1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সরকারের নীতি নির্ধারণে মুনাফামুখী ভাবনা

ফয়সাল শোভন
১২ নভেম্বর ২০২১

বাড়তি জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়া মানুষের উপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এল জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি৷ এর সামগ্রিক অভিঘাত বিবেচনায় না নিয়ে তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির হিসাবই কি সরকারের কাছে বড় হয়ে উঠলো?

https://p.dw.com/p/42sf2
সাম্প্রতিক সময়ে চায়ের দোকানে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিছবি: Mortuza Rashed/DW

রংপুরের পীরগাছায় গোপাল গ্রামের একটি চায়ের দোকানে পাঁচ-ছয়জন কৃষকের আড্ডা জমে উঠেছে৷ সমস্যা বাধলো সেদিন দোকানদার চায়ের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়ায়৷ ইউপি নির্বাচন ছাপিয়ে আকষ্মিক এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তর্ক চললো৷ কৃষি কাজের বাড়তি খরচ, লাগামহীন বাজারদরসহ সামষ্টিক অর্থনীতিও বাদ গেল না৷ তাদের আলাপে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বললাম, ‘‘বাজারে দাম বাড়লে একদিক থেকে তো আপনাদের সুবিধা, কারণ আপনারা যা উৎপাদন করবেন তার বেশি বেশি দাম পাবেন৷’’ ফিরতি চাহনিতে বুঝলাম ভুল বলেছি৷ কৃষকরা যখন ফসল বেঁচতে যান তখন বাজারে দাম কম থাকে৷ ব্যবসায়ীরা কিনে পরে তা বাজারে তোলেন কয়েক গুণ বেশিতে৷ নিজেরা ফসল ফলিয়ে দেশের মানুষের খাবারের যোগান দিলেও তাদের ঘরেই তাই খাদ্যের টান পড়ে৷ বাজারের সরল এই সমীকরণটি তারা বুঝিয়ে বললেন৷ এটি মাসখানেক আগের কথা৷  

বাংলাদেশে গ্রাম বা শহর যেখানেই যান না কেন, কৃষক-শ্রমিক বা চাকরিজীবী যেই হোন না কেন, মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া সবার জন্যই বাজারদর এখন বড় মাথাব্যাথার কারণ৷ জীবনযাত্রার মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ সবখানেই৷ কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে৷

বাংলাদেশে দুইটি তথ্যসূত্র থেকে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ধারণা পাওয়া যেতে পারে৷ এর একটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির সূচক, অন্যটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টিসিবি বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দৈনিক বাজার দরের হিসাব৷ 

সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ে মানুষ হাঁসফাঁস করলেও পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেয় তা এক রহস্যই বটে৷ যেমন, গত সেপ্টেম্বরের হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৫.৫৯ শতাংশ৷ অর্থাৎ, আপনি এক বছর আগে যেই পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন এখন তার জন্য লাগবে ১০৫.৫৯ টাকা৷ এই হিসাবটিকে নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কয়জন বিশ্বাস করবেন? বিবিএস আগে প্রতি মাসের শুরুতে সংবাদ সম্মেলন করে মূল্যস্ফীতির ডেটা প্রকাশ করত৷ কিন্তু গত সরকারের মেয়াদ থেকেই এই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়৷ সরকারি এই সংস্থার পরিসংখ্যানবিদরা সাংবাদিকদের কাছে এখন সহজে মুখ খুলতে চান না৷

টিসিবির ঢাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দৈনিক খুচরা দরের তালিকা থেকে কিছুটা হলেও সাম্প্রতিক দাম বৃদ্ধির ধারণা পাওয়া যায়৷ যেকেউ ওয়েবসাইট থেকে সেটি দেখে নিতে পারেন৷ সেই হিসাবে তিন-চারজনের একটি পরিবারের দৈনিক খাবার কিনতে ৫০০ টাকাতেও টান পড়বে৷ অথচ এই সামর্থ্য দেশে কয়জনের আছে? সরকারি হিসাবে করোনার আগেই তিন কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র ছিলেন৷ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী করোনার সময়ে দুই থেকে তিন কোটি মানুষ নতুন করে সেখানে যুক্ত হয়েছেন৷

