1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিক্ষা পণ্য নয়, বেসরকারি স্কুল নিয়ে পর্যবেক্ষণ আদালতের

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৮ জুন ২০২৩

শিক্ষা পণ্য নয়। এই মন্তব্য করে 'শিক্ষা বিক্রির' কঠোর সমালোচনায় হাইকোর্ট। এরপর কি বেসরকারি স্কুলে পড়ার খরচ কমবে?

https://p.dw.com/p/4SLJn
বেসরকারি স্কুলে ফি বাড়ানো নিয়ে সরকারের ভূমিকা জানতে চাইলো হাইকোর্ট।
বেসরকারি স্কুলে ফি বাড়ানো নিয়ে সরকারের ভূমিকা জানতে চাইলো হাইকোর্ট। ছবি: Payel Samanta/DW

করোনা পরিস্থিতিতে স্কুলের ফি বাড়ানো নিয়ে টানাপোড়েন চলছে কলকাতার নামীদামি বেসরকারি স্কুলে। অভিভাবকেরা আদালতে দায়ের করেছেন একাধিক মামলা। একদিকে যখন মানুষ রুটিরুজির দৈনন্দিন সমস্যায় জেরবার হয়ে যাচ্ছেন, তখন মাত্রাছাড়া ফি বৃদ্ধির ফলে বেসরকারি স্কুলের অভিভাবকদের মাথায় হাত পড়ে যায়। 

অনুরোধের পর্ব পার করে আন্দোলনে নামেন তারা। কিন্তু সেসব কানে তোলেননি স্কুল কর্তৃপক্ষ, এমনই অভিযোগ অভিভাবকদের। মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে এমনই এক ফি বৃদ্ধি সংক্রান্ত মামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু। তিনি বলেন, ''শিক্ষা বিক্রয়যোগ্য নয়, এটা মনে রাখতে হবে। শিক্ষা বিক্রি করে একটা শ্রেণি রোজগার করবে, এটা হতে পারে না।'' 

সরকারি বনাম বেসরকারি 

রাজ্যে বেসরকারি স্কুলের আকাশছোঁয়া ফি-র বিপরীতে সরকারি স্কুলের মলিন ছবি। দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলছেন শিক্ষাবিদরা। 

‘ক্রমাগত সরকারি শিক্ষাকে দুর্বল করার জন্যই এই পরিস্থিতি’

এ বছরের গোড়ায় সরকার ৮ হাজার ২০৭টি বিদ্যালয় তুলে দেয়ার কথা বলেছিল। তার আগে শিক্ষা ক্ষেত্রে পিপিপি মডেল চালু করার পরিকল্পনা শোনা গিয়েছিল। প্রবল জনমতের চাপে তার কোনটাই কার্যকর হয়নি।

শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির একাধিক মামলা চলছে আদালতে। যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পাননি বলে অভিযোগ। শিক্ষকের বিপুল শূন্যপদ রয়েছে বিভিন্ন স্তরে। এর ফলে বিঘ্ন ঘটছে পঠনপাঠনে। 

বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হান্ডা বলেন, ''প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিকাঠামো মান্ধাতা আমলের। শিক্ষকদের দিয়ে ভোটের কাজ, জনগণনা ইত্যাদি শিক্ষা বহির্ভূত কাজ করানো হয়। ফলে শিক্ষাদান গৌণ হয়ে গেছে। তাই অভিভাবকরা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় আস্হা হারিয়ে ফেলেছে। বিদ্যালয়গুলো ছাত্রাভাবে ধুঁকছে।''

এর ফলে আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন অভিভাবকরা বেসরকারি স্কুলের দিকে ঝুঁকছেন। অনেকের মতে, কার্যত বাধ্য হচ্ছেন সরকারি বা আধা সরকারি স্কুল ছেড়ে দিতে। 

প্রেসিডেন্সির সাবেক অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''ছুটির প্রাচুর্য আর পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবের জেরে সরকারি স্কুলের শিক্ষা এখন তলানিতে। সরকারের ভোটমুখি চিন্তাভাবনার মধ্যে শিক্ষার কোনো ঠাঁই নেই। তাই সম্পন্ন অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের ব্যয় করে বেসরকারি স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন।''

