1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অদক্ষ ব্যবস্থাপনার দায় মেটাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল!

১২ আগস্ট ২০২২

অর্থনীতিতে ‘অয়েল শক' বলে একটা কথা আছে সোজা বাংলায় যাকে বলা যায় জ্বালানি তেলের আঘাত৷ হঠাৎ করে যদি তেলের দাম বেড়ে যায়, একই সাথে যদি সরবরাহও কমে যায় তাহলে এই আঘাত এসেছে বলে মানতে হয়৷

https://p.dw.com/p/4FSUS
আইএমএফের ঋণ পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে এই খাতে ভর্তুকি কমানোর পথে যেতে চাচ্ছে সরকার৷
আইএমএফের ঋণ পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে এই খাতে ভর্তুকি কমানোর পথে যেতে চাচ্ছে সরকার৷ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

গত শুক্রবার ( আগস্ট ৫, ২০২২) দিবাগত রাতে বাংলাদেশের মানুষ বেশ ভালভাবে এই আঘাত খেয়েছে৷

সরকার একলাফে সব ধরণের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে৷ যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে তেল আমদানি ও সরবরাহকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) লোকসান গুণছিল৷ এই লোকসান ঠেকাতে দাম বাড়ানো৷ আবার ভারতের তুলনায় দাম কম থাকায় সেখানে পাচার হওয়ার ঝুঁকি আছে৷ তাই দাম সমন্বয় করতে হয়েছে৷ এগুলো দুর্বল যুক্তি কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে নীতি-নির্ধারকরা তাতেই অটল থাকার পক্ষে৷ তাছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বহুমুখী নেতিবাচক অভিঘাত নিয়েও তাদের দিক থেকে বড় উদ্বেগ বা সংশয় পরিলক্ষিত হয়নি৷

বিপিসির লোকসানের দোহাই দেয়া হলেও বছরের পর বছর যখন প্রতিষ্ঠানটি লাভ গুণেছে, তখন দাম কমানো হয়নি৷ ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসির লাভ বা মুনাফা হয়েছিল প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা৷ সেই টাকার পুরোটাই সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে৷ তবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পরযন্ত ছয়মাসে লোকসান গুণেছে আট হাজার কোটি টাকা৷ এই সময়কালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে এক পরযায়ে ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায় মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে৷ তবে গত কিছুদিন ধরে তা আবার ১০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে৷ ফলে বিশ্ববাজারের সাথে দাম সমন্বয়ের দাবিও খুব শক্তিশালী নয়৷ যেভাবে বিপিসির লাভ-লোকসানকে মুখ্য বিবেচ্য করে তোলা হচ্ছে তাতে মনে হয় যে সরকার বিপিসিকে পুরোপুরি বাণিজ্যিকভিত্তিতেই পরিচালনা করতে আগ্রহী৷ আবার দেশে জ্বালানি তেলের দাম কম হওয়ায় পাচার হওয়ার অজুহাতও বহু পুরোনো৷ তবে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের কড়া প্রহরা এড়িয়ে কিভাবে ও কতোটা জ্বালানি তেল পাচার হয় বা হতে পারে, সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তরও নেই৷

এদিকে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে তিন বছর মেয়াদী ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে যা গণমাধ্যমের খবরে এসেছে৷ আইএমএফের ঋণ পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে এই খাতে ভর্তুকি কমানোর পথে যেতে চাচ্ছে সরকার৷ যদিও অর্থমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী দাবি করেছেন যে তেলের দাম বাড়ানোর সাথে আইএমএফের ঋণের কোনো সম্পর্ক নেই৷ কেননা, এই ঋণ নিয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি৷

বাস্তবতা হলো, সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ চেয়েছে অনেকটা আগাম সতর্কতা হিসেবে৷ অর্থনীতিতে যে দুরযোগের ঘনঘটা, তা গত কয়েক মাস ধরেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে৷ নীতি-নির্ধারকরা  সরাসরি স্বীকার করতে না চাইলেও বিভিন্নভাবে তা বোঝা যায়৷ জ্বালানি সাশ্রয়ে লোডশেডিং প্রথায় ফিরে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে চলা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নামতে থাকা, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো যে অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিফলন তা নিয়ে দ্বিমত করার অবকাশ কম৷

এখন আইএমএফের ঋণ পেতে হলে বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে হবে৷ এর মধ্যে কিছু সার্বজনীন শর্ত আছে৷ যেমন: বিভিন্ন রকম ভর্তুকি কমানো, উৎপাদিত পণ্যের দাম বাজারনির্ভর করা, সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি৷ আইএমএফের সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনার টেবিলে বসার সময় সরকার তাই দৃশ্যমান এরকম কিছু পদক্ষেপ হাতে রাখতে চায় যেন কালক্ষেপণ কম হয়৷ তাই শুধু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোই নয়, তার আগে ইউরিয়া সারের দামও বাড়ানো হয়েছে৷ এর পাশাপাশি আগামীতে ব্যাংকের ‘নয়-ছয়' সুদের হার ধরে রাখার নীতি থেকে সরে আসতে হতে পারে, কমাতে হতে পারে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার৷ তাতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ সহায়তা পাওয়ার জোরাল প্রয়াসই পরিলক্ষিত হবে৷ আর কোনো সংকট ছাড়া সহজে কোনো দেশ আইএমএফের দ্বারস্থ হয় না৷

আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ঢাকা
আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ঢাকাছবি: Privat

আসলে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর মধ্য দিয়ে সরকার প্রকারান্তরে এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নানাবিধ ত্রুটি-ঘাটতি ছিল, ছিল অদক্ষতা৷ ত্রুটি শুধরানোর ও দক্ষতা বাড়ানোর দিকে যতোটা জোর দেয়া প্রয়োজন ছিল, সেটাও দেয়া হয়নি৷ বরং বেশি জোর দেয়া হয়েছে উচ্চ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে৷ আর তা করতে গিয়ে বাড়ানো হয়েছে নানামুখী ব্যয়, উৎসাহিত করা হয়েছে ভোগ ব্যয়৷ নতুন নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটর সাইকেল নামার প্রবণতা এই ভোগ ব্যয়ের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র৷ বিপরীতে একটি দক্ষ ও শোভন গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়নি, হয়নি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ৷

পাশাপাশি প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে অনিয়ম-অপচয়-দুর্নীতিকে৷ ফলে বেড়েছে অনুপার্জিত আয়ভোগী বা রেন্ট সিকিং গোষ্ঠীর দৌরাত্ম৷ শুধু এক জ্বালানিখাতের অনিয়ম ও অস্বচছতা দেখলেই বোঝা এই্ রেন্ট সিকিং কতোটা বিস্তার লাভ করেছে৷ যেমন, গত এক যুগে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রায় দুই লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে যার মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশই গেছে ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়া বাবদ যার পরিমাণ সাড়ে ৮৬ হাজার কোটি টাকা৷  বিদ্যুৎ না কিনলেও এই চার্জ দিতে হয়৷ এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে বা নামমাত্র বিদ্যুৎ দিয়ে এসব কোম্পানি এতো বড় অংকের টাকা আয় করেছে৷ আবার বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন ঠিকভাবে না করায় দফায় দফায় ব্যয় বেড়েছে৷ তাতে এক যুগে ১০টি মেগা প্রকল্পে বাড়তি ব্যয় দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৯১ হাজার কোটি টাকা৷ বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করেন যে এসব ব্যয় এতোটা বাড়া যুক্তিসঙ্গত নয়৷

এভাবে সরকারের বাজেট ব্যয় বেড়ে গিয়েছে অনেক যার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতো যদি প্রকল্প নির্বাচন, ব্যয় প্রাক্কলন ও নির্বাহ পুরোটাই দক্ষতার সাথে করা হতো৷ সেটা না করায় বাড়তি ব্যয় মেটানোর জন্য একদিকে বিদেশি ঋণ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হয়েছে৷ পাশাপাশি চাপ তৈরি করা হয়েছে ট্যাক্স বা কর আদায়ে৷ জনগণকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই কর দিতে হচ্ছে৷

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এখন সাধারণ মানুষের নিয়মিত যাতায়াত ব্যয়কে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবে৷ বাস নির্ভর গণপরিবহনে ভাড়া গড়ে এক লাফে দেড়গুণ হয়ে গেছে তেলের দাম বাড়ায়৷ এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে মূল্যস্ফীতিতে৷ দেশের মূল্যস্ফীতির হার নির্ণয় করতে যে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ব্যবহার করা হয়, তাতে ‘ভাড়া, জ্বালানি ও বিদ্যৎ' উপখাতের হিস্যা ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ আর ‘পরিবহন ও যোগাযোগ' উপখাতের পাঁচ দশমিক ৮০ শতাংশ৷ এখন পরিবহন খাত একাই ডিজেলে ৭০ শতাংশ ব্যবহার করে৷ আর কৃষিখাতে ডিজেলের ব্যবহার ২০ শতাংশ৷ এ ‍দুটো খাতেই ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়ে একদিকে কৃষি উৎপাদন ব্যয়বহুল হবে যার ফলে কমে যেতে পারে খাদ্য উৎপাদন৷ পরিণতিতে খাদ্যপণ্যের দাম আরো বাড়বে যা বাড়িয়ে দেবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি৷ অন্যদিকে বাড়বে খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি৷ পরিণামে জাতীয় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে যা এখন প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ৷ স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন যে জ্বালানির তেল বাড়লে সবকিছুর দাম বাড়ে এবং এবং মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়৷ তাঁর এই স্বীকারোক্তি এটাই বুঝিয়ে দেয় যে আগামী দিনগুলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য কঠিনতর হতে যাচ্ছে৷