1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সুন্দরবন রক্ষায় ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৫ জুলাই ২০২১

নির্বিচারে গাছকাটা, নদীতে বাঁধ নির্মাণসহ নানা কারণে ধ্বংসের মুখে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল৷ সন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গের এক পরিবেশপ্রেমী৷

https://p.dw.com/p/3y0vJ
Indien - Kalkutta
১২ বছর সাড়ে ছয় লক্ষ ম্যানগ্রোভ রোপণ করেছেন উমাশঙ্কর মণ্ডলছবি: Payel Samanta/DW

ভূগোল পড়ান তিনি৷ পেশায় শিক্ষক হলেও সবাই তাকে ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’ নামে চেনে৷ নাম উমাশঙ্কর মণ্ডল৷ গত ১২ বছর ধরে সাড়ে ছয় লক্ষ ম্যানগ্রোভ রোপণ করেছেন৷ ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবসের প্রাক্কালে 'ম্যানগ্রোভ ম্যান' বললেন তাঁর পরিকল্পনার কথা৷  

আয়লা, আমফান ও তার পরবর্তী ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি করেছে৷ এমন দুর্যোগ মোকাবিলায় পরিবেশবিদরা বারবারই ম্যানগ্রোভ লাগানোর কথা বলছেন৷ খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ম্যানগ্রোভ রোপণের উপর জোর দিয়েছেন৷ কিন্তু এসবের বহু আগে থেকেই মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের উমাশঙ্কর মণ্ডল ম্যানগ্রোভ রোপণ ও পরিচর্যা করে চলেছেন৷ এ লক্ষ্যে ৪২ বছরের উমাশঙ্করের ‘পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটি' নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা  গড়ে তোলেছেন৷ স্থানীয়দের সহযোগিতায় ম্যানগ্রোভ রোপণের আদর্শ মডেল গড়ে তোলার পাশাপাশি এলাকার আর্থ সামাজিক ছবিটাই পাল্টে দিয়েছেন ম্যানগ্রোভ ম্যান৷  

বাস্তুতন্ত্র ও অর্থনৈতিক  উন্নতি 

উমাশঙ্কর বাড়ি সুন্দরবনের গোসাবার সাতজেলিয়া দ্বীপের চরঘেরিতে৷ ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আয়লার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর তিনি পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হন৷ সেসময় নদীতে ভেসে আসা ম্যানগ্রোভের বীজ সংগ্রহ করেন তিনি৷ স্থানীয় ২২০ জন মানুষকে একত্র করে বীজ ও গাছ লাগানোর বিপুল কর্মকাণ্ড শুরু করেন৷

উমাশঙ্কর ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘ম্যানগ্রোভ লাগানো ও পরিচর্যা দীর্ঘমেয়াদি কাজ৷ শুধু ভাটার সময়েই গাছ লাগানো যায়৷ প্রথমে সাড়ে ১০ হেক্টর জায়গাতে আমরা গাছ লাগাই৷  প্রাকৃতিকভাবে সেগুলি এখন বেড়ে চারগুণ হয়েছে৷’’

‘একক প্রচেষ্টা হিসেবে এটি সত্যিই প্রশংসনীয়’

বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের উমাশঙ্কর বরাবরই অর্থনৈতিক উন্নতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন৷ রাজকাঁকড়া, চিংড়ি, ভেটকি, ঝিনুক, সাপ ইত্যাদি বিভিন্ন জলজ প্রাণিদের বাসস্থান মানুষের অত্যাচারে ধ্বংস হতে বসেছিল৷ ম্যানগ্রোভ সৃজনে প্রাণিকুলের বসবাসের পরিবেশ ফিরিয়ে দিয়ে আদতে জনজাতির অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করছেন উমাশঙ্কর৷

