শিল্পপতিদের প্রজন্ম-বিরোধ
৩১ অক্টোবর ২০১৬ভারতের টাটা শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারিত হলেন সাইরাস মিস্ত্রি৷ অস্থায়ী দায়িত্বে ফেরত এলেন রতন টাটা৷ দেশে এবং বিদেশেও সাড়া ফেলেছে এই ঘটনা৷
টাটা শিল্পগোষ্ঠী ভারতের সবথেকে পুরনো, সফল শিল্পোদ্যোগের অন্যতম৷ চা-কফি থেকে বিমানসংস্থা, ইস্পাত থেকে গাড়ি, বহু ব্যবসা তাদের৷ এবং এই শিল্পগোষ্ঠীর পরিচালনভার বরাবরই থেকে এসেছে টাটা পরিবারের কারও হাতে৷ চার বছর আগে, ভারতের আরেক শিল্পগোষ্ঠী শাপুরজি পালোনজির নবীন উত্তরসূরি সাইরাস পালোনজি মিস্ত্রিকে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ করা হলো, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিলেন৷ যদিও সেই প্রথম নয়, তার আগেও একবার পরিবারের বাইরে থেকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিল টাটা গোষ্ঠীতে৷ সাইরাস মিস্ত্রির নিয়োগ দ্বিতীয় ব্যতিক্রম৷ কিন্তু সেই নিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল অন্য কারণে৷ পূর্বতন চেয়ারম্যান, ৭৫ বছর বয়সি রতন টাটা সেবছর অবসর নিচ্ছিলেন৷ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহল অবাক হয়েছিল এই ভেবেই যে টাটা গোষ্ঠী তাদের ভবিষ্যতের ভার পরিবারের বাইরের কারও হাতে ছেড়ে দিচ্ছে! কারণ টাটা মানে শুধুই শিল্প উদ্যোগ নয়, টাটা মানে ভারতে এবং বাকি বিশ্বেও জনমুখী, দায়িত্ব সচেতন, সমাজ সচেতন বাণিজ্য ভাবনা৷ অনেকেরই হয়ত খেয়াল থাকবে দু'দশক আগে টাটা গোষ্ঠীর সেই বিখ্যাত টিভি বিজ্ঞাপন, যেখানে টাটাদের বিভিন্ন সমাজমুখী এবং জনকল্যাণমূলক কাজের খতিয়ান তুলে ধরার পর একেবারে শেষে বলা হতো – ‘উই অলসো মেক স্টিল' বা ‘আমরা এ সবের পাশাপাশি ইস্পাতও বানাই'৷
সেই প্রেক্ষিতে সাইরাস মিস্ত্রিকে চার বছরের মাথায় সংস্থার কর্ণধারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া, যার প্রতিক্রিয়ায় মিস্ত্রির বিতর্কিত ই-মেলে টাটাদের সমালোচনা, এবং টাটাদের পরবর্তী পদক্ষেপ পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে, টাটারা আসলে ভুল সংশোধন করলেন৷ যে কোনো শিল্পপতি যে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ কর্ণধার হতে পারেন না, সেটা মিস্ত্রিকে দিয়ে বুঝেছে টাটারা৷ এবং এটা কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরোধিতা, বা তার সম্পর্কে আপত্তি নয়৷ এটা বরং প্রজন্ম এবং মানসিকতার ব্যবধান৷ স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের শিল্পোদ্যোগীরা কী আদর্শ নিয়ে চলতেন, আর এখন শিল্পপতি, লগ্নিকাররা কী ভাবেন, তার ফারাক৷ যে কারণে টাটা পরিবার এখন যখন চাপ সৃষ্টি করছে শাপুরজি পালনজি পরিবারের ওপর, তাদের হাতে থাকা ১৮.৪% শতাংশ টাটার শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার জন্য, তখন তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে৷ যে এমন কারও হাতে এই শেয়ার যাক, যারা টাটা গোষ্ঠীর শিল্প-দর্শনকে বুঝতে পারবে৷ শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে, কারণ শিল্পের আবার দর্শন কী! কিন্তু মৌলিক বিরোধের জায়গা এখানেই৷ দুই সময়ের, দুই প্রজন্মের, দুই ধরনের মানসিকতার সংঘাত৷
একবার বিতাড়িত সাইরাস মিস্ত্রির ই-মেল অভিযোগের দিকে নজর ফেরালেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে৷ মিস্ত্রি রতন টাটার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, ন্যানো গাড়ির প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ ভুল হয়েছিল৷ ন্যানোর কারণে টাটা মোটরসের প্রচুর লোকসান হয়েছে৷ এবার দেখা যাক, রতন টাটা কেন ন্যানো প্রকল্প নিয়ে এত উৎসাহী ছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ভারতের অসংখ্য লোক, সপরিবার স্কুটার বা মোটরবাইকে যাতায়াত করেন৷ প্রায়শই অ-নিরাপদ ভাবে, একসঙ্গে অনেকে৷ তাঁদের জন্যেই সস্তার গাড়ি ন্যানো, যাতে তাঁরা ন্যূনতম সড়ক সুরক্ষা পেতে পারেন৷ সেই গাড়ি বাজারে জনপ্রিয় হয়নি, বা শেষ পর্যন্ত ন্যানোর দাম এক লাখে বেঁধে রাখা যায়নি, সেটা অন্য কথা৷ কিন্তু যা বোঝা যাচ্ছে, লোকসান সত্ত্বেও টাটারা ন্যানো গাড়ির প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নেয়নি৷ সেখানে সাইরাস মিস্ত্রির বিরুদ্ধে টাটাদের প্রধান অভিযোগ হলো, অলাভজনক প্রকল্পগুলি চালাবার পক্ষপাতী ছিলেন না মিস্ত্রি৷ আর সংঘাত ঠিক এখানেই৷ টাটারা মনে করে তাদের একটা সামাজিক দায়িত্বও আছে, যেখানে লোকসান সত্ত্বেও মধ্যবিত্তদের জন্য কম দামে একটা গাড়ি তৈরি করা উচিত৷ আর মিস্ত্রির মতো নবীন প্রজন্মের উদ্যোগপতিরা মনে করেন, যেখানে লাভ, একমাত্র সেখানেই থাকা উচিত৷ যে কোনো ব্যবসায় মুনাফাই শেষ কথা৷
কে ঠিক বলছেন, সাইরাস মিস্ত্রি, না রতন টাটা, সেটা অবশ্য ভবিষ্যত বলবে৷ ভবিষ্যত কী হবে, সেটাও নির্ভর করছে এই প্রশ্নের মীমাংসার ওপর৷