সরকারের নীতি নির্ধারণে মুনাফামুখী ভাবনা
১২ নভেম্বর ২০২১রংপুরের পীরগাছায় গোপাল গ্রামের একটি চায়ের দোকানে পাঁচ-ছয়জন কৃষকের আড্ডা জমে উঠেছে৷ সমস্যা বাধলো সেদিন দোকানদার চায়ের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়ায়৷ ইউপি নির্বাচন ছাপিয়ে আকষ্মিক এই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তর্ক চললো৷ কৃষি কাজের বাড়তি খরচ, লাগামহীন বাজারদরসহ সামষ্টিক অর্থনীতিও বাদ গেল না৷ তাদের আলাপে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বললাম, ‘‘বাজারে দাম বাড়লে একদিক থেকে তো আপনাদের সুবিধা, কারণ আপনারা যা উৎপাদন করবেন তার বেশি বেশি দাম পাবেন৷’’ ফিরতি চাহনিতে বুঝলাম ভুল বলেছি৷ কৃষকরা যখন ফসল বেঁচতে যান তখন বাজারে দাম কম থাকে৷ ব্যবসায়ীরা কিনে পরে তা বাজারে তোলেন কয়েক গুণ বেশিতে৷ নিজেরা ফসল ফলিয়ে দেশের মানুষের খাবারের যোগান দিলেও তাদের ঘরেই তাই খাদ্যের টান পড়ে৷ বাজারের সরল এই সমীকরণটি তারা বুঝিয়ে বললেন৷ এটি মাসখানেক আগের কথা৷
বাংলাদেশে গ্রাম বা শহর যেখানেই যান না কেন, কৃষক-শ্রমিক বা চাকরিজীবী যেই হোন না কেন, মুষ্টিমেয় ধনাঢ্য ব্যক্তি ছাড়া সবার জন্যই বাজারদর এখন বড় মাথাব্যাথার কারণ৷ জীবনযাত্রার মূল্যবৃদ্ধির উত্তাপ সবখানেই৷ কার খরচ কতটা বেড়েছে সেটি নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু এর আঁচে যে সবাই পুড়ছেন বাজারে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে৷
বাংলাদেশে দুইটি তথ্যসূত্র থেকে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ধারণা পাওয়া যেতে পারে৷ এর একটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত মূল্যস্ফীতির সূচক, অন্যটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টিসিবি বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দৈনিক বাজার দরের হিসাব৷
সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ে মানুষ হাঁসফাঁস করলেও পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেয় তা এক রহস্যই বটে৷ যেমন, গত সেপ্টেম্বরের হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৫.৫৯ শতাংশ৷ অর্থাৎ, আপনি এক বছর আগে যেই পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন এখন তার জন্য লাগবে ১০৫.৫৯ টাকা৷ এই হিসাবটিকে নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় কয়জন বিশ্বাস করবেন? বিবিএস আগে প্রতি মাসের শুরুতে সংবাদ সম্মেলন করে মূল্যস্ফীতির ডেটা প্রকাশ করত৷ কিন্তু গত সরকারের মেয়াদ থেকেই এই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়৷ সরকারি এই সংস্থার পরিসংখ্যানবিদরা সাংবাদিকদের কাছে এখন সহজে মুখ খুলতে চান না৷
টিসিবির ঢাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দৈনিক খুচরা দরের তালিকা থেকে কিছুটা হলেও সাম্প্রতিক দাম বৃদ্ধির ধারণা পাওয়া যায়৷ যেকেউ ওয়েবসাইট থেকে সেটি দেখে নিতে পারেন৷ সেই হিসাবে তিন-চারজনের একটি পরিবারের দৈনিক খাবার কিনতে ৫০০ টাকাতেও টান পড়বে৷ অথচ এই সামর্থ্য দেশে কয়জনের আছে? সরকারি হিসাবে করোনার আগেই তিন কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র ছিলেন৷ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী করোনার সময়ে দুই থেকে তিন কোটি মানুষ নতুন করে সেখানে যুক্ত হয়েছেন৷
