1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সবুজ বাজি, নাকি সোনার পাথরবাটি

স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
২ নভেম্বর ২০২১

দীপাবলিতে গ্রিন ক্র্যাকার ফাটানোর অনুমতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সবুজ বাজি কি আদৌ হয়, প্রশ্ন তুলছেন পরিবেশবিদেরা।

https://p.dw.com/p/42SlY
দীপাবলি
ছবি: AL9 - ArtLounge9

কালীপুজো এবং দীপাবলির সময় ভারতে বিপুল পরিমাণ বাজি ফাটানো হয়। যার জেরে দূষণের মাত্রা কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়। গত কয়েকবছর বাজি ফাটানো নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। আদালত বিভিন্ন রাজ্যে বাজি ফাটানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এবছরও কলকাতা হাইকোর্ট সবরকম বাজি ফাটানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সাম্প্রতিক রায়ে বলেছে, শুধুমাত্র গ্রিন ক্র্যাকার বা সবুজ বাজি ফাটানো যাবে। অর্থাৎ, পরিবেশবান্ধব বাজি ফাটানোর ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।

প্রশ্ন উঠেছে, পরিবেশবান্ধব বাজি কি আদৌ তৈরি করা সম্ভব? নামজাদা পরিবেশবিদদের মতে, সবুজবাজি আসলে সোনার পাথরবাটি। বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই।

সবুজ বাজি কী

ন্যাশনাল এনভারয়নমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি) একসময় সবুজ বাজি তৈরির পদ্ধতি জানিয়েছিল। যেখানে বেরিয়াম-সহ একাধিক বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। শব্দের মাত্রাও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। নিরি-র গবেষকেরা এমন বাজি তৈরি করে জানিয়েছিলেন, কেবলমাত্র ওই ধরনের বাজিই তৈরি করা যাবে। স্থির হয়েছিল, নিরি বিভিন্ন বাজি তৈরির কারখানাকে ওই ধরনের বাজি তৈরির ক্ষেত্রে সংশাপত্র দেবে। নিরির লোগো ব্যবহার করে ওই কারখানাগুলি সবুজ বাজি তৈরি করতে পারবে। এখনো পর্যন্ত নিরি ভারতের কতগুলি সংস্থাকে ওই সংশাপত্র দিয়েছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে বলে দাবি পরিবেশবিদদের। ফলে বাজারে আদৌ সবুজ বাজি আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

বাস্তব পরিস্থিতি

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, সবুজ বাজি বলে আসলে কিছু হয় না। অন্য বাজির তুলনায় সবুজ বাজিতে দূষণের মাত্রা সামান্য কমে। ফলে একে গ্রিন না বলে অরেঞ্জ বলা যেতে পারে। সাধারণ বাজি যদি লাল, অর্থাৎ চরম ক্ষতিকারক হয়, তাহলে নতুন ধরনের বাজি তার চেয়ে সামান্য কম ক্ষতিকারক বা কমলা মাত্রার বাজি। পরিবেশবান্ধব সবুজ হতে পারে না। সুভাষের কথায়, ''সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমি হতাশ। এতদিন ধরে বাজি এবং দূষণ নিয়ে যে আন্দোলন হলো, তা এর ফলে বড়রকম ধাক্কা খেলো।'' একসময় শব্দবাজি নিয়ে গোটা দেশে আন্দোলন করেছেন সুভাষ। বাজি এবং দূষণ সংক্রান্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সাবেক কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''একটা বড় রসগোল্লা না খেয়ে দুইটি ছোট রসগোল্লা খেলে শরীরে সুগারের মাত্রা কমে না। তেমনই একটি অতি দূষণ ছড়ানো বাজি না ফাটিয়ে দুইটি কম দূষণ ছড়ানো সবুজ বাজি ফাটালে পরিবেশ রক্ষা পায় না। এটা সহজ বিজ্ঞান। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আমি হতাশ।''

