সেমাইয়ের গল্প শুনি
সেমাই ছাড়া ঈদ! এ তো ভাবাই যায় না! কারখানা থেকে খাবার টেবিলে আসার আগ পর্যন্ত উৎসবকেন্দ্রিক খাবারটির প্রস্তুত প্রণালি বেশ বৈচিত্র্যময়। চলুন দেখি ছবিঘরে৷
ঈদ খাবারের আইকন
দুধ, চিনি, বাদাম, এলাচ দিয়ে রান্না করা লাচ্ছা ও বাংলা সেমাই বাংলাদেশে ঈদ খাবারের আইকন। ঈদের দিন সকালে খাবার টেবিলে সুস্বাদু সেমাই পরিবেশন করা বাঙালির ঐতিহ্য। অতিথি আপ্যায়নে এর জুড়ি মেলা ভার।
সেমাই শব্দের গল্প
বাংলা অভিধানে ‘সেমাই’ শব্দকে কোথাও বলা হয়েছে হিন্দি, কোথাও দেশি। ভাষা পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, গ্রিক শব্দ ‘সেমিদালিস’ থেকে সেমাই শব্দের উৎপত্তি। সেমিদালিস অর্থ ময়দা। সেমিদালিস শব্দ সংস্কৃত ভাষায় ‘সমিদা’ রূপ ধারণ করে। সমিদা থেকে সেমাই, সেমিয়া, সেমাইয়া ইত্যাদি শব্দের উদ্ভব। সেমাইয়ের ইংরেজি নাম ‘ভারমিসেলি’। এটি ইতালীয় শব্দ ‘ভারমিয়েল্লি’র ইংরেজি রূপ।
লাচ্ছা সেমাইয়ের উৎপত্তি
ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ লাচ্ছা সেমাই। এর উৎপত্তি কোথায় এবং এই নাম কেন সেসব নিয়ে মতভেদ আছে। আরবি শব্দ ‘লম্বুতদার’ ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মুখে উচ্চারিত হতো ‘লাচ্ছাদার’। দুটি শব্দেরই অর্থ সুস্বাদু। তাই ধারণা করা হয়, লাচ্ছাদার থেকেই লাচ্ছা নামটি এসেছে। জনশ্রুতি আছে, ঢাকায় আগত অবাঙালি কিংবা আদি ঢাকাইয়ারা প্রথম লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে।
লম্বা বাংলা সেমাই
ঈদে লাচ্ছা সেমাই জনপ্রিয় হওয়ার আগে লম্বা সেমাই বেচাকেনা হতো বেশি। এর আরেক নাম ‘বাংলা সেমাই’। একসময় অতিথি আপ্যায়নে এর কদর ছিল বেশি। দাম কম হওয়ায় খোলা লম্বা সেমাই ছিল ঈদ খাবারের অন্যতম উপকরণ। তবে এখন লম্বা সেমাইয়ের চাহিদা খুব কম।
মণ মণ সেমাই
বাজারের চাহিদা পূরণে শহরের বিভিন্ন কারখানায় এখন দিন-রাত উৎপাদন চলছে। সেমাই কারখানার আয়তন এবং অর্ডার অনুযায়ী উৎপাদন নির্ভর করে। প্রতিদিন গড়ে একেকটি কারখানায় ২০ মণ পর্যন্ত সেমাই তৈরি করা হয়। কাঁচামাল হিসেবে থাকে প্রতি বস্তা ময়দা (৭৪ কেজি), মূল্য ৪ হাজার টাকা। ডালডার দাম কার্টন প্রতি (১৬ কেজি) ২ হাজার ৯০০ টাকা। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সেমাইয়ের দামও বেড়েছে।
যেভাবে তৈরি হয় সেমাই
এখন প্রায় সব কারখানায় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেমাই তৈরি হয়। এরপর প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করেন ব্যবসায়ীরা। প্রথমে সরু ফালি করে ময়দার মণ্ড কেটে রাখেন কারিগররা। সেগুলো গোলাকার করার পর লাচ্ছার খামি বানানো হয়। তেল ও ডালডা দিয়ে ভাজলে হয়ে যায় সেমাই। তারপর তেল ঝরাতে স্তূপ করে রাখা হয় কারখানায়। ঝরে পড়া গরম তেল আবারও চুলায় ঢেলে ভাজা হয় খামি।
কারিগর-শ্রমিকদের কথা
