বিজ্ঞানীও অভিযুক্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতায়
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-এর তলব পেয়ে হতচকিত হয়েছেন কলকাতার বিজ্ঞানী, ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট পার্থসারথি রায়৷ বেশ কয়েকজন কবি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী এর আগে অভিযুক্ত হয়েছেন যে ভীমা কোরেগাঁও ষড়যন্ত্র মামলায়, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে প্ররোচনা দেওয়ার দায়ে, সেই মামলাতে জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর নাম৷ ১০ সেপ্টেম্বর মুম্বইয়ে এনআইএ-এর দপ্তরে গিয়ে জেরার মুখোমুখি হতে হবে তাঁকে৷ অথচ ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের ওই হাঙ্গামার ঘটনার ধারেকাছে ছিলেন না তিনি৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই বক্তব্য, এ নেহাতই তাঁকে ‘ফাঁসানো’র চেষ্টা৷ ডয়চে ভেলেকে পার্থবাবু জানিয়েছেন, ‘‘একটা জেনারেল প্রসেস চলছে, যেখানে ইন্টেলেকচুয়াল, অ্যাকাডেমিশিয়ান, অ্যাক্টিভিস্ট— সকলকে হ্যারাস করে জেলে ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে৷ সরকারের কোনওরকম বিরোধিতা করলেই এটা করা হচ্ছে৷ এই সরকার করোনার মোকাবিলা করতে পারছে না৷ একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তা বলেছিলাম৷ আমি আগে যা বলেছিলাম, পরবর্তী কালে তা মিলে গেছে৷ লকডাউনের পরে যে সংক্রমণ বাড়বে, সে কথাই আমি বলেছিলাম৷’’
পার্থসারথি রায়ের বক্তব্য, তিনি স্রেফ সরকারের সমালোচনা করার জন্য সমালোচনা করেননি৷ বরং তার বদলে কী করতে হবে, সেটাও বলে ছিলেন৷ অর্থাৎ তাঁর সমালোচনা ছিল গঠনমূলক৷ এবং যাঁরা ভারতে বিজ্ঞানচর্চার খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা বলছেন, প্যান্ডেমিক বা অতিমারী নিয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা অবশ্যই তাঁর আছে৷ এ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ আইআইএসইআর-এ ভাইরোলজি নিয়ে গবেষণায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান আছে৷ ‘নেচার’-এর মতো পত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর মতামত গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়৷ কোভিড ১৯ ভাইরাসের মতিগতি বুঝতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সারা বিশ্বের যে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেছে, পার্থবাবু তাঁদের অন্যতম৷ কিন্তু সে সব অগ্রাহ্য করে তাঁর সমালোচনা করার ‘ধৃষ্টতা’ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের৷ তাই তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়েছে মুম্বইয়ে৷ ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আর যে সমস্ত বিশিষ্টজনকে জেলে পাঠানো হয়েছে, তাঁদের সকলের বিরুদ্ধেই দেশদ্রোহের আইনে মামলা করা হয়েছে৷
তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও গ্রেফতার করা হয়েছে পার্থবাবুকে৷ পশ্চিমবঙ্গের ভাঙড়ে নোনাডাঙায় কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি৷ পাওয়ার গ্রিডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ৷ ১২ দিন জেলে ছিলেন৷ তার আগেও কৃষক এবং শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন পার্থবাবু৷
পার্থবাবুকে এনআইএ-এর তলব প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রঞ্জিত শূর বলছেন, বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে কোনও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার এই ধরনের ‘অতি-সক্রিয়তা’ পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায়নি৷ কিন্তু ডঃ রায়ের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপের একটা কারণ সম্ভবত শুধু কোভিড লকডাউন নিয়ে সরকারের সমালোচনা নয়, নানা প্রসঙ্গেই অতীতে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তিনি৷ এটা তারই প্রতিক্রিয়া বলে অনেকে মনে করছেন৷ তাঁদের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গে ভোট যত কাছে আসবে, ততই এই ধরনের ঘটনা বাড়বে৷ রঞ্জিত শূরের কথায়, ‘‘সামনে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন৷ বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বেশ কয়েকবার পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের কাছে গেছে৷ কিন্তু বিশেষ সুবিধা মেলেনি৷ তাই এ বার এজেন্সিকে ব্যবহার করে তাঁদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে৷’’
এনআইএ-এর মুম্বইয়ের দপ্তরে হাজিরা দেওয়ার ডাক পড়েছে পার্থসারথিবাবুর৷ এই করোনা পরিস্থিতিতে তিনি কীভাবে কলকাতা থেকে মুম্বই যাবেন, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন৷ আইনি সাহায্যও নিচ্ছেন তিনি৷ অন্যদিকে অনেক বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী তাঁর এই হেনস্থার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন৷ এপিডিআর বিক্ষোভ জমায়েত এবং রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি পাঠানোর কর্মসূচি নিয়েছে৷ কিন্তু সরকার আদৌ তাতে কর্ণপাত করে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন৷ পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ বিষয়ে নীরব কেন, সে প্রশ্নও উঠছে কোনও কোনও মহলে৷