1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সোচ্চার উন্নয়ন, অনুচ্চার উচ্ছেদ

গৌতম হোড়
১৩ নভেম্বর ২০২০

উন্নয়নের জন্য উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ৷ তারপর? তাঁদের সেই যন্ত্রণা ও লড়াই থেকে যাচ্ছে অগোচরে৷

https://p.dw.com/p/3lGnU
নন্দীগ্রামে জমি হারানোর আতঙ্ক সারা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল৷ (ফাইল ছবি)
নন্দীগ্রামে জমি হারানোর আতঙ্ক সারা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল৷ (ফাইল ছবি)ছবি: Prabhakar

যে যাই বলুন, উন্নয়নের মতো গোলমেলে বিষয় আর দুটো নেই৷ কার উন্নয়ন, কীসের উন্নয়ন এসব জটিল-কুটিল প্রশ্ন ছেড়ে দিন৷ উন্নয়নের মাসুলের দিকটা দেখুন৷ যা না কি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব চড়া৷ অন্তত যাঁরা সেই উন্নয়নের খাতিরে হারাতে বাধ্য হন নিজের ঘরবাড়ি, চাষের জমি, ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা গ্রাম, জঙ্গল বা শহর৷ উন্নয়নের স্বার্থে হঠাৎই যাদের চলে যেতে অন্যত্র৷ আর এই যাওয়া নিজের ইচ্ছায় নয়৷ নিজের ইচ্ছায় চাকরি নিয়ে বা ব্যবসার খাতিরে আমরা অনেকেই তো কত দূরে যাই, কখনো বিদেশে গিয়ে বসত করি৷ ইচ্ছে থাকলে আমরা আবার আমাদের জন্মের জায়গায় বা বেড়ে ওঠার পরিবেশে ফিরে যেতে পারি৷ উন্নয়নের জন্য উচ্ছেদ হওয়া মানুষেরা আর ফিরতে পারেন না৷ তাঁদের সেই জায়গা ডুবে যায় নবনির্মিত ব্যারেজ বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলে৷ অথবা তাঁদের বসতের জায়গায় শুরু হয়ে যায় খনি থেকে মিনারেল তোলার কাজ৷ অথবা তৈরি হয়, নতুন রাস্তা, রেললাইন বা কারখানা অথবা নতুন শহর৷ তাঁরা অনেক দূরে রুক্ষ জমিতে আবার বসত শুরু করেন বা দিনমজুরের কাজ নিয়ে ঘুরতে থাকেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়৷ উচ্ছেদের গল্প চলতে থাকে জীবনভর৷

এই উন্নয়নেরও কি কোনো দরকার নেই? অবশ্যই আছে৷ রাস্তা, মেট্রো রেল, কারখানা, শহরের বিস্তার, ব্যারেজ সবই জরুরি৷ কিন্তু সেই সঙ্গে জরুরি উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলির পুনর্বাসন৷ খাতায় কলমে অবশ্য যাঁদের জমি নিয়ে নেয়া হচ্ছে, তাঁদের জন্য উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সহ অনেক কিছু দেয়ার কথা থাকে৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সামান্য কিছু অর্থ পেয়ে তাঁদের চলে যেতে হচ্ছে নতুন আস্তানার সন্ধানে৷ তাঁরা অনেকেই জানেন না, ব্রিটিশ আমলের জমি অধিগ্রহণ আইনকে সংশোধন করে বাজারদরের চারগুণ দামে তাঁদের কাছ থেকে জমি কিনতে হবে৷ জমি নেয়ার আগে তাঁদের মত নিতে হবে সরকারকে৷ খাতায়-কলমে কত কীই তো লেখা থাকে৷ তাতে কি কিছু এসে যায়? কিছু ক্ষেত্রে যায়, কিছু ক্ষেত্রে নয়৷ মহারাষ্ট্রে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করতে না দেয়ার ফলেই তো মুম্বই থেকে আমদাবাদ পর্যন্ত বুলেট ট্রেনের কাজ থমকে আছে৷ ওড়িশার নিয়মগিরিতে আন্দোলনকারীরা রাহুল গান্ধীর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের যুবরাজের উদ্যোগে বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা, তাঁদের পাহাড়, তাঁদের বিশ্বাস৷ না হলে যে পাহাড়কে তাঁরা দেবতা বলে মানেন, তা এতদিনে গুঁড়িয়ে সেখান থেকে খনিজ উৎপাদন শুরু করে দিত বহুজাতিক সংস্থা৷ 

