সত্যজিৎ রায়: শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ
জন্ম ১৯২১ সালের ২ মে। মৃত্যু ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে এই মহান স্রষ্টাকে ডিডাব্লিউর শ্রদ্ধার্ঘ।
সত্যজিতের পরিবার
ঠাকুর্দা উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী। শিশু সাহিত্যিক, চিত্রকর, বাংলা ছাপখানার পুরোধা, সুরকার। বাবা সুকুমার রায় ছিলেন শিশুসাহিত্যিক ও বাংলায় ননসেন্স ছড়া, কবিতা ও গদ্যের জনক। কাকা সুবিনয় বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। পিসি সুখলতা রাও ও পুণ্যলতা চক্রবর্তী শিশু সাহিত্যিক। সত্যজিতের বয়স যখন দুই বছর চার মাস, তখন সুকুমার মারা যান।
স্কুল ও কলেজ
সত্যজিতের পৈত্রিক আদিবাড়ি ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের মসুয়া গ্রামে। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর থাকতেন কলকাতায় গড়পারে। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সত্যজিৎ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের গড়পারের বাড়িতে। তারপর মায়ের সঙ্গে চলে আসেন মামাবাড়ি ভবানীপুরে। সেখানে থেকেই সাড়ে আট বছর বয়সে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি হন। স্কুল শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইকনমিক্স নিয়ে পড়া।
রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন
সুকুমার রায়কে অসম্ভব ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। সত্যজিৎ মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলায় যান বছর দশেক বয়সে। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আসেন অটোগ্রাফের খাতা। রবীন্দ্রনাথ তাতে লিখে দেন আট লাইনের বিখ্যাত কবিতা 'বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে..'। কলেজের পরে মায়ের জোরাজুরিতে শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। সেখানে নন্দলাল ও বিনোদবিহারীর সান্নিধ্য ভারতীয় চিত্রকলা সম্পর্কে তার চোখ খুলে দেয়।
চাকরির সূত্র ধরে
১৯৪৩ সালে শান্তিনেকতন থেকে কলকাতা এসে তিনি চাকরি নেন ব্রিটেনের বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার-এ। জুনিয়ার ভিসুয়ালাইজার। বেতন ৮০ টাকা। কিন্তু পরে তিনি যোগ দেন সিগনেট প্রেসে, যেখানে তার কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। বিভূতিভূষণের 'আম আঁটির ভেপু'-র অলঙ্করণ করতে গিয়ে তিনি আকৃষ্ট হন পথের পাঁচালির প্রতি। ঠিক করেন, সিনেমা করলে প্রথম ছবি হবে পথের পাঁচালি'।
রেনোয়ার সঙ্গে পরিচয়
বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্তের সঙ্গে সত্যজিৎ তৈরি করেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। প্রচুর বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ হয় তার। ১৯৪৯ সালে রেনোয়া কলকাতায় আসেন তার 'দ্য রিভার' শুটিং করার জন্য। সত্যজিতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। রেনোয়ার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হন সত্যজিৎ। ঝোঁকেন পরিচালনার দিকে। পরে 'বাইসাইকেল থিফ' দেখার পর সিদ্ধান্ত নেন পরিচালক হবেন। উপরের ছবিতে রেনোয়া ডানদিকে।
কেন পথের পাঁচালি
১৯৫৭ সালে অমৃত বাজারে একটা লেখায় সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ''আমায় হামেশাই এই প্রশ্ন শুনতে হয়, কেন পথের পাঁচালি? সত্যি ও সহজ উত্তর হলো, বাংলা উপন্যাসের মধ্যে এটই সিনেমা করার সব চেয়ে উপযুক্ত বই।'' সত্যজিতের মতে, ''অনেকে অভিযোগ করেন, আমার সিনেমায় ছবি ও ডকুমেন্টারির দিকটা বেশি। আমার জবাব, দুইটিই আমি বিভূতিভূষণের কাছ থেকে পেয়েছি।''
পথের পাঁচালি তৈরির গল্প
প্রায় তিন বছর ধরে তৈরি হয়েছিল পথের পাঁচালি। কারণ অর্থাভাব। ১৯৫২ সালের শেষদিকে সত্যজিৎ নিজের জমানো টাকা দিয়ে শুরু করেন পথের পাঁচালি তৈরির কাজ। সঙ্গে আনকোরা ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র ও শিল্প নির্দেশক বংশীচন্দ্র গুপ্ত। যখন অর্থ জোগাড় করতে পারতেন, তখনই শুটিং হতো। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্যে ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালি তৈরি শেষ হয়। উপরের ছবিটি বোড়াল গ্রামের, যেখানে পথের পাঁচালির শুটিং হয়।
শুধু ইতিহাস
পথের পাঁচালির দৌলতে ভারতের চলচ্চিত্র চলে গেল বিশ্বের আঙিনায়। সারা বিশ্ব জানলো, বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের সিনেমা তৈরি করেছেন ছয় ফুটের উপর লম্বা এক বাঙালি পরিচালক। আর ভারতীয় সিনেমায় আইকন হয়ে গেল একটা দৃশ্য, মাঠের উপর দিয়ে কাশবনের পাশ দিয়ে ছুটছে অপু ও দুর্গা ট্রেন দেখবে বলে। অবশেষে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন আসা। ভাই-বোনের অবাক চোখে ট্রেন দেখা। এই সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রবিশঙ্কর।
