1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়েছি

নোমান মোহাম্মদ
১২ ডিসেম্বর ২০১৯

২০১৬ এসএ গেমসের ভারোত্তলনে স্বর্ণপদক জয়ের মঞ্চে মাবিয়া আক্তার সীমান্তের সে কান্না কী ভোলা যায়! এবারের এসএ গেমসেও ভারোত্তলনে মেয়েদের ৭৬ কেজি ওজনশ্রেণীতে স্বর্ণপদক জিতেছেন। এরপর কাঁদেননি।

https://p.dw.com/p/3UgNA
ছবি: Khandakar Tarek

আনন্দমাখা প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ডয়েচে ভেলে তাঁর মুখোমুখি হবার পর মন খারাপ করা চমক। সাক্ষাৎকারটি পড়লেই বুঝবেন, নিজের ভেতরে কেমন এক আকাশ কান্না জমিয়ে রেখেছেন এই স্বর্ণকন্যা। অভিমান আর ক্রোধের। রাগ আর ক্ষোভের।

ডয়েচে ভেলে: গত এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের পর মঞ্চে আপনি প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাতে আবেগটা বোঝা যায় স্পষ্ট। আপনার কাছে সেবারের সঙ্গে এবারের স্বর্ণপদক জয়ের পার্থক্য কী?

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: প্রথমবার দায়িত্ব ছিল না, এবার অনেক দায়িত্ব। প্রথমবার একটা অচেনা মানুষ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। তার দারিদ্রতা, তার সংগ্রাম সব কিছু মিলিয়ে সে নতুনভাবে পরিচিতি পেয়েছে। সেবার দায়িত্ব ছাড়া একটা নতুন মানুষ নতুনভাবে পরিচিত হয়েছে। প্রথম আসলে প্রথমই। আমার স্বপ্ন ছিল দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। অপ্রত্যাশিতভাবে স্বর্ণপদক জিতে যাই। সেবারের গেমসে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদক আমার ছিল। জাতীয় সঙ্গীত বাজল। আর এবারের কথা বললে, অনেক দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছি। এবারের প্রাপ্তির ওজন অনেক বেশি।

দায়িত্বের কথা বারবার বলছেন। তো এই দায়িত্বের সঙ্গে চাপও কি চলে এসেছিল কিনা?

স্বাভাবিক। চাপ হওয়াটা স্বাভাবিক না যে, এত মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে? যদি তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারি, তাহলে আমার প্রতি সবার এত সমর্থন তো বিপক্ষে চলে যেতে পারে। আমার উপর বিশ্বাস থাকবে না।

চাপ ও দায়িত্ব জয় করে যখন স্বর্ণপদক জিতলেন, সে অনুভূতিটা কেমন?

ভালো লাগার কথা যদি বলেন, আমি কথা দিয়েছিলাম, নিজের জায়গাটি ছাড়ব না; তা ধরে রাখার জন্য লড়াই করে যাব; দেশকে ভালো একটা উপহার দেব। আমি তা দিতে পেরেছি। আর এবারের মঞ্চে সবাই আমাকে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থাতেই দেখেছেন। কারণ বলেছিলাম যে, এবার আর কাউকে কাঁদাব না।

এই আনন্দের মাঝেও একটি প্রশ্ন করতে চাই৷ গত এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের পর আপনি নিজের কিংবা ভারোত্তলনের উন্নতির জন্য যে যে চাহিদার কথা লেবলেছিলেন, তার অনেক কিছুই কিন্তু এখনও পূরণ হয়নি...

