1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তারাশঙ্করের আঁতুড়ঘরের কী হবে?

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২০ মার্চ ২০১৮

সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতার বাড়িটির মালিকানা সম্প্রতি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের হাতে এসেছে৷ প্রোমোটারের গ্রাস থেকে রক্ষা করা হলো সেই বাড়িকে৷ কিন্তু, বীরভূমের লাভপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটে ও আঁতুড়ঘরের কী হবে?

https://p.dw.com/p/2ueJg
Tarashankar Bandyopadhyay
ছবি: DW/P. Samanta

হারিয়ে যাচ্ছে হেরিটেজ৷ অভিযোগ উঠেছে, উঁচু কংক্রিটের জঙ্গলে শহর কলকাতা নাকি ইতিহাসের দলিল প্রায়ই হারিয়ে ফেলে৷ এমনটা প্রায় হতেই চলেছিল, কিন্তু ঠিক সময়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর হস্তক্ষেপে বেঁচে গেল অমর কথাসাহিত্যিকের কলকাতার বাড়ি৷ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কলকাতার টালা পার্কের এই বাড়ি চলে যেতে বসেছিল প্রোমোটারের হাতে৷ সম্প্রতি সাহিত্যিকের পরবর্তী বংশধরদের কাছ থেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সোয়া দুই কোটি টাকায় বাড়িটি কিনে নেয়৷ নিমাই চট্টোপাধ্যায় নামে এক প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর উন্নতিকল্পে প্রায় ছ কোটি টাকা দান করেছিলেন৷ সেই টাকা থেকেই এই বাড়ি কেনা হয়েছে৷ আশা করা যায়, সাহিত্যিকের নানা স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়ি সম্ভবত অচিরেই পাঠকের তীর্থস্থল হয়ে উঠবে৷

কিন্তু, কেমন আছে তারাশঙ্করের পৈতৃক ভিটে? সেটা জানতে ডয়চেভেলে গিয়েছিল লাল মাটির দেশে৷ লাভপুর বাজারের মোড় থেকে যে রাস্তাটা সোজা স্টেশনের দিকে চলে গিয়েছে, সেটা ধরে বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হবে বলে দিলেন এক স্থানীয় বাসিন্দা৷ এই রাস্তা ধরে সোজা ১০ মিনিট এগোলে প্রথম পড়ে ‘ধাত্রীদেবতা'৷ সাহিত্যিকের উপন্যাসের নামেই হয়েছে নামকরণ৷ কেউ চিনিয়ে না দিলে চট করে বোঝার উপায় নেই এক পাড়ার অপ্রশস্ত পথের পাশে এটা তারাশঙ্করের স্মারক সংগ্রহশালা৷ এটিই ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়দের বৈঠকখানা ও কাছারিবাড়ি৷ এই সংগ্রহশালার দুটি ভবনে সাহিত্যিক ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী রাখা আছে৷ এখনও চোখে পড়ে ‘ধাত্রীদেবতা'র সেই প্রাচীন ফলক৷

বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়

সাহিত্যিকের কেদারা, চশমা, পাঞ্জাবী, ব্যাঙ্কের পাসবই থেকে লেখকের নিজের হাতে আঁকা রবীন্দ্র প্রতিকৃতি এবং কুটুমকাটাম এখানে সংরক্ষিত আছে৷ এই কাছারিবাড়ি-বৈঠকখানা বা ‘ধাত্রীদেবতা' থেকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই সেই বাড়ি যেখানে তারাশঙ্কর জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷ বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা একদিকে কয়েকটি সার দেওয়া মন্দির, তার উল্টোদিকেই যে ভিটে, তা পথিকের পক্ষে চেনা সম্ভব নয়৷ একটি কংক্রিটের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে একটি দোতলা পুরনো ধাঁচের বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ ওই বাড়ির দেওয়ালে কালিতে লেখা ছোট অক্ষরগুলো সহজে চোখে পড়ার কথা নয়৷ ‘গণদেবতা' বা ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা'র মাধ্যমে যিনি বাংলাসাহিত্যকে ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করেছেন, এটাই তাঁর বাড়ি ভেবে যে কোনও বাংলাভাষীর ধাক্কা লাগতে পারে৷ পরের মুহূর্তে চোখে ভাসতে পারে কলকাতার জোড়াসাঁকো, নৈহাটির বঙ্কিম ভবনের ছবি৷ কত যত্নে সেই দুই কবি-সাহিত্যিকের জন্মভিটে আগলে রাখা হয়েছে৷ কিন্তু লাভপুরের এক গ্রামে এমন নির্জন আর উপেক্ষিত কেন তারাশঙ্কর? সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্ন উঠে আসবে৷

