ভরসা গির্জা
৩০ মে ২০১৩সিরিয়া থেকে আসা এই পরিবারটি বছর খানেক আগে হামবুর্গের প্রটেস্টান্ট গির্জার একটি যুবকেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে৷ এই বাসস্থানটির নামধাম গোপন রাখা হয়েছে৷ কেননা গির্জার যাজক বির্গিট ডুসকোবা চরম ডানপন্থিদের হামলার আশঙ্কা করেন৷ এখানে নানা জাতি ও সংস্কৃতির লোকজন বাস করেন৷ বির্গিট ডুসকোভা বলেন, ‘‘আমার কিছুটা দুশ্চিন্তা ছিল যে, এই এলাকার লোকজন বলতে পারে, আমরা খ্রিষ্টানরা এখানে সংখ্যালঘু৷ কেন তোমরা মুসলমান পরিবারদের এখানে আশ্রয় দিয়েছ?'' কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি৷
প্রবীণরা সহানুভূতি দেখিয়েছেন
‘‘এই এলাকার প্রবীণ মহিলারাই প্রথম, যাঁরা জিজ্ঞেস করেছেন, তোমাদের কী গরম কাপড়চোপড়, কম্বল বা খাবারের প্রয়োজন আছে? এঁরা হলেন যুদ্ধের প্রজন্ম৷ এখন তো তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, আমাদের পরিবারটি কেমন আছে? যাজক হিসাবে এ এক সুন্দর অভিজ্ঞতা৷''
সিরীয় এই পরিবারটি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে ভালোভাবেই সৌদি আরবে দিন কাটাচ্ছিল৷ রুজি-রোজগারও ছিল ভালো৷ জামাল চকলেট বিক্রি করতেন৷ সামিরা বাচ্চাদের দেখাশোনা করতেন৷ কিন্তু জামাল মাল্টিপল এসক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়৷ সৌদি আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়না৷ তাই সামিরা কাজটা চালিয়ে যেতে পারেননি৷ অবশেষে হামবুর্গে সামিরার মা-এর কাছে যেতে মনস্থির করেন তাঁরা৷
অনিশ্চিয়তার পথে পাড়ি দেওয়া
শুরু হয় অনিশ্চিয়তার পথে পাড়ি দেওয়া৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্য সাগরে চারদিন নৌকা যাত্রা৷ ইটালিতে আসা৷ সেখান থেকে জার্মানির পথে যাত্রা৷ বাভারিয়া রাজ্যে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ৷ শরণার্থী শিবির৷ ছয়মাস পর বিতাড়নের ভয়৷ এইসব অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের৷ এরপর তাঁদের আবার ইটালিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়৷ ইউরোপীয় রাজনৈতিক আশ্রয় আইন অনুযায়ী যে দেশে প্রথম পা রাখেন আশ্রয়প্রার্থীরা, সেখানেই আবেদন করতে হয় তাঁদের৷
মানবাধিকার সংস্থা প্রো-অ্যাসাইলামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্যুনটার বুর্কহার্ট সমালোচনা করে বলেন, ‘‘একটি সিরীয় পরিবারকে কেন ইটালিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হবে, মা যখন জার্মানিতে বাস করেন?''
ইটালিতে শরণার্থীদের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গিন৷ তবে ইওনাটা পরিবারের ভাগ্য ভালো বলতে হবে৷ হামবুর্গে একটি গির্জার সহায়তায় মাথা গোজার ঠাঁই পেয়েছে তাঁরা৷
যাজক মায়ার বলেন, ‘‘আমাদের জার্মানদের কাছে বেড়ানোর জন্যে একটি সুন্দর দেশ ইটালি৷ কিন্তু এই পরিবারটির ইটালিতে টিকে থাকার কোনো উপায়ই ছিল না৷''
জামালের রোগটি বেড়ে যাচ্ছে৷ নড়াচড়ার ক্ষমতা কমে আসছে৷ মাঝে মাঝে পড়ে যাচ্ছেন তিনি৷ তাঁর চিকিত্সার জন্য ডাক্তার ও ওষুধ প্রয়োজন৷ ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যেতে হবে৷
দেশের খবর আতঙ্ক জাগানো
ইওনাটাদের আশ্রয়ে সারাদিন ধরে চলে টেলিভিশনটি৷ সিরিয়ার ভয়াবহ সব খবর ও ছবি দেখে আতঙ্কিত ও মর্মাহত হয়ে পড়েন তাঁরা৷ যাজক মায়ার জানান, প্রায়ই তাঁরা কাঁদেন৷ টিভিতে দেখানো জায়গাগুলি চেনেন তাঁরা৷ জানেন কারা সেখানে বাস করত৷ আগে জায়গাটা দেখতে কেমন ছিল৷ গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ার সংস্কৃতিও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷ যেমন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের সহাবস্থানের ভিতটিও৷
গির্জাটির শরণার্থী বিষয়ক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বে রয়েছেন ফানি ডেটলফ৷ তিনি জানান, ২০১১ সালে সারা জার্মানিতে ৬৯ শরণার্থী গির্জায় আশ্রয় পেয়েছেন৷ ১৬ জন সাময়িকভাবে জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছেন৷ একজনকে জার্মানি ছাড়তে হয়েছে৷
ফানি ডেটলোফ এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘সিরীয় শরণার্থীদের নিজ দেশ ছাড়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে৷ কিন্তু এখানে এসে তাঁরা বুঝতে পারেন যে, তাঁদের কথা অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না৷''
সব শরণার্থীকে সাহায্য করা সম্ভব নয়
গির্জার পক্ষে সব শরণার্থীকে সাহায্য করা সম্ভব নয়৷ যেখানে সম্ভব সেখানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় গির্জা৷ অনেকের জন্য বাসা ঠিক করে দেওয়া হয়৷ চিকিত্সক, আইনজীবী, খাদ্যদ্রব্য, বাচ্চাদের স্কুল এসবের ব্যবস্থাও করা হয়৷ গির্জায় আশ্রয় নিতে পারলে কিছুটা সময় হাতে পাওয়া যায় আরকি৷
প্রো-অ্যাসাইলামের মুখপাত্র গ্যুনটার বুর্কহার্ড বলেন, ‘‘তাঁর সংস্থা জার্মানির অ্যালাইলাম-আইনের তীব্র সমালোচনা করে৷ আইনটি যেন অনেকটা প্রতিরক্ষামূলক৷ শরণার্থীদের সব কিছুর বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়৷ বঞ্চিত করা হয় জার্মান ভাষা ও ইন্টেগ্রেশন কোর্স থেকে৷ ইউরোপ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য করতে আগ্রহী৷ জার্মানি রপ্তানিতে পারদর্শী৷ কিন্তু যখন ‘মানুষের' বিষয়টি এসে পড়ে, তখন চারিদিকে বেড়া তুলে দেওয়া হয়৷''
প্রো-অ্যাসাইলামের তথ্য অনুযায়ী, ১.৪ মিলিয়ন সিরীয় শরণার্থী তাঁদের প্রতিবেশী দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন৷ আনুমানিক ৪০,০০০ সিরীয় বাস করছেন জার্মানিতে৷ অনেকের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন এখানে৷