‘সন্ত্রাসীর ভূমিকায়’ কতিপয় পুলিশ

কর্তৃপক্ষ বার বার পুলিশ সদস্যদের অপরাধের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও অপরাধ প্রবণতা কমছে না৷

মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে চট্টগ্রামে ছয় পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তারা আব্দুল মান্নান নামে এক ঠিকাদারকে বাড়ি থেকে নিয়ে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পর ছেড়ে দেয়৷ ১০ লাখ টাকা দাবি করেছিল তারা৷

যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা হলেন চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনারের দেহরক্ষী কনেস্টবল মেরশেদ বিল্লাহ, ডিবির (পশ্চিম) উপ পুলিশ কমিশনারের বডিগার্ড কনস্টেবল মোহাম্মদ মাসুদ, এএসএফ শাখার কনস্টেবল আবদুল নবী, কনস্টেবল এসকান্দর হোসেন, কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম এবং কনস্টেবল শাকিল খান৷ মঙ্গলবার তাদের সবার দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত৷

গত ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তারা মোটর সাইকেলে চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার পূর্ব বৈরাগ গ্রাম গিয়ে আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে যায়৷ তারা নিজেদের পুলিশের লোক পরিচয় দেয়৷ একজনের গায়ে তখন ‘ডিবি’ লেখা জ্যাকেটও ছিল৷ এরপর আব্দুল মান্নানকে আটক রেখে মুক্তিপণ আদায় করে৷ ছাড়া পাওয়ার পর ওই  ব্যবসায়ী মামলা করলে তদন্তে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে৷ বৃহস্পতিবার অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়৷

পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ আগে এমন অপরাধে জড়ালেও পুলিশ কমিশনার ও গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনারের দেহরক্ষীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো অপকর্মে জড়ানোর ঘটনা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে৷

তবে এ বিষয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘‘আমার দেহরক্ষী বলে কিন্তু রেহাই দেওয়া হয়নি৷ অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার সাথে সাথে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ আর আমার দেহরক্ষী ২৪ ঘণ্টাতো আমার সাথে থাকে না৷ এটা ব্যক্তির অপরাধ৷ সে অপরাধী চক্রে জড়িয়ে পড়েছে৷’’ তিনি জানান, ওই ব্যবসায়ী কাউকে চিনতেন না৷ পুলিশই তদন্ত করে তাদের চিহ্নিত করেছে৷ এখানে তাদের কোনোভাবে ছাড় দেয়ার মানসিকতা কাজ করেনি৷

একইভাবে ২০১৯ সালে গাজীপুরে তিন বন্ধুকে অপহরণ করে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল৷ অপহরণকারী সেই পুলিশ সদস্যরা বলেছিল মুক্তিপণ না দিলে ক্রসফায়ারে দেয়া হবে৷

ওই ঘটনায় তখন গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুন ও মির্জাপুর থানার এএসআই মুসফিকুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়৷ তারা মুক্তিপণ দাবি করার কথা স্বীকারও করে৷ কিন্তু প্রত্যাহার করে নেয়া ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থার কথা পরে আর জানা যায়নি৷

২০১৭ সালের অক্টোবরে কক্সবাজারের টেকনাফে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন সাত পুলিশ সদস্য৷ পরে ব্যাবসায়ীর অভিযোগের ভিত্তিতে ওই পুলিশ সদস্যদের আটক করা হয়৷ তারা হলেন: এসআই মনিরুজ্জামান ও আবুল কালাম আজাদ, এএসআই ফিরোজ, গোলাম মোস্তফা ও আলাউদ্দিন এবং দুই কনস্টেবল আল আমিন ও মোস্তফা আজম৷

পুলিশ সদর দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ তবে এইসব ব্যবস্থার মধ্যে বদলিই বেশি৷ আর যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাদের ৯৫ ভাগেরও বেশি কনেস্টবল থেকে ইন্সপেক্টর পদের পুলিশ সদস্য৷

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান সৈয়দ বজলুল করিম মনে করেন, ‘‘পুলিশ সদস্যদের একাংশ তাদের উপরস্থ কর্মকর্তাদের কারণে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷ তারা একটি সিন্ডিকেটের মতো কাজ করে৷ সবাইকে ভাগ দেয়৷ আর কিছু আছে বার বার পার পেয়ে যাওয়ার কারণে বেপরোয়া হয়ে ওঠে৷ এইসব ঘটনায় শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থায় ফল আসে না৷ তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করে শাস্তির মুখোমুখি করা দরকার৷’’ তার মতে, পুলিশ সদস্যদের অপরাধের বিরুদ্ধে যতই জিরো টলারেন্সের কথা বলা হোক না কেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এই অপরাধ প্রবণতা কমবে না৷

পুলিশে যারা অপরাধ করেন, তারা সাধারণভাবে বদলি, প্রত্যাহার বা সাসপেন্ডের মতো বিভাগীয় ব্যবস্থার মুখোমুখি হন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, ‘‘চাকরি থেকে বাদ দেয়ার পর তাদের বিচারের মাধ্যমে জেল জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘পুলিশে অপরাধের সুযোগ বেশি৷ তাই এতদিন যে প্রচলিত ব্যবস্থা দেখে আসছি, তাতে কাজ হবে না৷ পুলিশ সদস্যরা তো ডাকাতি করতে গিয়েও ধরা পড়েছে৷ ঢাকায় একজন বড় পুলিশ কর্মকর্তাও এক ব্যবসায়ীকে আটক করে দুই কোটি টাকা নিয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা তো আমরা জানি না৷’’

পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘‘যতই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক না কেন কিছু লোক তো অপরাধপ্রবণ থাকবেই৷ একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে৷ সেখানে আমরা দেখার চেষ্টা করছি আমাদের পদ্ধতিগত কোনো ভুল বা ত্রুটি আছে কিনা৷ তবে যদি কঠোর শাস্তি দেয়া হয় তাহলে সেটা একটা মেসেজ দেয়, তাতে অপরাধ কমে৷’’

তিনি মনে করেন, জিরো টলারেন্স নীতির কারণেই পুলিশের অপরাধ প্রবণতা কম৷ তা না হলে আরো বেশি হতো বলেও তিনি মনে করেন৷