1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‌সংকট বাংলা সংস্কৃতির

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
২৬ এপ্রিল ২০১৭

এই বছরের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া বাংলা ছবি ‘‌বিসর্জন’কে প্রেক্ষাগৃহ থেকে সরিয়ে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে বড় বাজেটের, বড় প্রযোজকের ব্যানারের ছবি ‘‌বাহুবলী’কে৷ বাংলার পরিচালকরা বলছেন, এই সংকট আদতে গোটা বাংলা সংস্কৃতিরই৷

https://p.dw.com/p/2bwH3
Filmstill Bisarjan
ছবি: Opera Movies

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত, পুরস্কৃত বাঙালি পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলির ছবি ‘‌বিসর্জন’৷ এই ছবিতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের শিল্পী জয়া আহসান৷ ছবিটি এবার ভারত সরকারের দেওয়া সেরা আঞ্চলিক ছবির পুরস্কার জিতেছে৷ সদ্য মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি, কলকাতার বেশ কিছু মাল্টিপ্লেক্সে এবং শহর ও শহরতলীর সিনেমা হলে৷ কিন্তু ‘‌বাহুবলী’ নামে তামিল ভাষার একটি ছবির হিন্দি রিমেক-কে জায়গা করে দিতে, প্রায় সব মাল্টিপ্লেক্সেই একটি বা দু'টি শো বরাদ্দ হয়েছে ‘বিসর্জন’-এর জন্য৷ আর্থিক বাহুবলের জোরে প্রদর্শনীর সিংহভাগ দখল করছে বাহুবলী৷ বাংলার পরিচালকরা এই অসাম্য এবং অবিচারে ক্ষুব্ধ৷ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে চলচ্চিত্র মহলে আর সোশাল মিডিয়ায়৷ সবাই বলছেন, এই অন্যায় বাংলা ছবির সঙ্গে, ভালো ছবির সঙ্গে এই প্রথম হলো না৷ এর আগে একাধিকবার বাংলা ছবি কোণঠাসা হয়েছে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির দাপটে৷

বাঙালি পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় যেমন ডয়চে ভেলেকে সোজাসুজিই বললেন, ‘‘সমস্যাটা জাতীয় পুরস্কার পাওয়া একটি ছবিকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে নয়৷ বিশ্ববরেণ্য, অস্কারজয়ী বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও যদি এখন থাকতেন, হয়ত তার ছবিকেও একইভাবে সরিয়ে দেওয়া হতো!‌ এতটাই প্রতাপ এই হিন্দি ছবিওয়ালাদের৷’’ তবে অনিকেতের আক্ষেপ, এই দুর্দশা শুধু বাংলা ছবিরও৷ দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা তামিল বা তেলুগুতে তৈরি ছবিকে কিন্তু এভাবে সরিয়ে দেওয়ার সাহস পায় না হিন্দিওয়ালারা৷ এমনকি মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যে রাজ্যে, সেই মহারাষ্ট্রেও কিন্তু মারাঠি ছবি দেখানোর অধিকার সুরক্ষিত৷ রীতিমতো নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে যে সিনেমা হল আর মাল্টিপ্লেক্সের অন্তত ৫০ শতাংশ শো মারাঠি ছবির জন্য রাখা থাকবে৷ তামিল, তেলুগু, কন্নড় ভাষার ছবির ক্ষেত্রেও একই নিয়ম দক্ষিণ ভারতে৷ দুর্ভাগা শুধু বাংলা৷

সত্যজিৎ রায়ও যদি এখন থাকতেন, হয়ত তার ছবিকেও একইভাবে সরিয়ে দেওয়া হতো: অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

তবে একজন বাঙালি হিসেবে পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের সব থেকে বড় আশঙ্কা, বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিকেই গ্রাস করে নিতে চাইছে মাল্টিপ্লেক্সে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হিন্দি সংস্কৃতি৷ একটা খুব সাধারণ, কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্যের নজির তুলে ধরলেন অনিকেত, যে আগে বাঙালি সিনেমা দেখতে গেলে নিজের পছন্দমতো খাবার কিনে খেতে পারত৷ হয়ত একটা চিকেন রোল বা একটা ফিশ ফ্রাই৷ কিন্তু সংস্কারী হিন্দি সংস্কৃতি এখন মাল্টিপ্লেক্সে আমিষ খাবার নিষিদ্ধ করেছে!‌ অনিকেতের রাগ, বাঙালি কোন সিনেমা দেখবে, কী ভাষায় সিনেমা দেখবে, এমনকি কী খাবে, সেটাও আজকাল বলে দিচ্ছে হিন্দিওয়ালারা৷

বিশিষ্ট পরিচালক গৌতম ঘোষ অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছেন, বাংলা ছবির একটা নিজস্ব বাজার যাতে গড়ে তোলা যায়, যেখানে বাংলা ছবির প্রদর্শনস্বত্ত্ব সুরক্ষিত থাকবে৷ এবং শুধু পশ্চিমবাংলার ছবি নয়, বাংলাদেশের ছবিও থাকবে সেই আয়োজনে৷ আর তার বাজার কেবল দুই বাংলায় নয়, আমেরিকা, ক্যানাডা, ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, যেখানেই বাঙালি থাকবে, সেখানেই গড়ে উঠবে৷ গৌতম ঘোষ ডয়চে ভেলেকে জানালেন, বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তেমন একটা মুক্ত বাজার গড়ে তোলা যায়নি৷ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে৷ যদিও ভারত এবং বাংলাদেশ, দুই দেশের সরকারের কোনও আপত্তি নেই বাংলা ছবির এমন একটা বাজারে৷ কিন্তু সমস্যা আছে অনেক, যেগুলো এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি৷ যেমন, ভারতীয় টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে জনপ্রিয় হওয়ার সুবাদে এখানকার চলচ্চিত্রশিল্পীরা ওদেশে মুখচেনা৷ কিন্তু উল্টোটা হয়নি৷

সমস্যা আছে অনেক, যেগুলো এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি: গৌতম ঘোষ

এখানকার কেবল টিভি ব্যবসায়ীরা নানা জটিলতার কারণে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান এদেশে দেখান না৷ ফলে বাংলাদেশি চিত্রতারকারা এদেশে তেমন পরিচিত মুখ নন৷ যে কারণে এখানকার বাংলা ছবি ওপারে গিয়ে যদিও বা ব্যবসা করে, ওখানকার ছবি এপারে এলে তেমন ব্যবসা পায় না৷ ফলে বাংলা ছবির বৃহত্তর বাজার তৈরির মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়৷ ছবি বিক্রির সূত্রে পাওয়া রাজস্ব বিনিময়েরও কোনও পরিকল্পিত, নির্দিষ্ট, নিয়মানুগ পথ নেই৷ মুম্বইর প্রযোজকরা পাকিস্তানে ভারতীয় ছবি রিলিজের যে আর্থিক বোঝাপড়ার ব্যবস্থা করে ফেলতে পেরেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি৷

‘‌পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘‌মনের মানুষ’, ইত্যাদি একাধিক ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার পরিচালক গৌতম ঘোষের আক্ষেপ, বাংলা ছবির একটা জোট করা গেলে, তার একটা বাজার তৈরি হলে, হিন্দি, তামিল, তেলুগু, যে কোনও ভারতীয় ভাষার ছবির থেকে অনেক বড় বাজার হতো৷ কিন্তু হয়নি৷ গৌতমের আশা, যদি দুই বাংলার নবীন প্রজন্মের প্রযোজক, পরিচালকরা এই কাজে এগিয়ে আসতে পারেন৷ কারণ, এটা করতেই হবে৷ বাংলা ছবির স্বার্থে৷