1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লাগে টাকা দেবে জনগণ

গৌতম হোড়
১৬ অক্টোবর ২০২০

আর যা কিছুর অভাব থাক না কেন, সরকারি প্রকল্পের কোনো অভাব নেই। আর সেই প্রকল্পের ক্ষেত্রে অলিখিত একটা নিয়ম আছে। ঠিক সময়ে তা শেষ হয় না।

https://p.dw.com/p/3k1Nu
Ost West Metro Tunnel   Kalkutta
ছবি: DW/S. Bandopadhyay

কথাটা লোকসভার ভিতরে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন জয়রাম গড়করির মুখ থেকে বহুবার শুনেছি। কেন রাস্তা তৈরির প্রকল্প শুরু হয়, কিন্তু সময়ে শেষ হয় না। তাঁর যুক্তি ছিল, ইউপিএ আমলে নতুন রাস্তা বা পুরনো রাস্তা, সেতু সব কিছুর জন্য টেন্ডার ডেকে, কনট্রাক্টরকে বরাত দিয়ে দেয়া হতো। কনট্রাক্টর ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তিনি সব যন্ত্রপাতি, লোকলস্কর নিয়ে রাস্তা বানাতে শুরু করে দিলেন। এ বার কাজ কিছুটা এগোলে দেখা গেল, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। ফলে রাস্তার কাজ আর এগোচ্ছে না। কনট্রাক্টরের মাথায় হাত। দিনের পর দিন যায়, রাস্তা তৈরি হয় না। ব্যাঙ্কের ঋণ ও সুদের কিস্তি বন্ধ থাকে। কাজ সময়ে শেষ হয় না। ফলে খরচ বেড়ে যায়। আর জনগণের পকেট থেকেই সেই বাড়তি অর্থ আসে। কারণ, হয় সেই খরচ সরকার বহন করে। অথবা টোল আদায় করে খরচ ওঠানো হয়। দুইটি ক্ষেত্রেই পয়সাটা যাচ্ছে আম আদমির পকেট থেকে। অবস্থাটা তো এখনো বদলায়নি। জাপানি ঋণের টাকায় তৈরি হওয়া বুলেট ট্রেনও তো থমকে আছে মহারাষ্ট্রে জমি অধিগ্রহণ বিতর্কের ফলে।

এ একটা অদ্ভূত চক্র। আমাদের উপ মহাদেশে কোনো কিছুই  সময়ে হয় না। প্রকল্প ঘোষণা করতে যতটা উৎসাহ, শেষ করার ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। কত রকমভাবে প্রকল্পগুলি ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এই যেমন ধরুন, আজিমগঞ্জ ও জিয়াগঞ্জের মধ্যে ভাগীরথীর উপর রেলসেতু। গত বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে এক হাজার টাকা। কাঁচড়াপাড়া রেল কারখানার জন্য বরাদ্দ হয়েছে এক লাখ টাকা। মানে প্রকল্পগুলি জিইয়ে রাখা হলো। কিন্তু বরাদ্দ হলো না। ফলে প্রকল্পগুলির খরচ বেড়ে গেল। শেষ করার সময়সীমা বেড়ে গেলো। রেলের এই প্রকল্পগুলিকে বলা হয় শেলফে রাখা হলো। মানে তাকে তুলে রাখা। আগে কোনো রেলমন্ত্রী বা বড় নেতা বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থ দেখতে গিয়ে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। তাঁরা ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর প্রকল্প ঝুলিয়ে রাখা হলো।  ঝুলতে ঝুলতে দীর্ঘদিন পর যখন তা শেষ হবে, তখন খরচ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

ভারতে একটা সময়ে কোনো পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যোজনা কমিশনের ভূমিকা ছিল রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ। যোজনা কমিশনের সাবেক উচ্চপদস্থ অফিসার ও যোজনা বিশারদ অমিতাভ রায়ের অভিজ্ঞতা হলো, রাজনৈতিক চাপে অনেক পরিকল্পনা নেয়া হতো এবং আজও হয়। হরিয়ানার সাবেক এক মুখ্যমন্ত্রীর চাপাচাপিতে এমনই একটা রেলপ্রকল্প নেয়া হয়েছিল। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণ দেখিয়ে এই সব প্রকল্পের অনুমোদন করানো হয়। এই ধরনের প্রকল্প হয় ঝুলে থাকে অথবা অনেক দেরিতে শেষ হয়। তখন খরচ অনেকটাই বেড়ে যায়। এগুলি ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট। বছরের পর বছর এক লাখ, এক হাজার বা এক কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্প চালু থাকে মাত্র।

