1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ বনাম ‘ঘোড়ার ঘাস কাটা’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৪ ডিসেম্বর ২০২০

বাংলাদেশে এই সময়ে আলোচিত একটি বিষয় হলো সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ৷ ঘাস চাষ থেকে খিচুড়ি রান্না সব ধরনের প্রশিক্ষণেই এখন কর্মকর্তারা বিদেশে যান৷ এই ‘ঘোড়ার ঘাস কাটার’ প্রশিক্ষণে প্রজাতন্ত্রের কী লাভ? খরচই বা কেমন?

https://p.dw.com/p/3mDUI
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়
ছবি: bdnews24.com

বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের দুইভাবে বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওযার সাধারণ সুযোগ আছে৷ উচ্চশিক্ষা এবং কোনো প্রকল্পের বিশেষ কোনো কাজের জন্য জ্ঞান অর্জন৷ এর বাইরে মন্ত্রীদের সঙ্গে বিদেশ সফরেরও একটা সুযোগ থাকে৷ সেখানেও অনেক বড় বহর যায়৷ আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ সফরে সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীরাও সুযোগ পান৷

সর্বশেষ ঘাস চাষ, খাল খনন, পুকুর কাটা, খিচুড়ি রান্না, কাজু বাদাম চাষ এবং উঁচু ভবন দেখার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের প্রস্তাব নিয়ে শুধু সমালোচনাই নয়, বেশ মুখরোচক আলাপ হচ্ছে৷

বিদেশ সফরের অনুমোদন চূড়ান্তভাবে দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷ এর আগে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়ে একনেকে পাস হতে হয়৷ তাই প্রশ্ন উঠেছে এটা অনুমোদন হওয়ার সময় কেউ কি দেখেন না৷ জানা গেছে যারা এগুলো দেখবেন তারা বা তাদের আস্থাভাজন লোকেরাই এই সফরে অন্তর্ভুক্ত হন৷ আর এটাকে অনেক সময়ই বিবেচনা করা হয় উপহার বা সুযোগ সুবিধা হিসেবে৷ সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ দেয়া হয় কিছুটা রিফ্রেসমেন্ট, তাজমহল বা স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখার সুযোগ হিসেবে৷ আর উচ্চশিক্ষার জন্য যারা বিদেশ যান তাদের ওই শিক্ষা সরকারের কোনো কাজে লাগার উদাহরণ তেমন নেই৷

এই প্রশিক্ষণের জন্য সরকারের যে খরচ হয় তার জন্য বাজেটে আলাদাভাবে কোনো বরাদ্দের খাত নেই৷ প্রতিটি মন্ত্রণালয় সারা বছর খরচ করে আর বছর শেষে সম্পূরক বাজেটে তা পাস করিয়ে নেয়৷ কেন্দ্রীয়ভাবে জানার সুযোগ নেই যে কোনো একটি বছরে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে কত খরচ৷

তারপরও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ প্রশিক্ষণ বাবদ ৩০৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা খরচের একটি হিসাব পাওয়া যায়৷ আর ২০২২ সাল পর্যন্ত আরো ২২ কোটি টাকা খরচের প্রস্তুতি আছে৷ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই খরচ আসলে কোনো প্রকল্পের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে যাওয়ার খরচ নয়৷ এটা সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য খরচ৷ সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশে ডিপ্লোমা, মাস্টার্স ও পিএইচডি করার সুযোগ পান৷ এই খরচ তার জন্য৷ ওই সময়ে বিসিএস কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদেশে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন ৫৭৭ জন, ডিপ্লোমা ১৫৭ জন ও সংক্ষিপ্ত কোর্স করেছেন এক হাজার ৭১৭ জন৷ এই তথ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের৷

এই সময়ে আলোচিত ৩২ কর্মকর্তার ঘাস চাষের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব৷ প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের ‘প্রাণীপুষ্টির উন্নয়নে উন্নত জাতের ঘাসের চাষ সম্প্রসারণ ও লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তর’ নামের এই প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ১০১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা৷ এর মধ্যে উন্নত জাতের ঘাস চাষের জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২ জনের প্রত্যেকের জন্য ১০ লাখ টাকা৷ আর কাজু বাদাম চাষের প্রশিক্ষণ নিতে কৃষি বিভাগের ১৬ জন কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের খরচ ধরা হয়েছিলো ৫৪ লাখ টাকা৷

তবে সবার উপরে আছে খিচুড়ি রান্না প্রশিক্ষণ! এই প্রশিক্ষণে ‘প্রাইমারি স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম’-এর আওতায় এক হাজার কর্মকর্তার ভারতে যাওয়ার কথা ছিল৷ আর সেজন্য খরচ ধরা হয়েছিল পাঁচ কোটি টাকা৷ এই প্রকল্পেই আবার দেশে প্রশিক্ষণের জন্য চাওয়া হয়েছিল ১০ কোটি টাকা৷

বিদেশে সরকারি খরচে বিনোদন ভ্রমণ: হাফিজ উদ্দিন খান

জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে এপর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ৩৬টি বিদেশ সফর হয়েছে৷ এরমধ্যে উচ্চশিক্ষা ছাড়াও নানা ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষণের কর্মশালা রয়েছে৷ পিএইচডি করতে গেছেন একজন৷ ২০১৯ সালে সালে ৮৫টি এবং ২০১৮ সালে ৭৫টি৷ তবে এর মধ্যে প্রকল্পের জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণের তথ্য নেই৷
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত অডিটর এন্ড কম্পট্রোলার জেনারেল হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘‘বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা আসলে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে সরকারি খরচে বিনোদন ভ্রমণ৷ দেশের বাইরে গিয়ে পরিবারের জন্য শপিং, সাইট সিয়িং বা তাজমহল দেখা হচ্ছে৷ এটা সরকারি টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়৷’’

‘‘তবে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প ভিত্তিক যে কাজে আমাদের দক্ষতা নাই সেক্ষেত্রে যাদের প্রয়োজন তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো যেতে পারে৷ তবে তারা ফিরে এসে যাতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারে,’’ বলে তিনি৷

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানাগেছে অনেক প্রশিক্ষণই কোনো কাজে লাগে না৷ দেখা গেল অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো একজন উপ সচিবকে আধুনিক বাজেটিং নিয়ে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হল৷ দেশে ফির আসার পর তাকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলো৷ আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর সেই কর্মকর্তা অবসরে চলে গেছেন৷

অতিরঞ্জন আছে বলে আমার মনে হয়না: নঈম নিজাম

হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘‘দেশেই এখন ভালো প্রশিক্ষণ হয়৷ প্রয়োজনে আরো উন্নত ইন্সটিটিউট দেশেই গড়ে তোলা যায়৷ আর পিএইচডি করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দেশের বাইরে যাওয়ার দরকার নাই৷ এখানেই করতে পারেন৷’’ তিনি প্রশ্ন করেন, দেশের বাইরে এত প্রশিক্ষণ দেয়ার পরও বিদেশি পরামর্শক লাগছে কেন?

তবে এই প্রশিক্ষণ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে সরকারি পর্যায়ে সমালোচনাও আছে৷ তারা মনে করছেন মূল বিষয় না বুঝেই সংবাদমাধ্যম চটকদার হেডিং করে কাটতি বাড়াচ্ছে৷ তারা বলছেন খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে না বোঝার কারণে৷ এটা আসলে স্কুল পর্যায়ে মিড ডে মিলের পুষ্টি বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ৷ আর ঘাস চাষের বিষয়টিও অতিরঞ্জিত৷ মূল বিষয়টি হলো বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্পের উন্নয়ন৷

কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘‘সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে যে কয়টি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে সংবাদমাধ্যমে তা সঠিক ও তথ্যভিত্তিক৷ অতিরঞ্জন আছে বলে আমার মনে হয়না৷ সরকারি পর্যায়ে এটা মনে করা হলে তারাও কথা বলতে পারেন৷ তথ্য উপস্থাপন করতে পারেন৷’’