলে একবারই করি, পরেরটা পরে দেখা যাবে৷ বাকিটা আমি পরে সমন্বয় করব৷ প্রয়োজনে পরে কমিয়ে দেবো৷ প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য এই কাজটা করেছেন৷ যাতে বড় ধরনের কোন ঝুঁকি আমরা মোকাবিলা না করি৷ মানুষের কষ্ট হয়েছে এটা সত্যি৷ এই কষ্ট কিন্তু সহনীয়৷ এটা এমন কিছু না যে মানুষ মরে যাবে৷ আগে সে যেটা ১০০ টাকা দিয়ে কিনত এখন সে ১১০ টাকা দিয়ে কিনবে৷ মানুষের সামান্য কষ্টটা রাষ্ট্রের জন্য বড় বিনিয়োগ৷ এটাই তাকে একটা সাপোর্ট দেবে৷ যে টাকাটা সরকার পাচ্ছে সেটা তো মানুষের প্রয়োজনেই আবার খরচ করা হবে৷