পাকাবাড়ির দেওয়ালে সেই উপেক্ষার কথাই লিখে রেখেছে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার৷ পাকাবাড়ির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ডান দিকে সেই ২০০ বছরের প্রাচীন বাড়ি৷ একটি কালো দরজার পাশে ঝুলছে তারাশঙ্করের ছবি৷ সাহিত্যিকের ভাইপো বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এই ভিটে আগলে রেখেছেন৷ ওই কালো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ জোড়াসাঁকো বা বঙ্কিম ভবনের মতো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই, নেই নিত্য মানুষের আনাগোনা৷ অথচ কতই বা দূরত্ব লাভপুর আর বোলপুরের! যে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রস্মৃতিকে রক্ষা করা হয়েছে, কেন তাঁর ছিটেফোঁটাও নেই লাভপুরে? এই দায় কি গোটা বাঙালি জাতির নয়? আঁতুড়ঘরে তারাশঙ্করের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে যে কোনও বাঙালির এই গ্লানি বোধ একেবারেই অস্বাভাবিক নয়৷

বাড়ি অধিগ্রহণের বিষয়টি অনেক বড় হতেই পারে৷ একখানি তোরণ কি তৈরি করা যেত না, যা বিস্মৃতিপ্রিয় বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে? তারাশঙ্করের জন্মভিটে থেকে সামান্য দূরত্বে দেবী ফুল্লরার সতীপীঠ৷ বছরভর সেখানে পর্যটকদের আসা-যাওয়া৷ সেই মন্দিরের সামনেও রয়েছে একটা অতিকায় তোরণ৷ কিন্তু লাভপুর বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে সেই হাঁসুলিবাঁক, সে কথা বলে দেওয়ার কোনও তাগিদ নেই তারাশঙ্করের উত্তর-প্রজন্মের৷ অথচ ২০০ বছরের পুরনো এই মাটির বাড়িতে তারাশঙ্কর তাঁর প্রথম দিকের অধিকাংশ সৃষ্টি করেছেন৷ লিখেছেন একাধিক উপন্যাস৷ সাহিত্যিক তারাশঙ্করের তৈরি হওয়ার অনেকটাই এই বীরভূমের মাটিতে৷

রতন কুমার নন্দী

বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সাহিত্যিকের অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, ফুলশয্যা এখানেই হয়েছিল৷ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়ে এই বাড়ি থেকেই তিনি জেলে গিয়েছিলেন৷ বাবা, মা, পিসিমা ও কন্যা বুলুকে এই বাড়িতেই হারিয়েছেন তারাশঙ্কর৷ সেই বাড়ির কি এমন উপেক্ষা সাজে? বাসুদেবের বক্তব্য, ‘‘তারাশঙ্করের মৃত্যুর ৩৭ বছর পর এই গৃহকে রাজ্য সরকার হেরিটেজের স্বীকৃতি দেয়৷ সরকারের তরফে কাছারিবাড়ি-বৈঠকখানা সংরক্ষণ করা হয়েছে৷ তারাশঙ্করের উচ্চতা অনুযায়ী সরকারের এই উদ্যোগ পর্যাপ্ত কিনা সেটা বাংলা সাহিত্যের পাঠকরাই বিচার করুন৷''   

কলকাতার টালা পার্কের বাড়িটি যারা কিনলো, সেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ লাভপুরের বাড়িটি নিয়ে কী ভাবছেন? ডয়চে ভেলেকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সম্পাদক রতনকুমার নন্দী জানালেন, ‘‘লাভপুরের বাড়িটি সাহিত্যিক তারাশঙ্করের সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে ওঠার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় আসেন৷ সেই হিসেবে এই বাড়িটির ঐতিহাসিক মূল্য অনেকখানি৷ তবে কলকাতা থেকে লাভপুরের বাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর পক্ষে সম্ভব নয়৷ লাভপুরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে৷ ওরা কিছু করতে চাইলে অবশ্য কিছু করা যেতে পারে৷ আমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা ওখানে খুলতে পারি৷ স্থানীয় মানুষ এগিয়ে এলে তবেই তা সম্ভব৷''

লাভপুরে বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এখন এসব দেখাশোনা করছেন৷ কিন্তু তাঁর অবর্তমানে কী হবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, নৈহাটিতে সমরেশ বসু বা ব্যারিস্টার পি মিত্রের বাড়ির হদিশ নেই৷ টালা পার্কের মধ্যেই সজনীকান্ত দাস, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িও ক'জন চেনেন? এ সবের অধিকাংশই আজ বিয়েবাড়ি বা শপিংমলে পরিণত হয়েছে৷ রতনকুমার নন্দীর মতে, বাঙালির শেকড়চেতনার অভাবের জন্যই আজ এমন অবস্থা৷ আজকালকার প্রজন্ম বিদেশে গিয়ে চাকরিবাকরি করছে, নিজের শেকড়ের কথা মনে রাখছে না৷ ‘রসকলি'র স্রষ্টা নিজে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সভাপতি ছিলেন৷ আবার ‘আরোগ্য নিকেতন'-এর লেখকের নাতি অমলশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমানে পরিষৎ-এর সঙ্গে যুক্ত৷ সে কারণে সংস্কৃতিমনস্ক পরিবেশ পাওয়ায় পরিষৎ-এর পক্ষে এ বাড়ির অধিগ্রহণ করা সুবিধাজনক হয়েছে৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উদাসীন থাকে বাড়ির লোকজন৷ এই ইতিহাস বা ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব কি শুধু সরকারের? 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য