পরিবেশকর্মী নব দত্তের মতে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, তা আরো বড় চিন্তার। তার দাবি, অধিকাংশ বাজি তৈরির কারখানার সবুজ বাজি তৈরির লাইসেন্স নেই। কিন্তু এই সুযোগে তারা প্যাকেটে সবুজ বাজির লেবেল লাগিয়ে বাজারে ছেড়ে দেবে। মানুষও সেই বাজি কিনে যতখুশি পোড়াবে।

সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য জানিয়েছে, সবুজ বাজি ছাড়া অন্য কোনো বাজি পুড়লে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুভাষের বক্তব্য, সাধারণ মানুষ জানবেন কী করে, সবুজ বাজির লেবেল থাকলে মানুষ বুঝবেন কী করে, তার ভিতর সত্যিই সবুজ বাজি আছে কি না! পুলিশ যদি ধরেও তারা লেবেল দেখিয়ে দেবেন। আর ততক্ষণে দূষণ যা হওয়ার হয়ে যাবে।

সবুজ বাজির শংসাপত্র নিয়ে ধোঁয়াশা

বছরদুয়েক আগে নিরি জানিয়েছিল, তামিলনাড়ুর কয়েকটি কারখানাকে সবুজ বাজির সংশাপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কয়টি কারখানা তা পেয়েছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা যথেষ্ট। তারা আদৌ এখনো সেই বাজি বানাচ্ছে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়।

উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কথা ধরা যাক। সেখানে মোট নথিভুক্ত বাজি কারখানা আছে ৩৭টি। এছাড়াও অসংখ্য অবৈধ কারখানা আছে। একটিও নিরির সংশাপত্র পায়নি। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভ অর্গানাইজ়েশন (পেসো)-র শংসাপত্র পেয়েছিল মাত্র তিনটি কারখানা। অর্থাৎ, কোনো কারখানাই সবুজ বাজি তৈরি করতে পারে না। দিপাবলী এবং কালীপুজো আর মাত্র দুইদিন পরে। এত কম সময়ে কারও পক্ষে সবুজ বাজি তৈরি সম্ভব নয়। ফলে বেশি দূষণের বাজিই সবুজ বাজি হিসেবে বিক্রি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে উত্তরপ্রদেশের এক বাজি কারখানার কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ডিডাব্লিউ। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শব্দহীন বাজি তৈরি কার্যত অসম্ভব। বিস্ফোরণ না হলে বাজির ভিতর থেকে আলোর রোশনাই বেরনো সম্ভব নয়। আর আলোর রোশনাই হলে ধোঁয়া তৈরি হবেই। কারণ, বারুদ না পুড়লে রোশনাই হবে না। আর রঙিন রোশনাইয়ের জন্য রাসয়নিক ব্যবহার করতেই হয়। যে কোনো রাসয়নিকই দূষণ ছড়ায়। ফলে দূষণহীন বাজি হতে পারে না। আত্মপক্ষ সমর্থনে অবশ্য তিনি জানিয়েছেন, ''৩৬৫ দিন যদি গাড়ি, কারখানা থেকে কার্বন ফুটপ্রিন্ট তৈরি হতে পারে, তাহলে একদিন বাজি পোড়ানোর ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না কেন?'' স্বাভাবিকভাবেই সুপ্রিম কোর্টের রায়কে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন এবং নিরির গাইডলাইন মেনেই তারা বাজি তৈরি করেন বলে দাবি করেছেন।

বাজি কারখানার কর্মকর্তার বক্তব্যই আসলে পরিবেশবিদদের দুশ্চিন্তার কারণ। তাদের বক্তব্য, এমনিতেই দেশের বিভিন্ন শহরে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ। তার মধ্যে একদিনের বাজি পোড়ানো দূষণের মাত্রা যে জায়গায় নিয়ে যায়, তা স্বাভাবিক হতে বহুদিন সময় লেগে যায়। পরিবেশের উপর প্রভাব ভয়ংকর।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো