লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ
২৫ নভেম্বর ২০২১অর্থনীতিবিদদের মতে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে অনীহা আছে৷ আর এই অনীহার কারণ যারা খেলাপি তারা ক্ষমতাবান৷
২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায় ব্যাংকখাতে বাংলাদেশে এখন খেলাপি ঋণ এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা৷ এর আগে আরো একবার ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিলো৷ ওই বছরের মার্চ মাসে প্রথমবারের মত খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা৷
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা৷ তার মধ্যে খেলাপি ঋণ এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা৷ এটা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ৷
২০২০ সালের ডিসেম্বরে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা৷ চলতি বছরের সেপ্টম্বরর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা৷
চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ দিয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার ২৯২ কোটি টাকা৷ এই ঋণের মধ্যেও খেলাপি ঋণ হয়েছে ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা৷ যা নয় মাসে দেয়া মোট ঋণের ২০ দশমিক ০৭ শতাংশ৷
বেসরকারি ব্যাংকগুলো এই সময়ে ঋণ দিয়েছে ৯ লাখ ২৮ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা৷ যার মধ্যে ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে৷ যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ৷ বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমান ও শতকরা হার উভয়ই বেশি৷
খেলাপি ঋণের একটি অংশ প্রতিবছর অবলোপন করা হয়৷ সেটা খেলাপি খাতে না দেখিয়ে অন্য খাতে দেখানো হয়৷ এখন পর্যন্ত এর পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা৷ আবার মূল ঋণের শতকরা দুইভাগ ডাউন পেমেন্টে দিয়ে খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ তিনবার পুণঃতফসিল করা যায়৷ এর পরিমাণ হবে প্রায় সাত লাখ কোটি টাকা৷ বাস্তবে এগুলোও খেলাপি ঋণ৷ কিন্তু আইনের মারপ্যাচে খেলাপি ঋণের হিসাবে দেখানো হয় না৷
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা মনে করেন, বাংলাদেশে ঋণ খেলাপি একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে৷ এর কারণ খেলাপিদের আইনের আওতায় না আনা এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে তাদের যোগাযোগ৷ উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন,"করোনা মহামারি এবং কৌশলগত বিপত্তির কারণে ঋণ খেলাপি হতেও পারে৷ কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ খেলাপির কারণ ভিন্ন৷ এখানে যাদের ঋণ দেয়া হয় তারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয়৷ আবার যেসব প্রকল্পে ঋণ দেয়া হয় সেইসব প্রকল্প সফল হবে কি না তাও বিশ্লেষণ করে ঋণ দেয়া হয় না৷ ফলে এখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই৷”
তার মতে," কাঠামোগত এবং ব্যবস্থাপনার সমস্যা এখানে প্রকট৷ এটা কাটাতে না পারলে এই খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি চলতেই থাকবে৷ কারণ আমরা সংবাদমাধ্যমে খেলাপিদের যে নাম ও তালিকা দেখি তাতে স্পষ্ট যে এর সাথে রাজনীতির একটি সংশ্রব আছে৷ তারা ক্ষমতার সাথেও সম্পর্কিত৷”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো এবং ঋণ কমিয়ে আনায় সরকারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন৷ তারপরে কাঠামোগত কিছু বিষয় আছে৷ তিনি বলেন,"যারা ব্যাংকের মালিক তাদের আবার রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে৷ তারাই আবার খেলাপি হচেছন৷ আবার ব্যাংক নেই কিন্তু ক্ষমতা আছে তারাও খেলপি হচ্ছেন৷ আর এই ধরনের চাপের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকও খেলাপি ঋণ আদায়ে ততটা আগ্রহী নয়৷ তারা বরং নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে, নানা কৌশল করে খেলাপি যারা হয় তাদেরই সহযাগিতা করছে৷”
তার মতে,"যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে তাহলে খেলাপি ঋণ আদায়ে নানা পরিকল্পনা নেয়া যায়৷ সময় বেঁধে দেয়া যায়৷ কিস্তি করে দেয়া যায়৷ আরো অনেক কিছু করা যায়৷ এটা ব্যাংক ভিত্তিক করতে হবে৷ তবে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