বেসরকারি স্কুলগুলি ফি বাড়ানোর ক্ষেত্রে  কি সরকারের সম্মতি নেয়?
বেসরকারি স্কুলগুলি ফি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কি সরকারের সম্মতি নেয়?ছবি: Payel Samanta/DW

শিক্ষা যখন পণ্য

কোভিড পরিস্থিতির পর থেকে বারবার অভিযোগ উঠছে, শিক্ষাকে শুধু এই রাজ্যে নয়, সারা দেশ জুড়েই পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। মোবাইল ও কম্পিউটার নির্ভর শিক্ষাকে মজবুত করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

অভিভাবকের সংগঠনের তরফে সুপ্রিয় ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''ক্রমাগত সরকারি শিক্ষাকে দুর্বল করে, বেসরকারি শিক্ষাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যই এই পরিস্থিতি।''

সুপ্রিয় ব্যাখ্যা করেন, ''আমাদের রাজ্যে বেসরকারি স্কুলগুলোতে কোনো ফি নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করেই স্কুলগুলি ইচ্ছেমতো ফি বাড়ায়। পাশাপাশি স্কুলের জুতো, জামা, খাতা, মোজা সবকিছু নিয়ে রমরমিয়ে ব্যবসা চলছে। অন্যান্য রাজ্য এসব রুখতে রেগুলেটরি কমিশন তৈরি করলেও এ রাজ্যে কিছু হয়নি।''

আদালতের নির্দেশে কিছুটা আশার আলো দেখছেন অভিভাবকরা। হাইকোর্ট বলেছে, ১৫ জুনের মধ্যে রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে, তাদের কতটা নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বেসরকারি স্কুলের উপর। ২১ জুন মামলার পরের শুনানি। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সংঘাতের নিষ্পত্তি হয় কি না, সেটা বোঝা যাবে।

সরকারের ভূমিকা

বিচারপতি বলেছেন, বেসরকারি স্কুলের উপর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। কিন্তু কীভাবে রাজ্য নিয়ন্ত্রণ জারি করতে পারে?

রাজ্যের ২০১২ সালের আইন বলছে, ফি বৃদ্ধিতে রাজ্যের সম্মতি আবশ্যক। অথচ বেসরকারি স্কুলগুলি ফি বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের পরামর্শও মানে না বলে অভিযোগ। 

বেসরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামো অনেক উন্নত। পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ বহির্ভূত কার্যকলাপের উপর নজর দেয়া হয়। খেলাধুলো, যোগ, সংস্কৃতি চর্চা সহ নানা দিকে পড়ুয়াদের অভ্যস্ত করে তোলা হয় এই স্কুলগুলিতে। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এই পরিকাঠামো ও শিক্ষার মান অনুযায়ী তারা ফি ঠিক করেন।

এই যুক্তি মানতে রাজি নন অভিভাবকরা। অতীতে এই বিষয়ে ক্ষোভ জনিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি তিনি বেসরকারি স্কুলে নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে শিক্ষা কমিশন গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে ২০২১ সালে বেসরকারি স্কুল নিয়ন্ত্রণে বিল আনার চেষ্টা হয় বিধানসভায়। যদিও বিল আনার প্রক্রিয়া বিশেষ এগোয়নি। তা হলে নিয়ন্ত্রণ জারি করা যাবে কীভাবে? কী হবে সর্বজনীন শিক্ষার?

শিক্ষাবিদ মিরাতুন নাহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''শিক্ষার বেসরকারিকরণ করলে যাঁদের অর্থ আছে, তাঁরা কিনে নিতে পারবেন। এই বাণিজ্যকরণ নেতানেত্রীদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলছে। কিন্তু এ দেশের বড় অংশের মানুষেরই সেই শিক্ষা কেনার সামর্থ্য নেই। তারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছেন।''

এই পরিস্থিতিতে আরেকটি বিকল্প দেয়ার চেষ্টা করছে দিল্লি। এখানে সরকারি স্কুলের মান বাড়ানো হয়েছে। পরিকাঠামোর উন্নতি করা হয়েছে। স্কুল অনেক পরিচ্ছন্ন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা ভালো ফল করছেন। এই বিকল্পের কথাও ভেবে দেখতে পারে পশ্চিমবঙ্গ।