কিশোরদের নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা
২৫ জুন ২০১৮১৭ জুন রাতে চট্টগ্রামের হালিশহর আর্টিলারি রোডে ছিনতাইকরীদের কবলে পড়েন মোহাম্মদ সুমন ও তার বন্ধুরা (১৭)৷ সুমনের মেবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার সময় ধস্তাধস্তি হয়৷ একপর্যায়ে সুমনকে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা৷ ওই রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় সুমন৷ এরপর দু'দিনে এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে হালিশহরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ১০ কিশোরকে আটক করে পুলিশ৷ এরপরই এক সংবাদ সম্মেলনে সিএমপি-র অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম কিশোর অপরাধবিরোধী বিশেষ অভিযানের ঘোষণা দেন৷
স্থানীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে সম্প্রতি কিশোর অপরাধ বেড়ে গেছে৷ দলবেধে অপরাধ করা, গ্যাং তৈরি করা, গ্রুপ তৈরি করা, দল বেধে ইভ টিজিং, একযোগে মোটর সাইকেলের হর্ন বাজিয়ে উত্যক্ত করা একটা সাধারণ অপরাধ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে৷
কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে কিশোর অপরাধবিরোধী এই বিশেষ অভিযানের প্রয়োজন পড়ল, তা নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সিএমপি-র অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম৷
তিনি জানান, ‘‘সম্প্রতি হালিশহরে একটি হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আমরা দেখি, যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত তারা কিশোর৷ এদের সবার বয়স ১৭ বছরের নীচে৷ আবার নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে এক কিশোরী ব্যাগে ছুরি নিয়ে তার প্রেমিকসহ প্রাক্তন প্রেমিককে ছুরিকাঘাত করেছে৷ আরো কিছু অভিযোগ আমরা পেয়েছি৷ কিছু রাস্তার মোড় আছে যেখানে কিশোররা আড্ডা দেয়৷ কোনো যাত্রী বা পথচারী হেঁটে যাওয়ার সময় তারা মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এ রকম অভিযোগ আছে৷''
‘‘এইসব অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ কমিশনার মহোদয়ের পরিকল্পনায় আমরা কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নগরীতে চেকপোস্ট বসানোর সিদ্ধান্ত নেই আমরা৷ এই চেকপেস্টগুলো ভ্রাম্যমান৷ একই জায়গায় অবস্থান করবে না৷ প্রয়োজন অনুযায়ী জায়গা বদল করবে৷ এরইমধ্যে ১৭টি চেকপোস্ট চেকপোস্ট কাজ শুরু করেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, রাত ৯টার পর যদি কিশোরবয়সি কাউকে বাইরে বা রাস্তায় পাওয়া যায়, তারা যদি ঘোরাঘুরি করে, তাহলে আমরা তার দেহ তল্লাশি করব৷ যদি যে আমাদের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারে, তাহলে সে চলে যেতে পারবে৷ কিন্তু যদি সে সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারে, তার আচরণ যদি সন্দেহজনক হয়, তাহলে তাকে আমরা থানায় নিয়ে যাব৷ তাদের মা-বাবাকে ডাকা হবে থানায়৷ এরপর তারা মুচলেকা দিয়ে যার যার সন্তানকে নিয়ে যেতে পারবেন৷ আর যদি তাদের দেহ তল্লাশি করে কোনো অস্ত্র, ধারালো বস্ত বা অবৈধ কিছু পাওয়া যায়, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷''
এ রকম সন্দেহভাজন কিশোর কত আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সঠিক সংখ্যা বলা কঠিন৷ তবে আমরা ধারণা করছি নিম্নবিত্ত পরিবারের এরকম ৫-৭ হাজার কিশোর আছে৷ নির্দিষ্ট কিছু ‘স্পট' বা মোড় আছে যেখানে তারা আড্ডা দেয়৷ এ রকম ১৪৫টি স্পট আমরা চিহ্নিত করেছি৷ ওইসব স্পটে তারা বসে থাকে৷ তার পথচারীদের নানাভাবে ‘ডিস্টার্ব' করে বলেও আমাদের কাছে তথ্য আছে৷''