মাবিয়া আক্তার সীমান্ত

অনেক কিছু না, কিছুই পূরণ হয়নি। এখন দারিদ্রতার কথা যদি বলেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে হয়। উনি আমাদের একটি বাসস্থান দিয়েছেন। এর বাইরে এমন কোনো উপহার কারো কাছ থেকে পাইনি, যা উল্লেখযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ফ্ল্যাট দিয়েছেন। কারণ উনি ক্রীড়াকে ভালোবাসেন। আমাদের দেশের সরকারের যিনি প্রধান তিনি ক্রীড়াকে ভালোবাসেন; কিন্তু আর কেউ ভালোবাসেন না। এখানে একটা বিষয় না বলে পারছি না। এবারের এসএ গেমসে আমাদের সব ইভেন্ট মিলিয়ে স্বর্ণপদকের বহর অনেক। রেকর্ড ১৯টি স্বর্ণপদক জিতেছি। স্বর্ণপদক এমনি এমনি আসে না। আমি ২০১৬ সাল থেকে বলছি, একটা জিমনেসিয়াম, একটা জিমনেসিয়াম, একটা জিমনেসিয়াম চাই। কিন্তু এখনো আমাদের তা দিতে পারেনি। আমি এখানে কাউকে দোষারোপ করছি না। ভুল আমাদেরই। হয়তো ভারোলত্তনে আমরা ভালো পারফরম্যান্স দিতে পারছি না; সে কারণেই আমাদের দিকে নজর দিচ্ছেন না...

আপনারা আর কত ভালো পারফরম্যান্স দিবেন!

এটি মনে হয় এখনো ওনাদের চোখে ভালো পারফরম্যান্স হিসেবে গণ্য হয়নি।

তাহলে কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কি আপনারা অলিম্পিকে পদক পাবেন নাকি!

সেটিই ওনারা মনে করছেন। ২০১০ সাল থেকে তো এসএ গেমসে আমরা স্বর্ণপদক দিয়েই যাচ্ছি। এই গেমস আমাদের জন্য অলিম্পিকের মতো। সেজন্য খুব প্রস্তুতি নিই। কিন্তু সে প্রস্তুতিটা কি যথাযথভাবে নিতে পারি? দেখুন, ভারোত্তলনের আমরা এবার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি। বলেছি, স্বর্ণপদক দেব; দুটো স্বর্ণপদক দিয়েছি। সেটিও এই ছোট্ট একটি জিমনেসিয়াম থেকে। কিছুই পাইনি রে ভাই। ২০১৬ সালে এসএস গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের জন্য যে পরিমাণ আর্থিক পুরষ্কার ছিল, এখনো তাই আছে। ২০১০ সালে ৫ লাখ, ২০১৬ সালে ৫ লাখ, এখন ২০১৯ সালেও সেটিই। এই সম্মানির অর্থ বাড়ানো উচিত। যেসব ডিসিপ্লিনের খেলোয়াড়দের সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশকে ভালোভাবে প্রতিনিধিত্ব করার, তাঁদের নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করা উচিত। এসব চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন হলে বুঝব, পরিবর্তন হয়েছে। নইলে হবে না। আর জিমনেসিয়াম আমি চাইবই না। আমি শপথ করেছি যে, নিজের ডিসিপ্লিনের জন্য আর কিছু সুযোগ-সুবিধা চাইব না। কারণ চার বছর ধরে পাইনি। আমাদের ফেডারেশন টুকিটাকি, টুকিটাকি যোগাড়যন্ত্র করে যদি এসএ গেমস থেকে দুটি স্বর্ণপদক আনতে পারে, তাহলে এই টুকিটাকি ম্যানেজই থাক। কারো কাছ থেকে কিছু চাওয়ার দরকার নেই। আমরা তো পাচ্ছি না। তাহলে বারবার চেয়ে নিজেকে কেন ছোট করব?

এসব তো আপনার অভিমান ও রাগের কথা; সেটি খুব স্বাভাবিক। আপনার এই অভিমানের কারণে তো পরের প্রশ্নটি করারই সাহস পাচ্ছি না। তবু জানতে চাই এই নূন্যতম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যদি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হতে পারেন,তাহলে জিমনেসিয়াম, সঠিক ডায়েট, যথার্থ রুটিন-পরিকল্পনা, কোচ পেলে আপনাদের পক্ষে এশিয়ান কিংবা অলিম্পিক পর্যায়েও সাফল্য পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন কিনা?