বিপরীতে, জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব দিয়ে সরকারের দাবি মানুষের আয় বাড়ছে৷ এই দুয়েরই প্রাক্কলন পদ্ধতিতে অনেক ফাঁক ও প্রশ্ন  আছে৷ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষের ফতুর হওয়া, সরকারি সেবা পেতে ঘুস লেনদেন কিংবা জনগণের করের টাকা শ্রাদ্ধ করে প্রকল্প ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সব কিছুই জিডিপি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে৷ অন্যদিকে করোনাকালে যখন বিপুল মানুষের আয় কমে গেছে সেই সময়ও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছে৷ অজান্তেই নাকি দেশের মানুষ 'বড়লোক' হয়ে যাচ্ছেন৷ পরিকল্পনামন্ত্রীর কথায়,’’...রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, আমরা টেরই পাচ্ছি না৷ আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি৷’’

Infografik Lebensmittelkosten BN

এই বড়লোক হওয়ার ‘সুবাদে’ সরকার সহজে আরেক দফা খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে জনগণের উপরে৷ অভিঘাতের কথা চিন্তা না করে কোন আলোচনা ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷

২০১৬ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যারেল প্রতি দাম ছিল ৪২ ডলার ৷ তখন বাংলাদেশে লিটারে ডিজেলের দাম ৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ করা হয়৷  দাম কমানোর পরও কয়েক বছর ধরেই আর্ন্তজাতিক বাজারের চেয়ে বেশি মূল্যে তেল বিক্রি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসি৷ এ কারণে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯০৪০ কোটি টাকা মুনাফা করে তারা৷ ২০১৬-১৭তে এসে মুনাফা দাঁড়ায় ৮৬৫৩ কোটিতে৷ এর পরের বছরগুলোতে বিপিসি গড়ে পাঁচ হাজার কোটির টাকার বেশি লাভ করেছে৷ সব মিলিয়ে আট বছরে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকায়৷ যেখানে ২০০৮-২০১৪ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৩৮ হাজার ৬৪৬ কোটি৷

ফয়সাল শোভন
ফয়সাল শোভন, ডয়চে ভেলে বাংলাছবি: Masum Billah

সরকারের সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া যেত যদি বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দর নির্ধারণ সবসময় আন্তর্জাতিক বাজারের উপরই নির্ভর করতো, যেমনটা ভারত করছে৷ কয়েক বছর টানা মুনাফা করে এখন দর বৃদ্ধির দুই-তিনমাস না যেতেই এবং লোকসানে পড়ার আগেই তড়িঘড়ি দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্তে স্বভাবতই তাই প্রশ্ন ওঠে৷ প্রশ্ন ওঠে সরকার জনগণের কথা কতটা চিন্তা করে৷ যেখানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানে পরিবহণ, বিদ্যুৎ, কৃষিশিল্প প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়া, যার যন্ত্রণাদায়ক আঁচ এরিমধ্যে মানুষ অনুভব করতে শুরু করেছে৷ 

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘সরকার আর কত ভর্তুকি দেবে? কিছুটা তো ভোক্তাদের শেয়ার করতেই হবে। সরকারকে আয় করে তারপর ব্যয় করতে হয়৷ যখন দাম কমে আমরা কমাই, যখন বাড়ে আমরা বাড়াই৷’’

অর্থমন্ত্রী এই বক্তব্য কোন কর্পোরেট হাউস বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বোর্ড সভায় দিলে বেশি মানাতো৷ রাষ্ট্রের লক্ষ্যতো আর মুনাফা অর্জন নয়৷ রংপুরের যেই কৃষকদের কথা শুরুতে বলেছি তাদের জন্য এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সেচের খরচের যোগান বড় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠছে৷ এই বাড়তি টাকা তারা কোথায় পাবেন? খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কিভাবে সামলাবেন? অর্থনীতির বিশেষ এই সময়ে মানুষকে স্বস্তি দিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের এগুনোর কথা৷ কিন্তু তার বদলে ব্যবসায়ীদের মতো তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির হিসাবই যেন সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ গত কয়েক বছরের নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনায় সেই প্রবণতারই ছাপ দেখা যায়৷ রাজনৈতিক দল, সংসদ কিংবা মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধাণ্য এর একটি বড় কারণ হয়ত৷

DW Mitarbeiterportrait | Faisal Ahmed
ফয়সাল শোভন ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷@FaisalShovon14