ঈদ উপলক্ষে উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে কারখানা। রমজানের কিছুদিন আগে থেকে এই পেশায় যুক্ত হয় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। ঈদ ঘনিয়ে এলে তাদের ব্যস্ততা বাড়ে। প্রতিদিন ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পারিশ্রমিক মেলে। প্রতিষ্ঠান ভেদে কেউ কেউ বেতনভুক্ত হিসেবে কাজ নেয়। ঈদকে কেন্দ্র করে মাত্র দুই মাস ব্যস্ত থাকেন সেমাই কারখানার শ্রমিকরা। বছরের বাকি সময় বিস্কুট, চানাচুরসহ অন্যান্য কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।
মৌসুমী ব্যবসায়ী
রাজধানীতে শতাধিক কারখানায় সেমাই তৈরি করা হয়। অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী সেমাই প্যাকেটজাত করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। তাদেরই একজন অ্যারাবিয়ান সুইট অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের স্বত্বাধিকারী হাফেজ মো. শাহ আলম। তার সেমাইয়ের কারখানা ঠাটারি বাজারের বি.সি.সি. রোডে। তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, করোনার পর ব্যবসা ভালো যাচ্ছে। চাঁদরাতের পরই ব্যবসা গুটিয়ে নেন তিনি।
তিন মাস বেচাকেনা
একসময় সারাবছর সেমাই বিক্রি হতো। কিন্তু এখন কেবল তিন মাস সেমাই বেচাকেনা হয়ে থাকে। রোজার ঈদের আগে দুই মাস ও কোরবানির ঈদের সময় এক মাস সেমাইয়ের চাহিদা থাকে। রমজান মাস এলে সেমাই তৈরির তোড়জোড় দেখা যায়। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এবারও সেমাই তৈরির ধুম পড়েছে।
বাড়িতেই সেমাই তৈরির কারখানা
পুরান ঢাকার ওয়ারী ভজহরি সাহা স্ট্রিট, কামরাঙ্গীরচর হারিকেন গলির সামনে মাজার রোড এবং দয়াগঞ্জে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সেমাই তৈরির অস্থায়ী কারখানা আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাতের আঁধারে এগুলোতে সেমাই উৎপাদন হয়। পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতকে কৌশলে ফাঁকি দিতে এই পন্থা বেছে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুরক্ষা ব্যবস্থার বালাই নেই
৭/৪ করাতিতোলা দয়াগঞ্জে হারুন মোরব্বা ঘর কারখানা দেখা যাচ্ছে ছবিতে। ময়দার মণ্ড কেটে যারা ফালি করেন এবং খামি বানান, তাদের হাত ও মাথায় কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। তীব্র গরমে কারিগরদের শরীরের ঘাম গড়িয়ে পড়ে ময়দায়। এভাবেই তৈরি হয়ে থাকে দুধরাজ লাচ্ছা সেমাই। পুরান ঢাকার জুরাইন ও মৌলভীবাজার এলাকায় বিভিন্ন পাইকারি ব্যবসায়ী এসব বিক্রি করে।
যন্ত্রের মাধ্যমে খামি
হারুন মোরব্বা ঘর কারখানায় দেখা গেল, শ্রমিকরা হাত দিয়েই খামি এদিক-ওদিক করছেন। তাদের পোশাক ও চারপাশের নোংরা পরিবেশ দেখে বাজার থেকে কেনা সেমাই কতটা স্বাস্থ্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। যদিও ঢাকার বেশিরভাগ কারখানায় এখন যন্ত্রের মাধ্যমে খামি করা হয়। সেমাই তৈরির এমন একেকটি যন্ত্রের দাম দেড়-দুই লাখ টাকা। মফস্বলে এখনও খামি তৈরির জন্য ময়দাকে পা দিয়ে মাড়ানোর কথা শোনা যায়।
যে কারণে বন্ধ অসংখ্য কারখানা
সেমাই উৎপাদনের অধিকাংশ কারখানার বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-র অনুমোদন নেই। ঢাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার লোভে মানহীন সেমাই তৈরিতে ময়দায় মিশিয়ে দেয় রঙ ও বিষাক্ত রাসায়নিক। তাছাড়া যত্রতত্র গড়ে ওঠা সেমাই কারখানায় নিম্নমানের পাম অয়েল ও ডালডা ব্যবহারের অভিযোগ তো পুরোনো। ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের কারণে অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
ক্রেতাদের ভাবনা
কেনাকাটার সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই উৎপাদনের ব্যাপার নিয়ে ভাবে না বেশিরভাগ ক্রেতা। তাদের কথায়, ঈদে অতিথি আপ্যায়নে সেমাইয়ের বিকল্প নেই। জুরাইন এলাকার একজন প্রবীণ ক্রেতা ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘খেতে তো হবে। আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের তো ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজির লাচ্ছা সেমাই কেনার সামর্থ্য নেই।’’
ঘি নয়, ডালডা...
খোলা লাচ্ছা সেমাই বিক্রির ক্ষেত্রে দোকানিরা ‘ঘিয়ে ভাজা’ কথাটি উল্লেখ করে থাকেন। এতে করে বিক্রি হয় বেশি। আদতে পাম অয়েল ও ডালডা ছাড়া সেমাই তৈরিতে অন্য কিছু ব্যবহার করা হয় না।
টুকরি টুকরি সেমাই
ঢাকায় একেকটি পাইকারি দোকানে প্রতিদিন ১০-২০ মণ সেমাই বিক্রি হয়। একেকটি টুকরিতে ৩৭ কেজি লম্বা সেমাই থাকে। এর মূল্য ১ হাজার ৮৫০ টাকা থেকে ১৯০০ টাকা। প্রতি টুকরিতে ২০ কেজি লাচ্ছা সেমাই থাকে। বর্তমানে এক টুকরি লাচ্ছা সেমাই ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সুদৃশ্য বাক্সে সেমাই
পুরান ঢাকার চকবাজারে সুদৃশ্য বাক্সে সেমাই বিক্রি হয়। আলাউদ্দিন সুইটমিটে প্রতিদিন কারখানা থেকে পাঁচ থেকে আট মণ সেমাই আসে। ৫০০ গ্রাম লাচ্ছা সেমাই ১৪০ টাকা, ২০০ গ্রাম বাংলা সেমাই ৪০ টাকা। লাচ্ছা স্পেশাল ৫০০ গ্রাম ২৮০ টাকা এবং ১ কেজির দাম ৫০০ টাকা। জাফরান, কাঠবাদাম, চেরি ফল, খেজুর, কিশমিশ দিয়ে বানানো আনন্দ বেকারির ভিআইপি লাচ্ছা সেমাই ৫০০ গ্রামের দাম ৮০০ টাকা।
হরেক রকম সেমাই
ঢাকাসহ সারাদেশে প্যাকেটজাত লম্বা সেমাই এবং লাচ্ছা সেমাই পাওয়া যায়। বনফুল, অ্যারাবিয়ান, কুলসম, অলিম্পিয়া, বোম্বে, প্রাণ, কিষোয়ান, ওয়েল ফুড, ফুলকলি ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই বেশি চোখে পড়ে। প্রতি কেজি খোলা বাংলা সেমাই ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং খোলা লাচ্ছা সেমাই ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের ১৮০ থেকে ২০০ গ্রামের প্যাকেট পাওয়া যায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়।