আর যারা পারেন না, তারা উচ্ছেদ হন৷ এরকম উচ্ছেদ হওয়া লোকের সংখ্যা কত? ভারতে সাড়ে চার হাজারের বেশি ব্যারেজ তৈরি হয়ে গেছে বা হচ্ছে৷ বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, একটা বড় বাঁধ তৈরি করার সময় গড়ে ১৩ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করতে হয়৷ আর দিল্লির কিছু সংস্থা যারা এ নিয়ে কাজ করে, তাদের মতে, ভারতে বড় ব্যারেজের ক্ষেত্রে ৪৪ হাজরের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ হতে হয়৷ এর সঙ্গে সরকারি হিসাব মেলে না৷ সরকারি হিসাবে ওড়িশায় হীরাকুঁদ বাঁধ তৈরির সময় এক লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে হয়েছিল৷ গবেষকরা বলছেন, সংখ্যাটা অন্তত এক লাখ ৮০ হাজার হবে৷ ফরাক্কার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা৷ বিশ্বব্যাংক বলছে, ৬৩ হাজারেরও বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করতে হয়েছিল৷ সরকার এই দাবি মানে না৷ গত ৭০ বছরে ভারতে বড় বড় যে অসংখ্য ড্যাম তৈরি হয়েছে, তাতে পাঁচ কোটির মতো মানুষ বাস্তুহীন হয়েছেন এবং অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে বলে গবেষকদের দাবি৷ এই হিসাব শুধু ড্যামের ক্ষেত্রে৷ এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্প, কারখানা, শহর তৈরি সহ উন্ননের ঢালাও ব্যবস্থার জন্য আরো অসংখ্য মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন৷

দেশভাগের সময় বাস্তুচ্যূত হয়েছিলেন এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ৷ মারা গিয়েছিলেন ২০ লাখের মতো৷ সেই মর্মান্তিক সময় নিয়ে সিনেমা, ডকুমেন্টারি হয়েছে, অসংখ্য বই লেখা হয়েছে৷ লেখা উচিতও৷  সেই নির্মম ঘটনার ডকুমেন্টেশন হওয়া খুবই জরুরি৷ কিন্তু এই যে শুধু ড্যাম বানাতে গিয়ে ৫ কোটি লোককে ভিটেমাটি হারাতে হলো, তাঁদের কথা ক'জন চিন্তা করে? তাদের নিয়ে কথা বললেই তো উন্নয়নবিরোধী থেকে শুরু করে জাতীয়তাবিরোধীর তকমা পড়ে যায়৷ অথচ, এই মানুষগুলি উচ্ছেদ হওয়ার পর কী অবস্থায় ছিলেন বা আছেন, তার কোনো খবরও সরকারের কাছে থাকে না৷ সম্ভবত সাম্প্রতিক সময়ে সব চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই করেছে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন৷ কিন্তু তারাও সফল হতে পারেনি৷

স্বাধীনতার পর একের পর এক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হয়েছে৷ সেখানে ঠিক হয়েছে কোন রাজ্যে কোন প্রকল্প নেয়া হবে৷ তার দায়িত্বে থেকেছে যোজনা কমিশন৷ সেই যোজনা কমিশনের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অমিতাভ রায়ের মতে, সমস্যা হলো, যাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তাদের জীবিকা নিশ্চিত করা হচ্ছে  কি না৷ জীবিকা নিশ্চিত করা হলে সমস্যা অতটা থাকে না৷ ভাকরা নাঙ্গাল বা মাইথন, পাঞ্চেতের ক্ষেত্রে সেই কাজটা করা হয়েছিল৷ পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশেই করা হয়েছে৷ কিছুদিন আগে অযোধ্যা পাহাড়ে একটা প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তা করা হয়েছে৷ কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি৷ যেখানে করা হয়নি, সেখানেই সমস্যা৷ তার মতে নর্মদার ক্ষেত্রে তো নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