ম্যানগ্রোভ লাগানোর জন্য তিনি যে মডেল তৈরি করেছেন সেটাও বেশ বৈচিত্র্যময়৷ স্থানীয় দরিদ্রদের দিয়ে তিনি ম্যানগ্রোভ লাগানোর প্রকল্পটি এগিয়েছেন৷ বিনিময়ে সেই মানুষদের হাতে শীতের কম্বল, স্যানিটারি ন্যাপকিন কিংবা পুজোর জামাকাপড় তুলে দিয়েছেন৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আর চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন৷ শিশুদের হাতে তুলে দিয়েছেন বইখাতা৷

এত বড় কাজে কীভাবে অর্থ জোগাড় হয়? ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থাৎ ব্যক্তি পর্যায়ের ছোট ছোট অনুদান সংগ্রহ করে তহবিল গড়ে তোলেন তিনি৷

বর্তমানে সোনাগাঁ এবং কাকমারি এলাকায় ম্যানগ্রোভ লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে৷ ২৬ জুলাই বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবসেও ১০ হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা উমাশঙ্করের৷  ম্যানগ্রোভ লাগালে আড়াইশো পরিবার পাবেন লেবু, চালতা ও সবেদার চারা৷

শুধু গাছ লাগিয়েই যে পরিবেশের উন্নতি সম্ভব নয় তাও বলছেন উমাশঙ্কর৷ ‘‘শুধু গাছের পেছনে টাকা খরচ করলে হবে না৷ মানুষের জীবনের উন্নতি ঘটাতে হবে৷ নইলে তাঁরা গাছের পরিচর্যা করতে আসবেন না৷’’     

‘লোভ আর প্রযুক্তির অপব্যবহারে ধ্বংস পরিবেশ’

এই উদ্যোগে সবস্তরের মানুষের প্রভূত সাড়া পেয়েছেন এ শিক্ষক৷ নিজের পরিবার সদস্যরা ছাড়াও সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে তার ছাত্রছাত্রীরা৷ এমন মহৎ চেষ্টার ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন ম্যানগ্রোভ লাগিয়ে সবুজ বনানী ফিরিয়ে আনার অনুপ্রেরণা৷

সুন্দরবন গবেষক অধ্যাপক জয়ন্ত গৌর বলেন, ‘‘উনি (উমাশঙ্কর) প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের খাবার, বইখাতা দিয়ে সাহায্য করেন৷ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে যখন যেখানে দরকার, সেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গাছ লাগান৷ অর্থনৈতিকভাবে মানুষকে সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নেন৷ একক প্রচেষ্টা হিসেবে এটি সত্যিই প্রশংসনীয়৷’’    

‘ম্যানগ্রোভ লাগানো ও পরিচর্যা দীর্ঘমেয়াদি কাজ’

মানুষের লোভ ও প্রযুক্তিকে পরিবেশের বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ী বলে মনে করেন পরিবেশের বন্ধু উমাশঙ্কর৷ ইউরোপ থেকে এশিয়া -- বিশ্বজুড়ে বন্যার পিছনেও এটাই কারণ বলে মত তার৷  

ম্যানগ্রোভ ম্যানের প্রশ্ন,‘‘প্রকৃতির উপর প্রযুক্তি এবং পরিকল্পনা প্রয়োগ করার আগে পরিবেশবিদ বা ভূতত্ত্ববিদদের সঙ্গে আলোচনা করা হয় না কেন? অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের জন্যই সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভের সংখ্যা কমে গিয়েছে৷ ইলিশ চোখে পড়ে না৷ জীবকুলের ক্ষতি হয়েছে’’

ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের জন্য সুন্দরবন অঞ্চলের অবৈধ ভেড়ি নির্মাণকে দায়ী করেন উমাশঙ্কর৷ তিনি বলেন, ‘‘সুন্দরবনের সুন্দরী গাছগুলি আগামী ২০ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে৷  এই ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়৷ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে দূষণ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে৷ এখনই যদি মানুষ পরিবেশ রক্ষায় সচেতন না হয়, তাহলে পরিণাম খুবই ভয়ঙ্কর হতে চলেছে৷’’