সংগ্রামী জীবন থেকে বিধানসভার অলিন্দে
২৬ জুন ২০২১উপমহাদেশে রাজনীতিক মানেই যেন ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রদর্শন৷ শালতোড়ার বিধায়ক চন্দনা বাউরি ও ইন্দাসের বিধায়ক নির্মল ধাড়া সেখানটায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে ব্যতিক্রমী৷ চন্দনা বাউরির স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি৷ তার জোগাড়ে হিসেবে ইট, সিমেন্ট, বালি বহনের কাজ করে ২৫০ টাকা দৈনিক মজুরিতে দিন চলত চন্দনার৷ অন্যদিকে সতীর্থ ইন্দাসের বিজেপি প্রার্থী নির্মল ধাড়া প্রাইভেট টিউশনি করেই সংসার চালাতেন৷ বিধায়ক হওয়ার পরেও সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন৷ জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর কতটা বদলেছে এই দুই জনের জীবন, দুই বিধায়কের সঙ্গে কথা বলে উত্তর খুঁজেছে ডয়চে ভেলে৷
সংসার থেকে রাজনীতির মঞ্চে
প্রধানমন্ত্রী ‘গোটা বাংলার আকাঙ্খার প্রতীক’ হিসেবে ‘বঙ্গাল কি বেটি’ চন্দনার কথা বলেছেন নির্বাচনী জনসভায়৷ বলা হচ্ছিল, বিজেপির সবচেয়ে দরিদ্র প্রার্থী ছিলেন তিনি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘যা জোটে তা দিয়ে রান্না করি৷ রাতে বেশিরভাগ দিনই আলুসেদ্ধ ভাত খাই৷’’
বিধায়কের স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি, কাজ থাকলে দিনে ৩৫০টাকা রোজগার করেন৷ তাই সংসারের যাবতীয় কাজ, রান্না, কাপড় কাচা বা ছোট ছেলের যত্ন, সবটাই বিধায়ক চন্দনা একা হাতে সামলান৷ এখন জনতার প্রতিনিধি হওয়ার পর আরও অনেক মানুষের দায়িত্ব নিতে হয়েছে৷ দিনভর সেজন্য ছোটাছুটি তো আছেই৷ তাই ছোট বোনকে সাংসারিক কাজে সাহায্যের জন্য নিজের কাছে এনে রেখেছেন৷ কিন্তু সংসারের কাজ ছেড়ে রাজনীতিতে কেন? চন্দনা বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে অনেক দুর্নীতি হয়েছে, মহিলাদের অসম্মান করা হয়েছে, মনোনয়নই জমা দিতে পারা যায়নি৷ এসব পরিস্থিতি দেখছি৷ তার সঙ্গে মোদীজির কাজ দেখে রাজনীতিতে এসেছি৷”
আপাতত মাটির বাড়ির টালির চালে মাথা গুঁজেই চন্দনা সব দলের সমর্থকের বিধায়ক হয়ে উঠতে চান৷ মানুষের জন্য কাজ করাটাই তার আসল লক্ষ্য৷ মৃদুভাষী চন্দনা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জানি না শাসক দল কতটা সাহায্য করবে৷ শালতোড়ার যে কাজকর্ম বাকি আছে, সেগুলি শেষ করার চেষ্টা করব৷’’
দুই বারের বিধায়ক তৃণমূল প্রার্থী সন্তোষ কুমার মণ্ডলকে হারিয়ে প্রথমবারেই নির্বাচনী লড়াইয়ে সফল চন্দনা৷ তবে প্রচারের প্রথম দিন তিনি ভয় পেয়েছিলেন৷ কিন্তু মানুষের সমর্থন তাকে ভয়মুক্ত করেছে৷ প্রচারে প্রচুর পরিশ্রমের ফলে শরীর এখনও দুর্বল৷ তাই রাজভবনে আসতে পারেননি৷ তাও কোভিডের এই পরিস্থিতিতে দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে মাস্ক, সাবান নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে৷ ইতোমধ্যে তিনি জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমে৷ তবে জনসংযোগের জন্য মানুষের কাছে যেতেই পছন্দ করেন চন্দনা৷ আর বিধায়ক সশরীরে কোথাও গেলে ভিড় হবেই৷ এমনই জনপ্রিয় তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘কোভিড পরিস্থিতিতে ভিড় হলে ভাল না৷ তাই ইচ্ছে থাকলেও সব জায়গায় যাওয়া যাচ্ছে না৷ মানুষ চাইছে যেন সব জায়গায় আমি পৌঁছাই৷’’
গৃহশিক্ষকতা থেকে বিধানসভায়
ছেলেমেয়েদের ইংরেজি পড়ান৷ প্রয়োজন হলে অন্যান্য বিষয়েও সাহায্য করেন নির্মল ধাড়া৷ তিনি এখন বিধায়ক৷ সমস্যায় পড়েছেন অভিভাবকরা৷ অগত্যা ইন্দাসের বিধায়ক নির্মল ধাড়া অবৈতনিক টিউশনি পড়াচ্ছেন৷
বিধানসভা ভোটের হলফনামায় পেশা প্রাইভেট টিউশন বলে জানিয়েছিলেন তিনি৷ ভাগচাষির সন্তান হয়ে এমএ পাশ করার জন্য যে লড়াই করতে হয়েছে, তা তিনি ভোলেননি৷ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিধায়ক হিসেবে একটা সামাজিক দায়িত্বও থেকে যায়৷ শিক্ষার আলো যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায় সেটার থেকে ভালো কিছু হতে পারে না৷’’
নির্মলকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বরাবরই আকর্ষণ করতেন৷ সেই টানেই শিক্ষা জগৎ থেকে রাজনীতির জগতে এসে পড়েছেন৷ ২০১৬ সালের নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন৷ একুশের ভোটে বিধানসভায় পৌঁছে গেলেন৷
এখন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পগুলির সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান তিনি৷ এক কণ্যা সন্তানের পিতা নির্মল বলেন, ‘‘আমার ব্যস্ততা অভিভাবকরা বোঝেন৷ তাও নাছোড়বান্দা হয়ে আছেন৷ অন্য কাউকে দিয়ে পড়াবেন না৷’’ বিধায়ক শিক্ষককে পেয়ে ছাত্রছাত্রীরা একদিকে যেমন খুশি, আবার আগের মতো সময় দিতে না পারায় মন খারপও হয় তাদের৷
নির্মল মনে করেন, একজন বিরোধী বিধায়কের দায়িত্ব সরকারের ভুল দেখিয়ে দেওয়া৷ সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি৷ এই বিধায়কের দাবি, তৃণমূল সরকারের আমলে এ রাজ্যে শিক্ষার উন্নতি হয়নি৷ তাই সেদিকে মন দিতে চান তিনি৷ বলেন, ‘‘গ্রামের মধ্যে অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে গড়ে তোলা যায়, সেই চিন্তাভাবনা রয়েছে৷ আমার বিধানসভা এলাকার স্কুলগুলি ঘুরে দেখে অভাব-অভিযোগ কথা শুনে প্রতিকার করতে চাই৷’’