1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

৩০০ টাকায় হাইকোর্টের রায়?

সুলাইমান নিলয় ঢাকা
২৬ জুলাই ২০১৮

প্রয়োজন হয়নি যুক্তিতর্কের, বিচারকের সামনে দাঁড়াতে হয়নি আসামি বা আইনজীবীকে৷ এসব প্রক্রিয়া ছাড়াই মিলে গেছে ‘হাইকোর্টের আদেশ', যা দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তিও মিলেছিল ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার দুই আসামির৷

https://p.dw.com/p/326Gm
বাংলাদেশ হাইকোর্ট
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan

হাইকোর্টের যে কর্মচারী নিজে ঐ জাল আদেশকে বিভিন্ন ধাপ পার করিয়ে দিয়েছেন, তিনি অনুসন্ধান কমিটির কাছে দাবি করেছেন, এর জন্য তিনি নিয়েছেন মাত্র ৩০০টাকা৷

তবে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আলী জিন্নাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, এটা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে৷

তবে এরই মধ্যে দুই আসামির একজন মো. রাসেলকে ফের গ্রেপ্তার করেছে চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানা পুলিশ৷

রাসেলকে উদ্বৃত করে ঐ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রণব চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানান, একটা গ্রুপের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল, ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে কারামুক্তি পেতে আসামিদের সঙ্গে তাদের একটি চুক্তি হয়েছিল৷

যেভাবে হয়েছিল এই আদেশ জালিয়াতি

২০১৬ সালের আগস্টে ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ চট্টগ্রামে ব়্যাবের হাতে ধরা পড়েন আহমেদ নুর ও মো. রাসেল৷ তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, দেখানো হয় গ্রেপ্তার৷ গত ৮ এপ্রিল হাইকোর্টের একটি আদেশ দেখিয়ে এই দুই আসামি কারাগার থেকে বের হয়ে যান৷

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আলী জিন্নাহ

এত বিপুল ইয়াবাসহ ধরা পড়া আসামির জামিনের বিষয়ে চট্টগ্রামের অনেকের সন্দেহ হয়৷ হাইকোর্টের যে আদালতের আদেশ দেখিয়ে আসামিরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিল, সেই আদালতের সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আলী জিন্নাহও বিষয়টি জানতে পারেন৷ তিনি হাইকোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট শাখায় গিয়ে নথি খোঁজ করেন৷ নথি না পেয়ে সন্দেহ তীব্র হলে বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন তিনি৷

আদালতও সংশ্লিষ্ট শাখার কাছে নথি চাইলেও পাওয়া যায়নি৷ এরপর গঠন করা হয় অনুসন্ধান কমিটি৷ কমিটির রিপোর্টে দেখা যায়, আদালতে উপস্থাপন না হলেও জাল আদেশটি গেছে হাইকোর্ট প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকেই৷

অনুসন্ধান কমিটি দায়ীদের শীর্ষে রেখেছেন এমএলএসএস (মূল পদ জমাদার) মঞ্জু রাণী কৈরীকে৷

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে করা ঐ অনুসদ্ধান কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ ধরণের জামিন আবেদন দাখিল থেকে শুরু করে আদেশ বিতরণের জন্য প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত মোট ১৬টি স্তর রয়েছে৷

এর মধ্যে ষষ্ঠ স্তরে আদালতে শুনানি ও আদেশ হয়৷ আদেশ পাওয়া গেলে আদেশনামা বিতরণের জন্য প্রস্তুত করতে বাকি ধাপগুলো সম্পন্ন করতে হয়৷

এই মামলায় সপ্তম স্তরে এসে আবির্ভাব ঘটে মঞ্জু রাণী কৈরীর৷ অনুসন্ধান কমিটিকে তিনি বলেন, গত ১০ এপ্রিল একটা ছেলে একটা কাগজ দিয়ে তাঁকে কাজ করে দিতে বলে৷ এ জন্য ঐ ছেলে তাঁকে ৩০০ টাকা দিয়েছিল৷

প্রতিবেদনে বলা হয়, পরে মঞ্জু রাণী মনিরকে দিয়ে এন্ট্রি করান, টাইপিস্ট মুজিবুরকে দিয়ে টাইপ করান৷ এরপর ড্রাফটম্যান মৌসুমী দেবের কাছে দেন কম্পেয়ার করতে৷ সেটা হয়ে গেলে মঞ্জু রাণীই সেটা নিয়ে যান শাখার সুপারিন্টেন্ডেন্টের টেবিলে৷

এর পরের ধাপে সহকারী রেজিস্ট্রার স্বাক্ষর করে দিলে তিনি সেই নথি শাখায় নিয়ে আসেন৷ আর এই সব ধাপ সম্পন্ন করতে মঞ্জু রাণী সময় নেন মাত্র একদিন৷

প্রতিবেদনে মঞ্জু রাণীকে উদ্বৃত করে বলা হয়, এরপর শাখা কর্মকর্তা বাছেদের এন্ট্রি দেয়ার কথা থাকলেও মঞ্জু রাণী নিজেই সেটি করেন৷

ঐ আদালতের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আলী জিন্নাহ বলেন, সহকারী রেজিস্ট্রার স্বাক্ষর করলে এটি আইটি সেকশনে যায়, সেখানে একটি আইটি নম্বর পড়ে৷ এই নম্বর সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালতে চলে যায়৷ তারপর আদেশের কপি পাওয়ার পর আসামির বেইলবন্ড মিলিয়ে দেখে আসামিকে মুক্তি দেয়া হয়৷

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি, জালিয়াতির এ ধরণের প্রায় ৪০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে৷

‘মেডিকেল রিপোর্ট থেকে ধর্ষণের আলামত হাওয়া'

ধর্ষণের অভিযোগে গাজীপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে বিল্লাল হোসেন নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে৷ আত্মসমর্পণের পর বিচারিক আদালত তাকে কারাগারে পাঠালেও ২০ দিনের মাথায় তিনি হাইকোর্টের জামিন আদেশ নিয়ে বের হয়ে যান৷

খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল, যে ধর্ষণের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা, জামিন আবেদনের সঙ্গে দেয়া মেডিকেল রিপোর্ট থেকে সেই ধর্ষণের অভিযোগই তিনি হাওয়া করে দিয়েছেন৷ জালিয়াতি করেছেন অন্য সব কাগজপত্রেও৷

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল জানান, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে ভিক্টিমের বয়স ছিল ১০৷ হাইকোর্টে দেখানো হয় ২১ বছর৷ ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল বিল্লাল হোসেন আত্মসমর্পণ করেছিলেন৷ কিন্তু এই তারিখটি অনেক আগে দেখিয়ে দীর্ঘ কারাবাসের কথা বলে আদালতের সিমপ্যাথি নিয়ে তিনি জামিন পান৷

তবে এই মামলায় আদালতে দাখিল করা মেডিকেল রিপোর্টে ‘নো সাইন অফ রেপ' কথাটা উল্লেখ ছিল৷ বাস্তবে মূল রিপোর্টে ‘সাইন অফ রেপ' ছিল৷

এক প্রশ্নের জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজল বলেন, নিচের কোর্ট থেকে প্রত্যায়িত অনুলিপি দেয়ার সময় একটা চক্র কাজ করে৷ অথবা প্রত্যায়িত অনুলিপি নকল করে মামলাটাকে সহজ করে হাইকোর্টের বিচারপতিদের আস্থা অর্জন করে জামিন নেয়া হয়৷ ‘‘এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে হাইকোর্টে দাখিল করা হয়৷ এসব অপরাধী চক্রের সহায়তায় বড় বড় অপরাধীরা জামিনপ্রাপ্ত হচ্ছেন,'' বলেন তিনি৷ঃ

