1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সংকটের মুখে সার্কাস শিল্প

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৫ জানুয়ারি ২০১৯

সার্কাসের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে বহুদিন৷ তবুও হাতি, ঘোড়া, কুকুর, পাখি নিয়ে এই শিল্পের অস্তিত্ব টিকেছিল৷ সম্প্রতি বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের খসড়া নীতিতে বন্যপ্রাণের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় আরো সঙ্কটে সার্কাস৷

https://p.dw.com/p/3B33R
ছবি: DW/P. Samanta

বন্য জন্তুদের নিয়ে খেলা দেখানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পরপরই মাথায় হাত পড়েছিল বহু সার্কাস দলের৷ বাঘ, সিংহের গোত্রের পশু সার্কাসের মঞ্চ থেকে বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বহু সার্কাসের দল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ অনেক সার্কাসের দল বন্ধ না হলেও অর্থসঙ্কটে ভুগছিল৷ এরকম পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার সার্কাস বা ভ্রাম্যমাণ বিনোদনে অন্যান্য পশুপাখির ব্যবহারও বন্ধ করতে চাইছে৷ সরকারের এই খসড়া নীতিকে পশুপ্রেমী সংগঠন পিইটিএ বা পেটা-র মতো আরো অনেক সংগঠন স্বাগত জানিয়েছে৷ এদিকে সরকারের এই সিদ্ধান্তে রাতের ঘুম উবে গেছে সার্কাস দলের কর্তৃপক্ষের৷ ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকা এই শিল্প যে আদতে বিলোপের পথে এগোচ্ছে, সে কথা বলছেন অনেক সার্কাস শিল্পীই৷ 

'আমাদের অবস্থা একদমই শেষ হয়ে গেছে'

৫৬ বছরের প্রাচীন অজন্তা সার্কাস তাঁবু ফেলেছে কলকাতার উত্তর শহরতলির সিঁথির মোড়ে৷ শো চলাকালীন গিয়ে দেখা গেল, ২০ শতাংশ আসনে দর্শক উপস্থিত৷ বাকি আসনগুলি ফাঁকাই পড়ে আছে৷ ম্যানেজার সঞ্জীব ঘোষাল বললেন, ‘‘আমাদের অবস্থা একদমই শেষ হয়ে গেছে৷ ধুঁকতে ধুঁকতে যে কোনোদিনই বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ এমনই দুরবস্থা৷ লোকই হতে চায় না এখন৷ অথচ আগে যখন সব পশু ছিল, তখন একটা সিটের জন্যও কত অপেক্ষা থাকত মানুষের!''

৩২ বছর এই পেশার সঙ্গে যুক্ত এই সার্কাসপ্রেমী মানুষটি৷ তাঁর মতে, ‘‘শিশুরা বাঘ-সিংহ কোথায় দেখবে বলুন তো! চিড়িয়াখানা তো কলকাতায় একটি৷ অথচ আমরা ঘুরে ঘুরে কত জায়গায় নিয়ে যাই পশুদের৷ মানুষ কত সহজে এদের দেখতে পায়৷ অথচ এখন কিছুই ব্যবহার করতে দেবে না৷ সার্কাস শিল্পের আর কিছু থাকবে না!''

একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে সার্কাস শিল্পের সর্বনাশ দেখছেন সার্কাসের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা৷ অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে পশু অধিকার রক্ষা নিয়ে সরব সংস্থা পিইটিএ ৮ হাজার স্বাক্ষরসমৃদ্ধ একটি চিঠি পাঠিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে৷ এই চিঠিতে স্কুল-কলেজ পড়ুয়ার পাশাপাশি রয়েছে বিশিষ্টদের নামও৷ পেটা-র তরফে অভিযোগ তোলা হয়েছে, ২০১৩ সালে সারা ভারত জুড়ে ১৬টি সার্কাস দলে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে যে, হাতি, ঘোড়া, উট, কুকুর, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীদের উপর নির্যাতন চালানো হয় নিয়মিত৷ মদ্যপ সার্কাস কর্মচারী সার্কাসের পশুপাখিদের সঙ্গে ঠিকঠাক ব্যবহার করেন না৷ সার্কাসগুলিতে দেখা গিয়েছে, অঙ্কুশ দিয়ে হাতিকে মারা হয়, পশুদের দীর্ঘক্ষণ শেকলে বা খাঁচায় বন্দি রাখা হয় এবং সর্বোপরি পশুপাখিরা উপযুক্ত ও পরিশ্রুত জল ও খাদ্য, নিরাপদ ও পরিষ্কার বাসস্থান, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত৷ 