আন্তর্জাতিক সম্মান
পথের পাঁচালি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল, রোমে ভ্যাটিকান পুরস্কার, ম্যানিলায় গোল্ডেন কারবাও, বার্লিনে গোল্ডেন লরেল। তাছাড়া এডিনবরা, নিউ ইয়র্ক, স্টুটগার্ট, স্যান ফ্র্যান্সিসকো সহ অনেক উৎসবে পুরস্কার পায় পথের পাঁচালি।
অপরাজিত ও অপুর সংসার
দুই বছর পর সত্যজিৎ করলেন পথের পাঁচালির পরের পর্ব 'অপরাজিত'। ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পেল এই ছবি। সত্যজিৎ প্রথমে ট্রিলজির কথা ভাবেননি। ভেনিসে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এই ভাবনা আসে। তার ফসল 'অপুর সংসার'। বড় অপুর ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপর্ণার ভূমিকায় এলেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিতের সিনেমায় সব চেয়ে বেশি অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন সৌমিত্র।
জলসাঘর, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা
এই তিনটি ছবিই সত্যজিৎ করেছিলেন ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে। তিনটি তিন ধরনের ছবি। জলসাঘরের পড়ন্ত জমিদার, দেবীতে কুসংস্কারগ্রস্ত শ্বশুর যিনি তার পুত্রবধূর পুজো করেন কালী-জ্ঞানে এবং কাঞ্চনজঙ্ঘায় উচ্চবিত্ত পরিবারের কর্তা। কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিচালক ও প্রযোজক এবং লেখক সত্যজিৎ রায়। উপরের ছবিটি দেবীর।
চারুলতা
রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় উপন্যাস সত্যজিতের হাতে হলো চারুলতা। উনিশ শতকের এক বাঙালি বউয়ের নিঃসঙ্গতা ও তার ঠাকুরপো অমলের সঙ্গে সম্পর্কের কাহিনি। চারুলতার ভূমিকায় মাধবী এবং অমল হলেন সৌমিত্র। সত্যজিৎ বলেছেন, চারুলতায় তিনি সব চেয়ে কম ভুল করেছেন। আবার বানাতে হলে ঠিক ওইভাবেই বানাতেন।
নায়ক
মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে মাত্র দুইটি সিনেমা করেছেন সত্যজিৎ। নায়ক এবং চিড়িয়াখানা। অনেকের মতে, নায়কেই জীবনের সেরা অভিনয় করেছিলেন উত্তম। এক সিনেমার নায়কের এক দিনরাতের কাহিনি। তার আশা, আকাঙ্খা, ভয়, উদ্বেগ, ভাবনার গল্প। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অন্য ধারার অনবদ্য ছবি। এখানে উত্তম কুমারকে কোনো মেক আপ নিতে দেননি সত্যজিৎ।
গুগাবাবা
ঠাকুর্দার লেখা, নাতির পরিচালনায় সিনেমা। গুপী গায়েন বাঘা বায়েন। ছোটদের জন্য সত্যজিতের মজার ছবি। তার সব চেয়ে হিট ছবি। এরপরের পর্বে তিনি 'হীরক রাজার দেশে' করেছিলেন। যার ছত্রে ছত্রে রয়েছে স্বৈরচারী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে রঙ্গব্যাঙ্গের কষাঘাত।
হিন্দিতে সত্যজিৎ
সত্যজিৎ বাংলাতে ছবি তৈরি করতে পছন্দ করতেন। তার পছন্দের শহর ছিল কলকাতা। চিরজীবন কলকাতার ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি হিন্দিতে একটি সিনেমা ও একটি টিভির জন্য ছোট ছবি করেছিলেন। দুইটিই মুন্সি প্রেমচন্দ্রের কাহিনি। সতরঞ্জ কি খিলাড়ি এবং সদগতি। উপরের ছবিতে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাঙালির পোশাকে সত্যজিৎ।
ফেলুদাকে নিয়ে
নিজের লেখা গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদাকে নিয়ে দুইটি সিনেমা করেছেন সত্যজিৎ। সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ। বাংলা সিনেমায় গোয়েন্দা কাহিনি কেমন করে করা যায়, তা তিনি দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তবে সন্তোষ দত্ত মারা যাওয়ার পর তিনি ফেলুদার সিনেমা আর করেননি। সত্যজিৎ চলে যাওয়ার পর কবীর সুমন ফেলুদার গান লেখেন, জটায়ুকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সত্যজিৎ।
শেষ পর্ব
ঘরে বাইরে ছবি করার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হন সত্যজিৎ। তার পরের নয় বছর অনেক কম কাজ করেছেন। সেটাও ছেলে সন্দীপের সহযোগিতায়। এরপর গণশত্রু, শাখা প্রশাখা ও আগন্তুক। তখন তিনি আউটডোরে বেশি যেতে পারেন না। স্টুডিওর সেট নির্ভর সিনেমা। তাই কিছু দুর্বলতা ছিল। কিন্তু বিষয় বৈচিত্রে শেষ দুইটি ছবিতে দেখা গেছে প্রতিবাদী সত্যজিৎকে। উপরে ছবিতে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি, যেখানে থাকতেন সত্যজিৎ।
লেখক সত্যজিৎ
তার ফেলুদা ও শঙ্কু চরিত্র বাঙালি ছেলেমেয়েদের কাছে অন্যতম প্রিয় চরিত্র। তিনি সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘকাল। সেখানে প্রচুর লিখেছেন। তার লেখা গল্প বিষয়বৈচিত্রে অনন্য। তাছাড়া সিনেমা নিয়ে প্রচুর লেখালিখি করেছেন।
অস্কার
মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসাবে অস্কার পান সত্যজিৎ রায়। পেযেছেন ভারতে সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নও। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন। উপরের ছবিতে সত্যজিৎকে শ্রদ্ধার্ঘ পুত্র সন্দীপের।