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল

আরেক প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, ‘‘এ ধরণের অনেক ঘটনা ঘটে৷ সুপ্রিম কোর্টের আগাম জামিনের ক্ষেত্রে আমার চোখে ধরা পড়েছে৷ আগাম জামিনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের দুজন ক্লিনারকে এক মামলায় দাঁড় করিয়ে আগাম জামিন নেয়া হয়েছে৷ আমার সন্দেহ হলে কোর্টের নজরে আনি৷ কোর্ট পরে ঐ জামিন বাতিল করে৷

‘‘আরেকটা জামিন আবেদনে দেখি, মাত্র ছয় বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে৷ তখন আমার সন্দেহ হয় যে, ছয় বোতল ফেনসিডিলের মামলায় হাইকোর্টে আসা লাগবে কেন? পরে কাগজ পরীক্ষা করে দেখা যায়, সব ঠিক, কেসের নম্বর ঠিক, আসামির নাম ঠিক৷ কেবল ছয়টি সোনার বারের জায়গায় ছয়টি ফেনসিডিল উল্লেখ করে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন দাখিল করা হয়েছে,'' ডয়চে ভেলেকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ সারওয়ার কাজল৷

এ ধরণের নথি জালিয়াতির সমাধানে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন একটা বেঞ্চের বিচারক আদেশনামায় বলে দেন যে, কয়টি ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে৷ এই আদেশটি নিম্ন আদালতে গেলে বিচারকরা আদেশ দেখেই হাইকোর্টে কোন অপরাধের কথা বলে জামিন নেওয়া হয়েছে সেটা বুঝতে পারেন৷ সব আদালত যদি এভাবে আদেশ দেয়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে৷ ‘‘কোনো কাগজ জালিয়াতি করলে পুরো চক্রকে ধরলেও তারা নিরুৎসাহিত হবে,'' বলেন কাজল৷

নথি জালিয়াতি করে জামিন নেয়ার ঘটনা দেখেছেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আলী জিন্নাহও৷

২০১৬ সালের অক্টোবরের এক মামলায় আসামি ছিলেন আশরাফুল ইসলাম বাবু নামে এক ব্যক্তি৷ তিনি রাজশাহী থেকে ৫৫০ গ্রাম হেরোইনসহ গ্রেপ্তার হন৷ পরে গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷ জামিনের আদেশনামা বিচারিক আদালতে গেলে তথ্য বিচারে ধরা পড়ে যে, জামিনের আবেদনে ৫৫০ গ্রামের পরিবর্তে ৪৮ গ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে৷ পরে তার জামিন বাতিল করা হয়৷

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

এসব জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘‘এসব ঘটনা অনেকটা চেক দেয়া গেছে৷ এখন এগুলো রেয়ার, পাওয়া যাচ্ছে না৷ অনেক কমেছে৷'' তিনি বলেন, এখন অনলাইনে ‘বেইল কনফার্মেশন' করা হয়৷

সাইফুর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের বেইল করফার্মেশন সফটওয়ার রয়েছে৷ সব মামলা এভাবে কনফার্ম করা হয়৷ যে-কোনো জামিনই অনলাইনে কনফার্ম করতে হয় অথবা টেলিফোন করতে হয়৷''

তিনি আরও জানান, ‘‘এখন সেকশনগুলোতে ঝটিকা সফর দেই৷ আকস্মিকভাবে আমরা যাই৷ এই বেইলের সেকশনগুলোতে হঠাৎ আমাদের সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, রেজিস্ট্রার হাইকোর্ট, রেজিস্ট্রার সুপ্রিম কোর্ট মহোদয় যান৷ প্রধান বিচারপতি নিজেও কয়েকবার আকস্মিকভাবে গিয়েছেন৷ গিয়ে অনেককে আমরা ধরেছি৷ সুপ্রিম কোর্ট বারও আমাদেরকে এ ব্যাপারে সহায়তা করছেন৷ সবার সহায়তায় এই বিষয়টা অনেকটা কমে আসছে৷''

আপনার কোনো অভিজ্ঞতার কথা জানাতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান