‘আমি চিৎকার করিয়া কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার'
১০ জুলাই ২০১৫সামহয়্যারইন ব্লগে আবদুর রব শরীফ লিখেছেন, ‘প্লিজ! প্লিজ! আপনারা এভাবে ঘরে বসে যাকাত দিবেন না!' এটা তাঁর লেখার শিরোনাম৷ মূল লেখাটা শুরু হয়েছে আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘যে দেশে একটি নতুন যাকাতের কাপড় পড়ে ঈদ করার আশায় ২৩ জন মানুষ পদদলিত হয়ে মারা যায়, শত শত আহত হয় সে দেশে কোনো বিলাসিতা সাজে না৷ হাসপাতালে কিছু দুঃখি রোজাদার মানুষের লাশের সারি দেখে কান্না যেন ডুকরে বের হতে চেয়েও বের হয়নি৷ বারবার হায়দারের সেই গানটিকে রেফারেন্স হিসেবে টানতে আর ভালো লাগে না৷ তবুও আজ আবার বলবো, আমি চিৎকার করিয়া কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার৷ বুকের ব্যাথা বুকে লুকিয়ে, নিজেকে দিয়েছি, ধিক্কার৷''
আবদুর রব শরীফ মনে করেন, ‘‘নিজেকে বড়লোক/মহৎ মানুষ প্রমাণ করার আশায় যারা মাইকিং করে গরিবদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে পয়সার খেলা দেখায়, তাদের একটাই কথা বলবো, জানেন, সেই প্রকৃত দানবীর, যার ডান হাত দান করলে বাম হাত জানে না৷''
ইসলাম এভাবে দান করার কথা বললেও অনেকেই তা করেন না৷ আত্মপ্রচারের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন অনেকেই৷ প্রায় সবক্ষেত্রে এর মাশুল গুণতে হয় অন্যকে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিরপরাধকে৷
জাকাতদাতাদের প্রতি সামহয়্যারইন-এর ব্লগারের পরামর্শ, ‘‘একটি শাড়ি/লুঙ্গি যাকাত না দিয়ে, এমন কিছু মানুষ সিলেক্ট করে যাকাত দিন তারা যেন পরের বছর একটু হলেও যাকাত দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে৷... লাখো মানুষকে একটি করে শাড়ি/লুঙ্গি কখনো সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে পারবেন না, এতে হয়ত আপনার প্রচার প্রসার হয়৷ সবাই বাহবা দিয়ে হয়তো বলে, অমুক মানুষের বাড়ির সামনে দেখেছ ইয়া বড় লাইন! হয়ত অবুঝ মানুষগুলো আপনার নামে কল্পকাহিনি বলে বেড়ায়, আর আপনি নিজেকে সম্রাট আকবর ভেবে পরবর্তী বছর এতগুলো রোজাদার মানুষকে লোক দেখানো ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে রাখেন৷''
সামহয়্যারইন ব্লগে রেজা ঘটকের লেখার শিরোনাম, ‘যাকাত আনতে গিয়ে মৃত্যু এবং কয়েকটি প্রশ্ন'৷ তাঁর মতে, ‘‘বাংলাদেশে একটা বিষয় দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত৷ যদি কেউ কিছু দান করে, তা পাড়া-পরশি-প্রতিবেশী-পরিবেশী সব্বাইরে ডেকে দেখায়৷ এই দেখো, আমি কত্তো বড় দানবীর হাজী মুহম্মদ মুহসীন৷ দেশের বিভিন্ন বিপর্যয়ের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভান্ডারে কেউ দান করলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলে সেই ছবি প্রচার করার হিড়িক লাগে৷ এই যে দেখো, আমি দান করেছি৷ পত্রিকায় সেসব দানকারীদের সহাস্য ছবি ছাপা হয়৷ টেলিভিশনে পারলে সেই দানের অনুষ্ঠান লাইভ দেখায়৷ দানের আড়ালে নিজের পাবলিসিটিই এখানে মুখ্য৷ এর আড়ালে আরো যেসব বিষয় গৌন হিসেব থাকে তা হলো, কর ফাঁকি দেওয়া, সরকারি সম্পত্তি ক্রয়ে সুবিধা আদায়, প্রধানমন্ত্রীর আনুকল্য পাবার চেষ্টা, ভবিষ্যতে রাজনীতিতে আবির্ভাবের পূর্বাভাষ, সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করা, ভিআইপি, ভিভিআইপি, সিআইপি মর্যাদা লাভের বাসনা, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পাবার লোভ ইত্যাদি৷ দানের আড়ালের এসব বিষয় বাস্তবায়নে এক ধরনের সুবিধা আদায় করাই আমাদের তথাকথিত এসব দানকারীদের এক ধরনের স্থির লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত৷''
রেজা ঘটক আরো লিখেছেন, ‘‘অন্য একটি চিত্রও আমরা দেখি৷ কেউ দান করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকেন৷ কিন্তু নাম প্রকাশে ইচ্ছুকের সংখ্যাই দেশে বেশি৷ এই মানুষগুলোর দানের চেয়ে লোভ বেশি৷ দানের চেয়ে আরো বড় দান বাগানোর প্রচেষ্টাও বেশি৷ উদ্দেশ্য একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার৷ দানের বেলায় এটাই বাংলাদেশের একটি প্রচলন এখানে দীর্ঘদিন ধরে চালু৷ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কেউ এক লাখ টাকা দান করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে সেই চেক তুলে দিচ্ছেন এমন ছবি এরা তাদের ড্রয়িংরুম, অফিস-আদালত, চেম্বার সবখানেই হাজার হাজার কপি কাঁচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে টানিয়ে রাখেন৷ এই দেখো আমি দান করেছি৷ এটা প্রচারের উদ্দেশ্যেই করা হয়৷ মতলব খুব পরিষ্কার – এটা দেখিয়ে এবার আরো বড় দান ঘরে তোলার পালা৷''
ময়মনসিংহের মর্মান্তিক ঘটনাটিকে রেজা দেখছেন এভাবে, ‘‘ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী রোডে যাকাতের নামে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, এটি সারা দেশের যে কোনো দানের বেলায় ঘটলেও অবাক হবার কিছু নেই৷ কারণ, গরিব মানুষ কিছু একটা পাবে শুনলে সেখানে ভিড় করবে এটাই স্বাভাবিক৷ আর সেই ভিড়ের মধ্যে তাড়াহুড়ো লাগলে এমন ঘটনা ঘটাও স্বাভাবিক৷ এখন প্রশ্ন হলো জাকাত দানকারী নূরানী জর্দার মালিক ব্যবসায়ী শামীম তালুকদার কি এই ঘটনায় এখন হত্যা মামলার আসামি হবেন? নাকি রাষ্ট্র তাকে লোক দেখানো গ্রেফতারের নাটক করলো?''
বাংলাদেশ সম্প্রতি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেলেও দেশে যে দারিদ্র্যসীমার নীচে অনেক মানুসের বসবাস সেই প্রসঙ্গও এসেছে৷ রেজা লিখেছেন, ‘‘প্রতি শুক্রবার রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশে মসজিদ গুলোর সামনে দান খয়রাত পাবার জন্য গরিব মানুষের যে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়, শুধুমাত্র শুক্রবার বাংলাদেশের মসজিদ গুলোর সামনে শুমারি চালানো হলে, বাংলাদেশের গরিব মানুষের প্রকৃত সংখ্যাটি খুব সহজেই চট করে বের করা যাবে৷ সেই সংখ্যাটি দিয়ে বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসরত মানুষের সংখ্যাও আবিষ্কার করা সম্ভব৷ যারা অর্থনীতির ছাত্র, তারা চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে কত জন বাংলাদেশি আছে, বের করতে চাইলে এর চেয়ে সহজ পদ্ধতি হয়ত আর নেই৷''
অবশেষে তাঁর প্রশ্ন এবং বিশ্লেষণ, ‘‘বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ৷ কেমন মধ্যম আয়ের দেশ? বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর হিসাবে কোনো দেশের মাথাপিছু গড় আয় যদি এক হাজার ৪৫ মার্কিন ডলারের কম হয়, তাহলে সেটি গরিব দেশ৷ কোনো দেশের মাথাপিছু গড় আয় যদি এক হাজার ৪৬ মার্কিন ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ ডলার হয়, তাহলে সেটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ৷ কোনো দেশের মাথাপিছু গড় আয় যদি ৪ হাজার ১২৬ মার্কিন ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার হয়, তাহলে সেটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ৷ আর ১২ হাজার ৭৩৭ মার্কিন ডলারের বেশি মাথাপিছু গড় আয়ের উপরের দেশগুলো হলো ধনি দেশ৷ বাংলাদেশের এখন গড় মাথাপিছু আয় সরকারি হিসেবে এক হাজার ৩১৪ মার্কিন ডলার৷ তাই বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ৷''
আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন রেজা ঘটক, ‘‘এখন একটি প্রশ্ন হতে পারে, বাংলাদেশে ভিক্ষুকের প্রকৃত সংখ্যা কত? চরম দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা কত? দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা বা কত? এমন কি বাংলাদেশে ধনির প্রকৃত সংখ্যা বা কত?''
তবে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার উপায় নেই বলে তিনি হতাশ৷ রেজা ঘটক তাঁর লেখা শেষ করেছেন এভাবে, ‘‘...জাকাতের দান আনতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ২৭ জন হতভাগ্য গরিব মানুষ মারা গেছে, এই বিষয়ে খোদ রাষ্ট্র এখন কী জবাব দেবে? তাহলে কী বাংলাদেশের গোটা সিস্টেমের ভেতরেই গোড়াতে কোনো বড় ধরনের ভুল লুকিয়ে আছে? আর রাষ্ট্র সেই ভুলের ব্যাপারটি জেনেও না জানার ভান করছে? এবারের ঈদের আনন্দ যে ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী রোডের আজকের মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে মাটি হয়ে হয়ে গেল, তার এখন কী হবে!''
সংকলন: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