1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শরণার্থী পরিচয় চার নেতা হত্যা মামলার আসামির রক্ষাকবচ!

সমীর কুমার দে ঢাকা
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও কূটনীতিক এম খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরানো খুব সহজ হবে না বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা৷

https://p.dw.com/p/46tHH
ছবি: bdnews24.com/Dipu Malakar

তারা বলছেন, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) স্বীকৃত শরণার্থী হওয়ায় মালয়েশিয়ার আদালতে তিনি বিশেষ সুবিধা পাবেন৷

এছাড়া জেল হত্যা মামলাটি পুনরায় সচল করা সম্ভব কিনা তা নিয়েও বিচার-বিশ্লেষণ চলছে৷

এম খায়রুজ্জামানকে গত বুধবার গ্রেপ্তার করেছে মালয়েশিয়ার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ৷ গ্রেপ্তারের বিষয়টি বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়ার ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টারকে নিশ্চিত করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জাইনুদিন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘একটি অভিযোগ থাকায় খায়রুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এ বিষয়ে তার দেশের (বাংলাদেশের) একটি অনুরোধও আছে৷’’

এম খায়রুজ্জামান ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা মামলার আসামি৷ ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন ৷ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিলেও তিনি ফেরেননি৷ তখন থেকে তিনি শরণার্থী হিসেবে সেখানে আছেন৷

জেল হত্যা মামলা এখন যে পর্যায়ে

জেলহত্যা মামলা পুনরায় সচল করার সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেলারেল আমিন উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি আজই জাজমেন্টটা সংগ্রহ করেছি৷ রাতে পড়বো৷ তারপরই এ বিষয়ে বলা যাবে৷ নরমালি তো ডিলে হলেও দরখাস্ত করে করা যায়৷ ফৌজদারি আইনে তামাদিটা বড় বিষয় না, যদি মেরিট থাকে৷’’

জেল হত্যা মামলার আইনি লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘অবজারভেশন কী আছে না দেখে কিছু বলা যাবে না৷ ওই মামলায় তাকে কীভাবে দেখানো হয়েছে, সেটাও জাজমেন্টটা দেখে বুঝতে হবে৷’’

তবে জেল হত্যা মামলাটি আর পূনরুজ্জীবিত করার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন৷ সুপ্রিম কোর্টের ঠিক করে দেওয়া এই আইনজীবী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই মামলাটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আপিল বিভাগ থেকে হয়ে গেছে৷  সংবিধানের ১০৪ ধারা অনুযায়ী কমপ্লিট জাস্টিস বলে একটা কথা আছে৷ এটা হলো নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টেও যদি ওই মামলাটির বিষয়ে কোনো কিছু বাদ গিয়ে থাকে, তাহলে আপিল বিভাগে মামলাটি চলাকালে এই ধারায় আবেদন করা যায়৷ তখন আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতে বা হাইকোর্টে পুনরায় শুনানির জন্য মামলাটি না পাঠিয়ে নিজেরাই বিচার করতে পারেন৷ এখানে সুপ্রিম কোর্টকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে৷ তখন আপিল শুনানি চলাকালে তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং এই মামলার আইনজীবী আনিসুল হক এই ধারায় আবেদন করেছিলেন৷ সেটা নিয়েও শুনানি হয়েছে৷ সেটাও তখন আপিলে খারিজ হয়ে গেছে৷ এখানে আপিল বিভাগে দুই জন বিচারক সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন৷ এসকে সিনহা তখন জাজমেন্ট দিলেন, এখানে ষড়যন্ত্র হয়েছে৷ আর নাজমুন আরা জাজমেন্ট দিলেন ষড়যন্ত্র প্রমানিত হয়নি৷ তাকেই সমর্থন দিলেন অন্য ৫ জন বিচারক৷ ফলে মামলাটি সেখানেই শেষ হয়ে যায়৷ এখন প্রশ্ন হলো, খারুজ্জামানের বিরুদ্ধে নতুন করে এই মামলাটি আবার শুরু হতে পারে কিনা? ৩৫ এর (২) ধারা অনুযায়ী একই বিষয়ের উপর তাকে আর বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না৷ আবার সিআরপিসির ৪০৩ ধারায় বলা আছে একই অপরাধের জন্য দ্বিতীয়বার বিচার করা যাবে না৷ এখন যদি অন্য কোনো অপরাধে তার বিচার হয়, সেটা ভিন্ন কথা৷ কিন্তু এই মামলায় তার আর বিচার করার সুযোগ নেই৷’’

মামলাটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আপীল বিভাগ থেকে হয়ে গেছে: ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন

তাকে দেশে ফেরানো সম্ভব?

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির৷ কীভাবে খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরানো যাবে - এ প্রশ্নের জবাবে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হবে না৷ তিনি যদি সেখানে শুধুমাত্র অবৈধ অভিবাসী হিসেবে থাকতেন তাহলে দুই দেশের সরকারের সমঝোতার ভিত্তিতে আনা যেতো৷ কিন্তু তিনি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) স্বীকৃত একজন শরণার্থী৷ যে প্রক্রিয়ায়ই তিনি শরণার্থী হোন না কেন, মালয়েশিয়া সরকার তাকে এই সুযোগটি দিয়েছে৷ এখন তারা বলছে, অভিবাসন সংক্রান্ত কোনো আইন লংঘনের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ একজন মানুষ শরণার্থী হয় কখন? যখন তার নিজের দেশে জীবন ঝুঁকিতে থাকে৷ আর যে দেশে তাকে থাকার সুযোগটি দেওয়া হয়, সেখানে তাকে প্রমান করতে হয় নিজের দেশে তার জীবন ঝুঁকিতে আছে৷ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জীবন ঝুঁকিতে থাকার কারণেই তো আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি৷ এখন কথা হলো, তার কাছে মালয়েশিয়ার সরকার জানতে চাইবে তোমাকে দেশে পাঠালে কোনো আপত্তি আছে কিনা? তখন এখানে তার জীবন ঝুঁকির বিষয়টি আবারও প্রমান করতে হবে৷ তখন বাংলাদেশের কাছেও মালয়েশিয়া জানতে চাইতে পারে, এখানে তার জীবন তো ঝুঁকিতে? তখন আমাদের সরকারকে প্রমাণ করতে হবে আইনি ঝামেলা থাকলেও তার জীবন ঝুঁকিতে নেই৷ এর মধ্যে আবার তিনি যেহেতু শরণার্থী ফলে জাতিসংঘের একটা ভূমিকা থাকবে৷ সব মিলিয়ে ফেরত আনা যাবে না এমনটি বলা যাবে না৷ কিন্তু প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল বলেই মনে হচ্ছে৷’’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খায়রুজ্জামানকে দেশে ফেরাতে মালয়েশিয়ার আদালত থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে৷ তিনি ইউএনএইচসিআর এর শরণার্থী হওয়ার কারণে পরিস্থিতি একটু জটিল হয়ে গেছে৷’’

গ্রেপ্তারের পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যা বলেছেন

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবারই ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, খায়রুজ্জামানকে দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করছে৷ মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ আছে কিনা, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় তা খতিয়ে দেখবে৷ মামলাটি কোন পর্যায় থেকে অথবা আবার মামলাটি কিভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হবে বা পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ কী হবে সেটাও তারা দেখবেন৷

প্রক্রিয়াটি খুব সহজ হবে না: আসিফ মুনির

প্রতিমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার অভিবাসন ইস্যুতে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ‘ডিপোর্ট’ করার জন্য ‘ডিপোর্টেশন সেন্টারে’ অন্তরীণ করে রাখা হয়৷ তাকেও সেখানে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে৷ তাকে দ্রুত দেশে ফেরাতে সরকারের উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি যতদূর জানি, সেই মামলা (জেলহত্যা মামলা) থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছিল৷ এর কারণ তদন্তের দুর্বলতা হতে পারে, অন্য কিছু হতে পারে, এটা আদালতের এখতিয়ারাধীন, তাই আমি মন্তব্য করতে চাই না৷’’

এদিকে খায়রুজ্জামানের গ্রেপ্তারের বিষয়ে গত বুধবার টুইট বার্তা দেয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ)-এর এশিয়া ডেস্ক৷ তারা বলেছে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) স্বীকৃত শরণার্থী খায়রুজ্জামানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে৷ তাকে বাংলাদেশে পাঠানোর ঝুঁকি আছে৷ বাংলাদেশে তিনি বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন৷ সংস্থাটি খায়রুজ্জামানকে ইউএনএইচসিআরের দেওয়া শরণার্থী পরিচয়পত্রের ছবিও টুইট বার্তায় প্রকাশ করেছে৷ পরিচয়পত্রটি ইস্যুর তারিখ ২০২০ সালে ২ মার্চ, মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ২২ মে৷

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে৷ ২০০৪ সালে পলাতক তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত৷ তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বাকি দু'জনকে খালাস দেন৷

তবে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের রায়ে তিনজনকেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়৷

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক কর্মকর্তা এম খায়রুজ্জামানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল৷ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলহত্যা মামলার অভিযোগপত্রে নাম এলে সে সময় ফিলিপাইন্সে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা খায়রুজ্জামানকে দেশে ডেকে পাঠানো হয়৷ ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ সে সময় তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় সরকার৷ তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় ফিরলে জামিনে মুক্ত হন খায়রুজ্জামান৷ ২০০৪ সালে জেলহত্যা মামলার রায়ে তাকে খালাস দেওয়া হয়৷ তবে মামলা চলাকালেই নজিরবিহীনভাবে তাকে পদোন্নতি দেয় সরকার৷ করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব৷ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালে তাকে মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদেও নিয়োগ দেয়৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের আগস্টে তাকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার করা হয়৷

খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়ায় থাকলেও তার স্ত্রী রিটা রহমান এ দেশেই থাকেন৷ রিটা রহমানের বাবা মশিউর রহমান যাদু মিয়া ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী৷ রিটা রহমান বিএনপির জোটসঙ্গী ন্যাশনাল পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের প্রধান ছিলেন৷ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তিনি নিজের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন৷ তিনি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনও করেন৷