উচ্ছেদ হওয়া লোকেদের তখন চলে যেতে হয় অনেক দূরে৷ কষ্টকর, নির্বান্ধব পরিস্থিতিতে৷ আর প্রতিটি প্রকল্পে তো শুধু ইঞ্জিনিয়ার, আইটি বিশেষজ্ঞই লাগে না৷ সাধারণ চাকরিতেও অনেক লোক নেয়া হয়৷ ফলে অনায়াসেই অধিকাংশ পরিবার থেকে একজনকে চাকরি দেয়া যায়৷

ইউপিএ আমলে ভূমি অধিগ্রহণ আইনকে খুবই কড়া করা হয়েছে৷ মোদী সরকার সেই আইনকে লঘু করার চেষ্টা করছে৷ কারণ, অভিযোগ হলো, শিল্প সংস্থা জমি অধিগ্রহণ করতে পারছে না৷ অভিযোগ হলো, জমি নিতে টাকা বেশি লাগছে৷ অনেক শর্ত পালন করতে হচ্ছে৷ এমন সব শর্ত যা পূরণ করা যায় না৷ ফলে শিল্প সংস্থার চাপ আইন লঘু করা হোক৷ তা হলে জমির মালিকদের কী হবে? নন্দীগ্রামে জমি হারানোর আতঙ্ক সারা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন ত্বরান্বিত হয়েছিল৷ কিন্তু সে হলো কলকাতা শহরের কাছের জমি৷ তা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ মিডিয়ায় উঠে আসে৷ ওড়িশার নিয়মগিরি বা গুজরাটের গ্রাম, ছত্তিশগড়ের প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকায় হলে সেই খবর হেডলাইন হয় না. হলেও তার স্থায়িত্ব একদিন৷

ফলে জমি হারান মানুষ৷ ক্ষতিপূরণ যেটুকু পান তা দিয়ে নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন করতে হয়৷ তারপর? সেই মানুষগুলির যন্ত্রণা ও জীবনযুদ্ধের কাহিনি কে মনে রাখে? দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ পদে সরকারি চাকরি করেছেন কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার৷ তাঁর অভিজ্ঞতা হলো, খাতায় কলমে সব আছে৷ পুনর্বাসন, নতুন জীবন শুরু করতে সাহায্য-- সব৷ আর এও সত্য, সরকারি খাতায়-কলমে থাকা ওই সুবিধাগুলি বাস্তুচ্যূত মানুষগুলির কাছে পৌঁছয় না৷

তাদের চোখের জল ও যন্ত্রণার কাহিনিও পৌঁছয় না আমাদের কাছে৷ কোটি কোটি মানুষ উচ্ছেদ হয়ে যান৷ দিল্লিরই ঘটনা৷ মেট্রো রেলের জন্য দোকান ভাঙতে হয়েছে৷ হয়ত দক্ষিণ দিল্লিতে দোকান ছিল৷ তাঁকে বিকল্প দোকানের জায়গা দেয়া হয়েছে নারেলার মতো অন্য প্রান্তে৷ তাঁর প্রতিবাদ, ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো দাম নেই৷ নারেলায় যেতেই হবে৷ এভাবেই উন্নয়নের মাসুল দিয়ে যান তাঁরা৷ মাঝে মাঝে নন্দীগ্রাম বা মহারাষ্ট্রে বুলেট ট্রেনের জমি নিয়ে আন্দোলনের কথা উঠে আসে সংবাদমাধ্যমে৷ হইচই হয়৷ তখন কাজ কিছুটা থমকে যায়৷ তারপর আবার যে কে সেই৷ সোচ্চার উন্নয়ন এবং অনুচ্চার উচ্ছেদের গল্প চলতেই থাকে৷