বিপরীতে, জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব দিয়ে সরকারের দাবি মানুষের আয় বাড়ছে৷ এই দুয়েরই প্রাক্কলন পদ্ধতিতে অনেক ফাঁক ও প্রশ্ন আছে৷ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষের ফতুর হওয়া, সরকারি সেবা পেতে ঘুস লেনদেন কিংবা জনগণের করের টাকা শ্রাদ্ধ করে প্রকল্প ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সব কিছুই জিডিপি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে৷ অন্যদিকে করোনাকালে যখন বিপুল মানুষের আয় কমে গেছে সেই সময়ও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ে ‘শনৈ শনৈ’ উন্নতি হয়েছে৷ অজান্তেই নাকি দেশের মানুষ 'বড়লোক' হয়ে যাচ্ছেন৷ পরিকল্পনামন্ত্রীর কথায়,’’...রাত পোহালেই আয় বাড়ছে বাংলাদেশের, আমরা টেরই পাচ্ছি না৷ আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি৷’’
এই বড়লোক হওয়ার ‘সুবাদে’ সরকার সহজে আরেক দফা খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে জনগণের উপরে৷ অভিঘাতের কথা চিন্তা না করে কোন আলোচনা ছাড়াই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷
২০১৬ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের ব্যারেল প্রতি দাম ছিল ৪২ ডলার ৷ তখন বাংলাদেশে লিটারে ডিজেলের দাম ৬৮ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৫ করা হয়৷ দাম কমানোর পরও কয়েক বছর ধরেই আর্ন্তজাতিক বাজারের চেয়ে বেশি মূল্যে তেল বিক্রি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসি৷ এ কারণে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯০৪০ কোটি টাকা মুনাফা করে তারা৷ ২০১৬-১৭তে এসে মুনাফা দাঁড়ায় ৮৬৫৩ কোটিতে৷ এর পরের বছরগুলোতে বিপিসি গড়ে পাঁচ হাজার কোটির টাকার বেশি লাভ করেছে৷ সব মিলিয়ে আট বছরে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৪৩ হাজার ১৩৮ কোটি টাকায়৷ যেখানে ২০০৮-২০১৪ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৩৮ হাজার ৬৪৬ কোটি৷
সরকারের সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়া যেত যদি বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দর নির্ধারণ সবসময় আন্তর্জাতিক বাজারের উপরই নির্ভর করতো, যেমনটা ভারত করছে৷ কয়েক বছর টানা মুনাফা করে এখন দর বৃদ্ধির দুই-তিনমাস না যেতেই এবং লোকসানে পড়ার আগেই তড়িঘড়ি দাম সমন্বয়ের সিদ্ধান্তে স্বভাবতই তাই প্রশ্ন ওঠে৷ প্রশ্ন ওঠে সরকার জনগণের কথা কতটা চিন্তা করে৷ যেখানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানে পরিবহণ, বিদ্যুৎ, কৃষিশিল্প প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়া, যার যন্ত্রণাদায়ক আঁচ এরিমধ্যে মানুষ অনুভব করতে শুরু করেছে৷
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘সরকার আর কত ভর্তুকি দেবে? কিছুটা তো ভোক্তাদের শেয়ার করতেই হবে। সরকারকে আয় করে তারপর ব্যয় করতে হয়৷ যখন দাম কমে আমরা কমাই, যখন বাড়ে আমরা বাড়াই৷’’
অর্থমন্ত্রী এই বক্তব্য কোন কর্পোরেট হাউস বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বোর্ড সভায় দিলে বেশি মানাতো৷ রাষ্ট্রের লক্ষ্যতো আর মুনাফা অর্জন নয়৷ রংপুরের যেই কৃষকদের কথা শুরুতে বলেছি তাদের জন্য এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সেচের খরচের যোগান বড় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠছে৷ এই বাড়তি টাকা তারা কোথায় পাবেন? খাদ্য থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কিভাবে সামলাবেন? অর্থনীতির বিশেষ এই সময়ে মানুষকে স্বস্তি দিতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের এগুনোর কথা৷ কিন্তু তার বদলে ব্যবসায়ীদের মতো তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির হিসাবই যেন সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ গত কয়েক বছরের নীতিনির্ধারণ, পরিকল্পনায় সেই প্রবণতারই ছাপ দেখা যায়৷ রাজনৈতিক দল, সংসদ কিংবা মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধাণ্য এর একটি বড় কারণ হয়ত৷