অবশ্য তিনি বলেন, ‘‘শুধু নিম্মবিত্ত নয়, উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোররাও নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ তারা কোনো স্পট, মার্কেট বা মলে আড্ডা দেয়৷ সেখানে তারা ইভটিজিং করে৷ ছিনতাই হয়ত করে না৷ কিন্তু নিজেদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷ নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং হয়, আধপত্য বিস্তারের ঘটনা ঘটে, গ্যাং তৈরি হয়৷ গ্রুপিং হলে নিজেদের মধ্যে মারামারি হয়৷ হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়৷
নানা কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷ এদের মধ্যে কিছু রয়েছে যাদের মা-বাবা নেই৷ আর এই ধরনের ছেলে-মেয়েদের দেখার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই৷ আবার অর্থনৈতিক কারণে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানদের সময় দিতে পারেন না৷ উচ্চবিত্ত পরিবারেও সন্তানদের দেয়ার মতো সময় নাই৷ সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেশে – সেই খবর তারা রাখেন না৷ সন্তান স্কুলে যায় কিনা, প্রাইভেট টিউটরের কাছে বা কোচিং-এ যাওয়ার কথা বলে কোথায় যায়, কী করে, সে খবরও অভিভাবকরা রাখেন না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এই অভিযানে অভিভাবকরাও সতর্ক হবেন৷ কারণ তারা মনে করবেন সন্তানের কারণে পুলিশ তাদেরও ডাকতে পারে৷''
এই কিশোরদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অপরাধ অনুযায়ী আইনে যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা আছে, সেই ব্যবস্থাই নেয়া হবে৷ অস্ত্র বা ধারলো কোনো কিছু পাওয়া গেলে অস্ত্র আইনে ধরা হবে তাদের৷ এছাড়া সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করলে সিএমপি অ্যাক্টে আটকের বিধান আছে৷''
রাত ৯টার পর কিশোররা বাইরে বের হলেই কি তাদের আটক বা গ্রেপ্তার করা হবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে৷ তাছাড়া তাদের মধ্যে কারুর আচরণ যদি সন্দেহজনক হয় বা তাদের কাছে অবৈধ কিছু পাওয়া যায়, তাহলে তাদের আটক করা হবে৷ যেখানে মামলার প্রয়োজন সেখানে মামলা করা হবে৷ আর যেখানে মুচলেকার প্রয়োজন সেখানে অভিভাবকদের ডেকে মুচলেকা নেয়া হবে৷''
শিশু-কিশোরদের জন্য তো আইন আলাদা, তাদের তো অপরাধী বিবেচনা করা যায় না৷ আইনের এই প্রসঙ্গ তুলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আটকের পর আমরা বয়স দেখেই আইনি ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেই৷ যারা শিশু বা কিশোর আইনে পড়ে তাদের ব্যাপারে সেই আইনই অনুসরণ করা হয়৷''
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘এটাকে আমরা ‘প্রিভেন্টিভ' ব্যবস্থা হিসেবে দেখছি৷ আমরা ছোটবেলা মাগরিবের আজানের আগে ঘরে ফিরেছি৷ হয়ত কোচিং-এর কারণে এখন রাত ৯টা পর্যন্ত বাইরে থাকতে হতে পারে৷ কিন্তু সেটা কতজন? রাত ৯টার পর বাইরে তাদের কী কাজ থাকতে পারে? এই অভিযানের কারণে, চেকপোস্টের কারণে, কিশোরদের রাতে বাইরে ঘোরঘুরি কমবে৷ তাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণাতাও কমবে৷''
এর বাইরে বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং-এর মাধ্যমে সচেতনতার কাজও হচ্ছে বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘অপরাধ দমনে বিশেষ পরিস্থতির কারণে এই অভিযান চালাচ্ছি আমরা৷ এছাড়া অপরাধ দমনে আমাদের নিয়মিত কাজতো চলছেই৷''
এই তল্লাশি কিশোর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে কি? এই প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, ‘‘হ্যাঁ, প্রভাব তো ফেলতেই পারে৷ সেজন্যই আমরা অভিযানের শুরু থেকে মাইকিং করে অভিভাবকদের সচেতন করছি৷ তারা যেন তাদের কিশোর সন্তানদের দিকে নজর দেন৷ তাদের যেন তল্লাশির মুখে পড়তে না হয়৷ তাদের তো মনিটরিং-এর আওতায় রাখতে হবে৷ সেটা যদি ফ্যামিলি করে, তাহলে আমাদের আর তল্লাশির প্রয়োজন পড়বে না৷ এই অভিযান নিয়ে নেগেটিভ-পজেপিভ দু'ধরনের মতই আছে৷ কিন্তু তাতে আমাদের কিছু করার নেই৷ কারণ মনিটরিং-এর আওতায় কোনো না কোনোভাবে থাকতেই হবে৷''