এমনকি বিশেষজ্ঞদের মতে, চিড়িয়াখানাতেও নিঃসঙ্গ পশুপাখিকে রাখার নিয়ম নেই৷ সার্কাসে যেভাবে পশুপাখিদের রাখা হয়, সেটাও নিয়মবিরুদ্ধ৷ এতে পশুর উপর মানসিক চাপ তৈরি হয়৷ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সঞ্জীব ঘোষাল বলেন, ‘‘বনে-জঙ্গলে থাকলে এসব পশুপাখির লড়াই করে খাবার জোটাতে হতো৷ আমরা খাবার দিই, অসুখ করলে পশু চিকিৎসক দেখাই৷ এখানকার পশুরা কি আর শিকার করে খেতে পারে!'' পশুপাখিদের উপর নির্যাতনের প্রসঙ্গে সঞ্জীব বলেন, ‘‘আপনার বাড়িতে শিশু থাকলে আপনি তাকে শাসন করেন না? সে পড়তে না চাইলে বা আপনার কথা না শুনলে আপনি কি তাকে বকবেন না? তেমনি সার্কাসেও জন্তু-জানোয়াররা কথা না শুনলে শাসন করা হয়৷ তাকে নির্যাতন বলা যায় না৷'' 

কলকাতার আরেক বিখ্যাত দল ফেমাস সার্কাস৷ এই দলের সঙ্গে যুক্ত সজল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০০১ সাল থেকে আমাদের সিংহ, বাঘ, বাঁদর, ভালুক তুলে দিল৷ তারপর বহু কষ্টে চালিয়েছি৷ উজ্জীবিত করার জন্য বিদেশিদের নিয়ে এসেছি৷ সেটাও বন্ধ করে দিলো৷ তারপর হাতিও বন্ধ করে দিলো৷ অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে৷ কীভাবে চালাবো? আমাদের কোনো ভাতা নেই৷ সরকারি সাহায্যও নেই৷''

মানুষ সব প্রাণীর ওপর আধিপত্য করছে বলেই সব পশুপাখিকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রাখা মানুষের দায়িত্ব৷ নইলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না৷ বিশেষজ্ঞরা এমনটা মনে করেন৷ অস্ট্রিয়া, বলিভিয়া, কোস্টা রিকা, গ্রিস, মেক্সিকো, পোল্যান্ডের মতো দেশগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই দেশগুলির সার্কাসে কোনো পশুপাখি ব্যবহৃত হয় না৷ সেখানে সার্কাসে মানুষই উপজীব্য৷ খসড়া নীতি কার্যকর হলে ভারতও ওই দেশগুলির সারিতে চলে আসবে৷     

প্রাণিপালন ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক ড. শুভ্রাংশু পান ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘বন্যপ্রাণের অধিকারকে লঙ্ঘন করেই সার্কাসে খেলা দেখানো হয়৷ এটা সত্যি৷ পশুপ্রেমীরা বিশ্বব্যপী নজরে রাখছেন এসব৷ বন্যপ্রাণের ক্লেশ কমাতেই সার্কাসে পশুপাখির খেলা বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে৷''

যদিও সার্কাস দলের ম্যানেজার সঞ্জীবের বক্তব্য, ‘‘অনেক জায়গায় সার্কাস নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, কোথায় কোনো অভিযোগ ওঠেনি৷ বয়স হলে পশুপাখি মারা যাবে, সেটা নির্যাতন নয়৷ শরীর থাকলে অসুখ করবেই৷ আজ সার্কাসে জন্তু বন্ধ করে দেওয়ার মতো এমন কিছু হয়নি৷'' সঞ্জীবের মতো আরেক সার্কাস কর্মী বাদল বেরা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ এখনো জীবজন্তু দেখতে চায়৷ সেটা না দেখাতে পারলে সার্কাস চলবে কী করে?'' 

‘বন্যপ্রাণের অধিকারকে লঙ্ঘন করেই সার্কাসে খেলা দেখানো হয়’

একদিকে পশুপ্রেমী সংগঠনদের দাবি আর অন্যদিকে সার্কাস শিল্পীদের বিরোধিতা, এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের কী বক্তব্য? দর্শকদের আসন থেকে বরাহনগরের পূর্বা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এত তো বুঝি না৷ সার্কাসে জন্তু-জানোয়ার দেখতে ভালোই লাগে৷ তারা পীড়িত কিনা সেটা জানি না৷ সেটা হওয়া অবশ্যই উচিত নয়৷ সার্কাসে জন্তু দেখতেই আসি৷ সেটা না দেখালে সবাই আসবে কিনা জানি না৷''

পশুর ব্যবহার শুধু সার্কাসে নয়, অন্যত্রও হচ্ছে৷ বিশেষত পুলিশ বাহিনীতে কুকুরের ব্যাপক ব্যবহার হয়৷ এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ডঃ পান বলেন, ‘‘সার্কাসে জনসাধারণের মনোরঞ্জনের জন্য পশুপাখিদের যে কাজগুলো করতে বলা হয়, তা তাদের শরীরের বায়ো মেকানিজমের পক্ষে অনুকূল নয়৷ অথচ পুলিশের কুকুর যে কাজটা করে, তা তার সহজাত প্রবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে করানো হয়৷ কিন্তু সার্কাসে হাতিকে যখন একটা বলের উপর বসতে বলা হয়, সেটা তার শরীরের মেকানিজমের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়৷ তাই সার্কাসে পশুপাখি বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে৷''