আমি আমার ডিসিপ্লিন ভারোত্তলনের কথা বলছি। সাড়ে চার মাসের ক্যাম্প করে যদি এসএ গেমসে দুটি স্বর্ণপদক, পাঁচটি রৌপ্যপদক ও তিনটি ব্রোঞ্জপদক পাই, তাহলে চিন্তা করেন, দুই বছর, চার বছর প্রশিক্ষণ করালে আমরা কী দিতে পারি। এবারের এসএস গেমসে নেপাল কতোগুলো পদক পেয়েছে, হিসাব করে দেখুন। যে নেপালকে আমরা কখনো গোনায় ধরিনি, ওরা এখন অনেকে ক্ষেত্রে ভারতকে পর্যন্ত টপকে একটা ভালো জায়গায় চলে এসেছে। ওরা প্রতিটি ডিসিপ্লিনের খেলোয়াড়দের চাকুরি দিয়েছে; যা আমরা পারিনি। তো নেপালের অ্যাথলেটরাও এগুচ্ছে কিন্তু আমরা এগুচ্ছি না। কেন? আমাদের ক্রীড়াক্ষেত্রের যাঁরা মাস্টারপ্ল্যানার রয়েছেন, তাঁরা জানেন। আমি জানি না। সত্যিকারের সুযোগ-সুবিধাগুলো পেতে পেতে আমি হয়তো অবসরে চলে যাব। তবে এটি বলতে পারি, আমাদের যথার্থ ফ্যাসিলিটিস দিলে ভারোত্তলন কখনো হতাশ করবে না। কোনো দিন না।

শেষ প্রশ্ন। ২০১৬ সালে আপনি সাফল্যের চূড়ায় ওঠার পরের সময়টাও যদি ধরি, তাহলে কি এখন অবস্থাটা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে কিনা, যেখানে সাফল্যও আর সেভাবে উপভোগ করেন না? কিংবা এখন স্বপ্ন দেখতেও ইচ্ছে করে না?

স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা তো আমার নিজের। কারো কাছ থেকে কিছু পাবার পর স্বপ্ন দেখব- সে আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমি সবসময় বলি, অলিম্পিক হচ্ছে আমার স্বপ্ন। সে পর্যন্ত যাবার জন্য আমাকে চেষ্টা করে যেতেই হবে। এতটকুন স্বপ্ন তাই বাকি রাখছি। তবে ভারোত্তলনে আমাদের সুযোগ-সুবিধা দেবে, সে স্বপ্ন আর দেখি না। স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়েছি। কারণ চার বছর যাবৎ তো চেয়েই যাচ্ছি কিন্তু হচ্ছে না। সেজন্য ভেবেছি, আর স্বপ্ন দেখব না, কিছু চাইবও না। নিজের জন্য নিজে স্বপ্ন দেখব। আমি কথাটি এভাবে বলতে চাই, একটা জিমনেসিয়ামের জন্য এমন কারো দুয়ারে নেই যে যাইনি। আমি নাকি ২০১৬ গেমসে দেশকে প্রথম স্বর্ণপদক দিয়েছি, দেশের মান রক্ষা করেছি। তো আমার মান রক্ষার জন্য আমাকে কি একটি জিমনেসিয়াম দেয়া যেত না? অবশ্যই দেয়া যেত। কিন্তু আমি তা পাইনি। তবে দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, গণমাধ্যম, জনগণ আমাকে সমর্থন করেছে। তাঁদের জন্যই তো আমি স্বপ্ন দেখতে পারি। এবারের এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জিতে সে স্বপ্নপূরণ করেছি। অলিম্পিকে অংশ নিয়ে আমি হয়তো আপনাদের সবার সে স্বপ্ন আরেকবার পূরণের চেষ্টা করব।