২০০৮ সালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের কাজ পাঁচটা পর্যায়ে ভাগ করে অনুমোদন করা হয়। ১২ বছর পরে সব হয়ে গেছে, শুধু কলকাতা ও কৃষ্ণনগরের মধ্যবর্তী এলাকা ছাড়া। সেখানে ১৫ কিলোমিটারের মতো রাস্তা হয়নি জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি বলে। আজিমগঞ্জ থেকে নসিপুর একটা রেলব্রিজ ২০১০ সাল থেকে হয়ে পড়ে আছে। ২৮৫ মিটার রাস্তা হয়নি, কারণ, জমি পাচ্ছে না রেল। তা নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে রেলের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন চলছে। এখনো তা শেষ হয়নি। অধীর চৌধুরি রেল প্রতিমন্ত্রী হয়েও শেষ করাতে পারেননি। তাঁর অভিযোগ, কারণটা রাজনৈতিক।

সম্প্রতি রোটাং পাসের টানেলের উদ্বোধন করা হয়েছে। এটাকে বলা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং জাদু। এটা তৈরি হতেও অনেকদিন সময় লেগেছিল। ২০০৩ সালে সাবেক প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সংসদে এই প্রকল্প করার কথা বলেন। অমিতাভ রায় জানাচ্ছেন, তারপর যোজনা কমিশনের কাছে সেই প্রকল্প নিয়ে এল সরকার। প্রথমেই যোজনা কমিশনের প্রশ্ন ছিল, ভূতাত্বিক সমীক্ষার রিপোর্ট কোথায়? পাহাড়ের চরিত্র কী, সেটার ভিতর দিয়ে টানেল কীভাবে করা যাবে, সেটা তো আগে জানতে হবে। এই সব কথাবার্তা এগোতে বেশ কয়েক বছর লেগে গেল। তারপর ২০১০ সালে সনিয়া গান্ধী তার শিলান্যাস করেন।

মুসকিল হলো, তহবিল নেই, কিন্তু রাজনীতি করতে হবে। ধরা যাক, হাতে ১০০ কোটি আছে, যা দিয়ে গোটা দুই প্রকল্প হতে পারে। কিন্তু রাজনীতির স্বার্থে ২০টা প্রকল্প ঘোষণা করে চালু করে দেয়া হলো। ফল কী হলো? সব প্রকল্পে দেরি হলো। খরচ বাড়ল। জনগণ নামক গৌরী সেন আছে তো। ফলে টাকা তারাই শেষ পর্যন্ত জুগিয়ে যাবে।

দীর্ঘদিন ধরে  কেন্দ্রীয় সরকারে উচ্চপদে কাজ করেছেন সুমিত দত্ত মজুমদার। তিনি সেন্ট্রাল এক্সাইজ ও কাস্টমস বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান। দিল্লিতে যখন এশিয়ান গেমস হয়েছিল, তখন বিভিন্ন প্রকল্প দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা হলো, প্রকল্প তৈরির সময়ই কতদিন পরে তা শেষ হবে তা ঠিক করা হয়। অনেক সময় এই সময়সীমাটাও অবাস্তব হয়।  তার উপর যারা প্রকল্প রূপায়ণ করে তাদের ব্যর্থতা তো অপরিসীম। একটা প্রকল্প তৈরি হলে প্রতি মাসে কতটা অগ্রগতি হবে, তার বার চার্ট থাকে। সেই চার্ট ধরে দেখতে হয়, কতটা কাজ এগোল। না এগোলে কেন হয়নি। সময় থেকে পিছিয়ে গেলে লালকালির দাগ পড়ে। যিনি দায়িত্বে তাঁর দায় হলো সময়ে কাজ শেষ করা। অনেক সময় পরিকল্পনা বদলানো হয়। নতুন কিছু যোগ করা হয়। তার পরেও সময়ে শেষ করার দায় অফিসারের থাকে।

কিন্তু সরকারি কর্মীদের সম্পর্কে লোকের ধারণাই হলো, তারা কাজ করার থেকে কাজ না করাতে বেশি পারদর্শী। সেই ধারণা যে একেবারে ভুল তা তো নয়। দিল্লি মেট্রো রেলের অনেক লাইন নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হয়ে গেছিল। সেটা সম্ভব হয়েছিল শ্রীধরনের মতো একজন অসাধারণ অফিসার ছিলেন বলে। না হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো বাঁধা গতে চলে। হলে হলো, না হলেই বা কী এসে যায়। ফলে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সময়ে কাজ শেষ হয় না। খরচ বাড়ে। চলছে-চলবে নীতিতে প্রকল্পও গড়াতে থাকে। একসময় তা শেষ হয়। আর সেই খরচ বহন করার জন্য জনগণ নামক অদৃশ্য টাকার গাছ তো  আছেই। তাকে পিষলেই টাকার জোগাড় হয়ে যায়। ফলে এই চক্রও চলতেই থাকে।