1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বপ্নহীন জগতে বেড়ে উঠছে ওরা

যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলের সাংবাদিক
যুবায়ের আহমেদ
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আকাশটা খোলা৷ কিন্তু জীবন বন্দি৷ সেই বন্দিজীবনে বেড়ে উঠছে রোহিঙ্গারা৷ কোথাও যাবার জায়গা নেই৷ অথচ পৃথিবী তাকিয়ে আছে অন্য দিকে৷

https://p.dw.com/p/4bxQm
রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ রফিক ছবি তুলছেন
প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটা স্থায়ী আশ্রয়হীন পৃথিবীতে বেড়ে উঠছে, এই পরিস্থিতির ইতি টানা দরকার- মনে করেন যুবায়ের আহমেদছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

২০২২ সালের আগস্টে আমি যখন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যাই, তখন আমার সঙ্গে কথা হয় ইব্রাহিম, মাহমুদা, জিয়া, তাসলিমাদের সঙ্গে৷ এরা রোহিঙ্গা৷ বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মতন হবে৷ তারা একটি প্রকল্পের অধীন শিক্ষামূলক ভিডিও কনটেন্ট বানানো শিখছেন৷ তাদের সঙ্গে লম্বা আলাপ হলো৷ ক্যাম্পের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা থেকে শুরু করে নানা ব্যাপারে সচেতনতামূলক ভিডিও বানান তারা৷ আর স্বপ্ন দেখেন একদিন কেউ রিপোর্টার হবেন, কেউ বা ফিল্মমেকার৷

তাদের কেউ ক্যাম্পের কঠিন গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে চান না৷ সুযোগ চান বাইরে গিয়ে কিছু করার৷ যখনই শোনেন, অ্যামেরিকা, ক্যানাডা, তুরস্কসহ দেশগুলো একটা সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের সেসব দেশে নিয়ে যাবেন, তাদের স্বপ্নভরা চোখ চকচক করে ওঠে৷ ঠিক জানেন না, তাদের এই স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কি না৷

২০১৭ সালের আগস্টের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে৷ মিয়ানমার মিলিটারি পোস্টে রোহিঙ্গারা আক্রমণ করেন এবং এরপর তাদের বিরুদ্ধে চলে সেনা অভিযান৷ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে পরের কয়েক মাসে দক্ষিণপশ্চিম সীমান্ত দিয়ে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ আসেন বাংলাদেশে৷ তখন বাংলাদেশে আসার জন্য তারা কী-না করেছেন৷ ভিটেমাটি সহায় সম্বল ছেড়ে এক কাপড়ে চলে এসেছেন৷ মূল লক্ষ্য ছিল জান বাঁচানো৷ কিন্তু এর ছয় বছর পর চিত্র এখন ভিন্ন৷

এখন তাদের মনে হচ্ছে, তাদের জীবন শেকলে বন্দি৷ না আছে নিজ দেশে ফেরার অধিকার, না আছে অধিকার ক্যাম্পের গণ্ডির বাইরের জগত পা রাখার৷ শিক্ষার অধিকার কেবল নির্দিষ্ট কারিকুলামে সীমাবদ্ধ৷ কাজের অধিকার তেমন একটা নেই৷ বিদেশি সংস্থার দয়ায় ক্ষুধা মেটে, মেটে তৃষ্ণা৷

তাহলে কী করবেন তারা? এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এদের কেউ কেউ কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন৷ যেই জীবনের আর কোনো মানে হয় না, সেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় সাগর পাড়ি দিতে চেয়েছেন তারা৷

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসেবে, ২০২৩ সালে ৪১টি নৌকায় ৪৪৯০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে সাগরে নৌকা ভাসান৷ উদ্দেশ্য ইন্দোনেশিয়া ও মালয়শিয়ায় পৌঁছানো৷ এদের দুই তৃতীয়াংশ ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছান৷

শুধু নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৯টি নৌকায় দেড় হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে পৌঁছান৷ তবে সবার অভিযান যে সফল হয় তা নয়৷ এক চতুর্থাংশকে মিয়ানমারেই আটকে দেয়া হয়৷ বাংলাদেশে আটকে যায় এদের ৫ শতাংশের যাত্রা৷ যারা সাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন তাদের ২৭ ভাগ নারী এবং ৩৮ ভাগ শিশু৷

তবে এর চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক নিয়তির শিকার হন কেউ কেউ৷ সাগরের বুকে মারা যান বা নিখোঁজ হন ৫৬৯ জন৷ শুধু তাই নয়, পৃথিবীর যেখানেই শরণার্থী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেখানে একটি ট্রেন্ড বা ধারা সব সময় দেখা যায়৷ প্রথম প্রথম যেসব দেশে তারা যান মানবিক সহায়তার হাত বাড়ায় সেখানকার মানুষ ও কর্তৃপক্ষ৷ পরে স্থানীয় মানুষ ও কর্তৃপক্ষের জন্য তারা বোঝা হয়ে দাঁড়ান৷ তখন তাদের প্রতি মনোভাব বদলে যায়৷ রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে৷ বাংলাদেশই তাদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় গ্রহণ করেছে ও জায়গা দিয়েছে৷ কিন্তু শুরুতে যে মানবিকতার বোধ ছিল, তা পরে বদলেছে নানা কারণে৷ ইন্দোনেশিয়াতেও তাদের আগমন বেড়ে যাওয়ায় তারা ‘পুশব্যাক' করছে৷ ভারত কখনোই তাদের গ্রহণই করতে চায়নি৷

ইন্দোনেশিয়ার এই বদলে যাওয়া মনোভাব আমাদের আরেকটি বিষয় মনে করিয়ে দেয়৷ তা হলো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার অভাব৷ বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে তাদের পরিস্থিতি যেমন খারাপ হচ্ছে, তেমনি জীবন বাজি রেখে নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে বেড়ানো রোহিঙ্গারা যাবার আর জায়গা পাচ্ছেন না৷ বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কোন ইতিবাচক অগ্রগতি না হওয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে৷

এখন মিয়ানমারে আবার পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে যাওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আদৌ সামনের দিকে এগোবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে৷ তবে পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কেমন করে মিয়ানমারকে চাপ দিতে পারে তা দেখা দরকার৷ এটা ইতিবাচক যে বাংলাদেশ চীন ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রত্যাবাসন বিষয়ে বৈঠক করছে৷ কিন্তু শুধু প্রত্যাবাসন নয়, তা যেন স্থায়ী হয় সেজন্য সবপক্ষকে একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে হবে৷ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলেই সেটি সম্ভব৷

ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও কমে গেছে৷ সবমিলিয়ে রোহিঙ্গারা, যাদের দেশ নেই, নেই ঘর, তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম একটা স্থায়ী আশ্রয়হীন পৃথিবীতে বেড়ে উঠছে৷ এই পরিস্থিতির ইতি টানা দরকার৷ তা না হলে ইব্রাহিম-তাসলিমাদের স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না৷ আর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্বপ্ন দেখার সাহসই করবে না৷

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য