1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সড়কে মৃত্যু: সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যে পার্থক্য

আজাদ মজুমদার ঢাকা
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশে এমন একটি দিন পাওয়া যাবে না সেখানে কোথাও না কোথাও ছোট বড় কোনো সড়ক দুর্ঘটনার খবর লেখা নেই। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছেন দেশের আনাচে-কানাচে এসব দুর্ঘটনায়। সব দুর্ঘটনার খবর যে পত্র-পত্রিকায় আসেও না।

https://p.dw.com/p/4a8Mi
বাংলাদেশে দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অনেক মানুষের প্রাণ যায়
কুমিল্লার একটি দুর্ঘটনা (ফাইল ফটো)ছবি: Rafiqul Islam

সড়ক দুর্ঘটনার খবর আজকাল অনেকটা গা সওয়া হয়ে যাওয়ায় বড় কোনো ঘটনা না ঘটলে এই খবর গুলো আজকাল আর গুরুত্ব দিয়ে পত্র পত্রিকায় ছাপাও হয়না। অন্যান্য গণমাধ্যমও যে এই খবর গুলোকে খুব গুরুত্ব দেয় তা-ও নয়। ফলে দুর্ঘটনার অনেক খবরই আড়ালে থেকে যায়। তৈরি হয় এক ধরনের তথ্য ঘাটতি, যে কারণে প্রায় কখনোই জানা সম্ভব হয় না সড়ক দুর্ঘটনার বাংলাদেশে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আসলে কত।

সরকারি পরিসংখ্যান এক্ষেত্রে ভরসাস্থল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে কেবল পুলিশের দেওয়া তথ্য উপাত্তের উপর নির্ভর করেছে। তাতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রকৃত মৃত্যুর চেয়ে অনেক কম পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে এটা মোটামুটি সবারই জানা সড়ক দুর্ঘটনার সব খবরই পুলিশে রিপোর্ট করা হয় না। ঘটনাস্থলে কারো মৃত্যু হলে পুলিশ হয়তো নিজ উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু দুর্ঘটনার পর হাসপাতাল কিংবা বাড়িতে কেউ মারা গেলে সেই হিসেব পুলিশের কাছে প্রায়ই থাকে না বলা চলে।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি সম্প্রতি নিজস্ব সূত্র ব্যবহার করে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য উপাত্ত প্রকাশ শুরু করছে। কিন্তু তাতেও ও গুরুতর তথ্য ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করা হয়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতো বেসরকারি যেসব সংস্থা এ ধরণের তথ্য দিয়ে থাকে তার সাথে সরকারি হিসেবের বড় একটা ফারাক থেকে যাচ্ছে।

বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহের মূল সূত্র গণমাধ্যম। তাতে যে সব খবর পাওয়া যায় না সেকথা আগেই বলা হয়েছে। তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার বাংলাদেশে আহত-নিহতের প্রকৃত সংখ্যা জানার আর উপায় কি? বিশেষজ্ঞদের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য-উপাত্তকেই ধর্তব্যের মধ্যে নিতে আগ্রহী।

বুধবার এক রিপোর্টে বিশ্বব্যাপি সড়ক দূর্ঘটনার একটা হিসেব প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কয়েক বছর পরপরই তারা এটা করে থাকে, যাতে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের হিসেব থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রতিবারই দেখা যায় সরকারের দেওয়া হিসেবের সাথে তাদের দেওয়া হিসেবের ব্যাপক তফাত।

২০১২ সালে সরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২,৫৩৮। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ২১, ৩১৬। এই হিসেবটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৫ সালে প্রকাশ করেছিল। ২০১৮ সালে এসে তারা আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় সরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা ২,৩৯৬ হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে এটি ২৪,৯৪৪। মৃত্যুর এই হার যে বেড়েই চলেছে এই চিত্র ফুটে আসে তাদের সর্বশেষ রিপোর্টটিও যা বুধবার প্রকাশিত হয়েছে।

এই রিপোর্টটিতে মূলত ২০২১ সালের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সরকারি হিসেবে ৫,০৮৪ জন মানুষ মারা গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে মারা গেছে ৩১,৫৭৮ জন। অর্থাৎ সরকারের তুলনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে পাঁচগুণেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার, যার দপ্তর মূলত সরকারি হিসেবটা প্রস্তুত করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য মানতে প্রস্তুত নন।

"আমরা রিয়াল ডাটা নিচ্ছি। আগে একসময় পুলিশি ডাটার উপরে আমাদের নির্ভরতা ছিল। এখন এক বছর ধরে আমরা নিজেরা ডাটা নিচ্ছি এবং প্রতিদিনের রিপোর্ট আমরা ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করছি, যদি কেনো গ্যাপ থাকে সেটার ব্যাপারে ও সবাইকে জানাতে বলছি। যদি কেউ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে আমরা সংশোধন করে নেব। প্রতিদিনের তথ্য আমরা প্রকাশ করছি। প্রতি মাস শেষে তথ্য আমরা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছি। শুধু প্রকাশ নয়, কেবিনেট থেকে শুরু করে পিএম অফিস সব জায়গায় আমরা এর অনুলিপি দিচ্ছি," বলেছেন তিনি।

"প্রতি মাসে আরো যারা কাজ করে আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন ওদেরও আমাদের সাথে হয়তো ৫০০-১০০০ তফাত হচ্ছে। ওইটাও যদি কনসিডার করি, কোথায় ৩১ হাজার? তাদের ( বিশ্ব স্বাস্থ্য

সংস্থার) বেইসটা কি। এ নিয়ে আমরা লেখালেখি ও করেছি, ডব্লিওএইচও কে আমরা লিখেছি, মিনিস্ট্রি থেকেও লেখা হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে এটা আমরা বুঝি না। আমাদের সাথে বসে শেয়ার করেন তথ্যসুত্র। আমরা বলেছি আপনারা আসেন, আমাদের সঙ্গে বসেন। কিন্তু তারা কিছু বলেনি। তারা বলেন যে আমাদের এটা ফর্মুলা, এটাতো রিয়াল ডাটা না, আমরা ইস্টিমেট করেছি। কোনো কিছু কেনাকাটার আগে আমরা ইস্টিমেট নেই। ইস্টিমেট নিলে যাতে কাছাকাছি আমরা কিনতে পারি। আপনাদের এটা যে ইস্টিমেট তা আমাদের সঙ্গে ধারে কাছেও নেই। এটা কি ইস্টিমেট, কিভাবে করেন। কিসের ফর্মুলা? এটা আমাদের কাছে ক্লিয়ার নয়," বলেছেন তিনি।

তবে এক্ষেত্রে যারা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ বিআরটিএ চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো: সামছুল হক বরং বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যকে আমলে নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তার মত অনুসারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে রিপোর্টটি দিয়েছে এটা বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভাবে করা হয়নি। তারা একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিসংখ্যান দিয়েছে যা সবদেশের জন্যই সমান ভাবে প্রযোজ্য, বলেছেন তিনি। "আমাদের দেশেও একবার ডিজি হেলথ এবং একটা প্রাইভেট অর্গানাইজেশন এটা বের করে। আমি এটা ২০১৮ এর কথা বলছি। ওরাও কিন্তু তখন ১৯,০০০-২০,০০০ পেয়েছে, পুলিশ ডাটা তখন ২,০০০," বলেছেন অধ্যাপক সামছুল হক।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মৃত্যুরই কোনো হিসেব রাখা হয় না। বাংলাদেশে বীমা ব্যবস্থা শক্তিশালী না হওয়ায় কেউ নিহত বা আহত হলে সাথে সাথেই উদ্ধারকারী যারা থাকেন আশে পাশে তারা তাদের নিয়ে যান, যার ফলে এগুলো কখনো ডকুমেন্টেড হয় না।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেকে মটর সাইকেল বা অনুমোদনহীন যানবাহন যেমন নসিমন, করিমন এগুলোকে  দায়ী করে থাকেন। অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন এদের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সড়কে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যার ফলে ঝুঁকির মাত্রাটা বেড়েছে।

"একসময় কিছুটা হলেও নসিমন, করিমন, ভটভটি সম্বন্ধে সরকার, কোর্ট, পুলিশ একটু সচেতনভাবে ব্যবস্থা নিত। এটা এখন ফ্রি স্টাইলে চলছে, জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে তাদের মবিলিটি বেড়েছে, গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, বাড়েনি সিস্টেম ড্রিভেন নিরাপদ সড়কের সুশৃঙ্খল অবস্থা," বলেছেন তিনি।

পুলিশের দেওয়া অসম্পূর্ণ তথ্যে সন্তুষ্ট থাকার বিপদটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। অসম্পূর্ণ জানার পরও তাৎক্ষনিকভাবে যেটা শোনা যায় সেটাই বাংলাদেশে ডকুমেন্ট করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞান বলে কম পক্ষে এক মাসের মধ্যে দুর্ঘটনাজনিত কারণে যদি কেউ মারা যায় সেটাও কিন্তু পরিসংখ্যানে আসবে। এটাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য মৃত্যু সংখ্যা। এই বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন,বাংলাদেশে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তারা এই অসম্পূর্ণ তথ্যে সন্তুষ্ট থাকেন কারণ এতে দেখানো যায় জাতিসংঘের দেওয়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত হয়ে যাচ্ছে।

"যদি কম মৃত্যু দেখানো যায় তাতে সরকারের জন্য ও ভাল হচ্ছে। সরকার এই অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যানই কিন্তু মহান পার্লামেন্টে বলেন এবং দুর্ঘটনা মাঝে মাঝে কমছে সে ধরণের সিগন্যাল দেন," তিনি বলেন।

সড়কে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও বিশ্ব স্বাস্থ্য দেওয়া তথ্য অনুসারে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এটা কমে আসছে। ২০১০ সালের তুলনায় মৃত্যুর হার কমেছে অন্তত ১০৮টি দেশে যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাও। বেলারুশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, ডেনমার্ক, জাপান, লিথুয়ানিয়া, নরওয়ে, রাশিয়া, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভেনিজুয়েলার মতো ১০টি দেশ তো মৃত্যুর হার অর্ধেকের বেশি কমিয়ে এনেছে।

বাংলাদেশে কেন মৃত্যু এত বেশি সেটা নিয়ে আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইন না মানার সংস্কৃতি কে মূলত দায়ী করা হলেও, সড়ক উন্নয়ন সহ আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা ও প্রাসঙ্গিক আরো অনেক কিছুতেই সরকারের দুর্বলতা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।