1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সব চাওয়া ও দুর্বল নৈতিকতার যোগফল ডিজিটাল দুর্নীতি

এ কে এম খাদেমুল হক
১ অক্টোবর ২০২১

ছোট বেলায় আমাদের স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে শোনা একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গল্পটা এমন, এক দল ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে যাদের ইহকালে ঘুস খাওয়ার অপরাধে নরকবাসের সাজা দেয়া হয়েছিল।

https://p.dw.com/p/419JN
প্রতীকী ছবিছবি: picture-alliance/dpa/S. Gupta

তো নরকের পাহারাদার ফেরেশতারা কিছুদিন পর আবিষ্কার করতে শুরু করলেন যে, নরকের পরিবেশটা কেমন যেন সহনীয় হয়ে উঠছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, নরকের শাস্তি ভোগ করতে করতেই সেই তিন ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু মিলে তাপমাত্রা শীতল করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছে। গল্পের মোরালটা হলো, বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে এমনকি নরককেও সহনীয় করে ফেলা সম্ভব।

মুদ্রার উল্টো পিঠের মতো এই গল্পের কাহিনীরও উল্টোটা ঘটতে পারে। ইদানিং বরং সেটাই ঘটছে বেশি করে! একুশ শতকের যাত্রা শুরু হয়েছিল যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতির হাত ধরে। সেই সূত্রে পুরো বিশ্ব যেন এখন হাতের মুঠোয়। সিকি শতাব্দী আগে ঢাকা শহরেই একটি টেলিফোন সংযোগ পাওয়া যেন ছিল সোনার হরিণ পাওয়ার মতো, এখন সেখানে মোবাইল ফোন না থাকাটাই যেন এক বিস্ময়। দেশের দরিদ্রতম পরিবারগুলোতেও অন্তত একটি মুঠো ফোন আছে। আর ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার হাজার মাইলের ব্যবধানকে উড়িয়ে দিয়েছে। আজ তাই বাংলার অজ পাড়া-গাঁয়ে বসে মুহূর্তেই যুক্ত হওয়া যাচ্ছে নিউ ইয়র্ক-লন্ডন-আবুধাবী-মক্কার সঙ্গে।

কিন্তু প্রযুক্তির এই বিপ্লব উপজাত হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে নতুন নতুন সমস্যা। প্রযুক্তি ভুল লোকের হাতে পড়ে হয়ে উঠছে রীতিমতো আপদ। গত কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়া বাংলাদেশের মতো শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা দেশে বড় ধরনের সামাজিক সংকট হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। বিশেষ করে ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে উগ্রবাদী ভাবনা প্রচার এবং এ ধরনের তথ্য ব্যবহার এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৃজন করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মোবাইল ফোনে তোলা ছবি বা ভিডিও বিভিন্ন অ্যাপ দিয়ে সম্পাদনা করে তৈরি করা হচ্ছে উত্তেজনা ছড়ানোর উপকরণ।

প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে মারাত্মকভাবে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকলেও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চলছিল। সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করলে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নানাভাবে অসদুপায় অবলম্বন করছে। এই প্রবণতা সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি কিংবা চাকুরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে। এসব পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে পরীক্ষার্থীদের উত্তর সরবরাহ করার ক্ষেত্রে অভিনব সব প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে প্রতি বছরই পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কারণ, দুর্নীতিবাজরা নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। কয়েকদিন আগে ভারতের রাজস্থানের একটি চাকরির পরীক্ষায় জুতোর সোলের ভেতর ব্লুটুথ ডিভাইস বসিয়ে কেন্দ্রের বাইরে থেকে সহযোগিতা নেয়ার একটি ঘটনা নজর কেড়েছে। বাংলাদেশেও এই ধরনের দুর্নীতির চক্র বেশ সক্রিয়। তারা কখনো ক্যালকুলেটরে, কখনো ঘড়িতে, এমনকি ক্রেডিট কার্ডের আকৃতির কার্ডের মধ্যেও ডিভাইস বসিয়ে কেন্দ্র থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে; তারপর বাইরে বসে থাকা এক্সপার্টদের দিয়ে মুহূর্তেই তার সমাধান করে নিয়ে ডিভাইসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই ধরনের জালিয়াতির একটি বড় ধরনের চক্রকে চিহ্নিত করেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর ভর্তিও বাতিল করা হয়েছে, কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।

কেন এমন হচ্ছে? অর্থনীতির চাহিদা ও জোগানের সূত্রটি দিয়ে এই প্রবণতার একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতে পারে। আসলে বাংলাদেশ, কিংবা ভারতের মতো দেশে চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। অল্প কিছু পদ পেতে লড়াই করে অনেক প্রার্থী, আর এই বিপুল চাহিদারই সুযোগ গ্রহণ করে প্রযুক্তি জানা অসৎ লোকেরা। এসব পরীক্ষায় সাফল্যের শর্ট কার্ট রাস্তা বের করে সেটা বিক্রি করে তারা আগ্রহীদের কাছে। বিপুল চাহিদার কারণে আগ্রহী মানুষ খুঁজে পেতেও অসুবিধা হয় না তাদের। আর সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই তো বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের মূল চালিকাশক্তি হলো চাহিদা, তাই তো বলা হয় নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অব অল ইনভেনশনস!

এই চাহিদাটা আবার ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাছে ভিন্ন রকম। তবে বাংলাদেশে ইদানিং সমাজের সকল ক্ষেত্রেই যেভাবে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে, আসলে তার হাত ধরেই বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার করে দুর্নীতির প্রবণতা। এর একটা বিপজ্জনক উদাহরণ হলো প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়া। পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এই পরীক্ষার প্রশ্ন নাকি লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে অগ্রিম। এখন ছয় বছর বয়সি শিশুরা তো আর লাখ টাকা দিয়ে এই প্রশ্ন কিনতে পারবে না; তাহলে কিনছে কারা? নিশ্চয়ই অভিভাবকরা। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফল নিয়ে অভিভাবকদের এই অসুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছড়িয়ে না পড়লে নিশ্চয়ই এই পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নের এত দাম হতো না। আর দাম না হলে, এই প্রশ্ন ফাঁস করার ঝুঁকিও নিতো না কেউ।

এ কে এম খাদেমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
এ কে এম খাদেমুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকছবি: Mohammad Rabbani

ডিজিটাল দুর্নীতি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে তাই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হতে পারে দুটি। প্রথমত, আকাশচুম্বী চাহিদাকে নামিয়ে আনা। অর্থাৎ, চাকরির ক্ষেত্রে বিকল্প তৈরি করা; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে চাহিদা অনুপাতে সুযোগ তৈরি করা। তেমনটা হলে হয়ত এমনিতেই দ্বিতীয় বিকল্পটির আর প্রয়োজন হবে না। তবে দ্বিতীয় বিকল্পটিও কম জরুরি নয়! সেটি হলো, জন মানসে নৈতিকতার পাঠ ঢুকিয়ে দেয়া। আর এটা শুরু করা দরকার স্কুল পর্যায় থেকে। জাপানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে গণপরিবহণ ব্যবহার করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে, যেন তারা গণপরিবহণ ব্যবহারের শিক্ষাটা হাতে-কলমে লাভ করে। এই পর্যায়েই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে আচরণের শিক্ষাটাও দেয়া হয় বলে জাপানিজরা জাতিগতভাবে এত ভদ্র। আর আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের লাখ টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে দেই! এই পদ্ধতিতে সাফল্য পেয়ে যারা বেড়ে উঠবে, বড় হয়ে তারা যে প্রযুক্তির শিক্ষা পেলে সেটাকে ভুল পথে ব্যবহার করতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক!