1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ললিতা থেকে ললিত হয়ে ওঠা

রাজীব চক্রবর্তী নতুন দিল্লি
১৯ জুন ২০১৮

নারীর শরীরে পুরুষের অনুভূতি, তাই ললিতার ছিল ললিত হয়ে ওঠার অদম্য ইচ্ছা৷ অবধারিতভাবে দীর্ঘ সংগ্রামের মুখোমুখি৷ তবে, কথায় আছে ‘‌যে সয়, সে রয়'৷ শেষমেশ মনের পাশাপাশি শরীরেও পুরুষ হয়ে উঠলেন ললিত সালভে৷

https://p.dw.com/p/2zrOa
Screenshot youtube Indien Lalit Salve
ছবি: youtube.com/Tv9 Marathi

ভারতের বাণিজ্যনগরী মহারাষ্ট্রের বিদ জেলার এক অতি সাধারণ পুলিশ কনস্টেবলের জয়ের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে অব্যক্ত যন্ত্রনা ও অসহ্য জীবনসংগ্রাম পার হয়ে আসার কাহিনি৷ মেয়ে হিসেবে জন্ম নিলেও বহুদিন থেকেই নিজের মধ্যে পুরুষসত্তা অনুভব করতেন ললিতা সালভে৷ দিন যত এগিয়েছে, ততই তাঁর ভেতরে পুরুষত্ব দানা বেঁধেছে৷ রাজেগাঁও গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের চিলেকোঠা থেকে প্রথমে নিজের মধ্যেই যাবতীয় অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ কিন্তু, একসময় তা আর পারেননি৷ যত বড় হয়েছেন, ততই নারী-‌পুরুষের মধ্যেকার অস্তিত্ব সংকটে ভুগেছেন তিনি৷ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্মীয় পরিজনদের জানিয়ে কাজ হয়নি৷ উল্টে শুনতে হয়েছে, কুকথা৷ এমনটাই চলছিল৷ এদিকে, জন্মের সময় থেকেই অপরিণত অণ্ডকোষের বৃদ্ধি অনুভব করতেন ললিতা৷ ১৯৯৫ সালে বয়স যখন মাত্র সাত, তখন একদিন অণ্ডকোষকে টিউমার ভেবে অপারেশন করে বাদ দিয়ে দেন স্থানীয় চিকিৎসকরা৷ ২০১৪ সালে মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় বিষয়টি জানা যায়৷ এরপর থেকে চিরদিনের জন্য মহিলাদের অন্তর্বাস এবং পোশাক ত্যাগ করেন তিনি৷ ছোট করে কেটে নেন চুল৷

কিছুদিন পর নিয়মমাফিক পরীক্ষা দিয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন৷ কিন্তু সেখানে শুরু থেকেই দেখা দেয় সমস্যা৷ পুলিশ প্রশিক্ষণের সময় মহিলাদের চুলে বেণী করার নির্দেশ দেওয়া হতো৷ তখন ছোট চুলের জন্য সমস্যা হতো৷ নানা কুকথা শুনতে হতো৷ সেখানেই ছিল অন্য এক সমস্যা৷ অন্যান্য মহিলা কনস্টেবলদের মতো শৌচালয়ে ঢোকা নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকতো৷ মহিলারা তাঁকে পুরুষ বলে সন্দেহ করতো৷ ফলে, কেউই তাঁর কাছে ঘেঁষতো না৷ উল্টে বলা হতো, ‌মহিলাদের শৌচালয়ে তাঁর প্রবেশ নিষেধ৷‌ আবার পুরুষদের শৌচালয়ে কীভাবে ঢুকবেন তিনি?‌ তিনি তো মহিলা কনস্টেবল!

ঘরে-‌বাইরে যন্ত্রণা আর অপমান বুকে চেপে চাকরি করে যাচ্ছিলেন তিনি৷ মনে সাহস সঞ্চয় করে গতবছর সিদ্ধান্ত নেন অস্ত্রোপচার করিয়ে পুরোপুরি পুরুষ হয়ে উঠবেন৷ সেপ্টেম্বরে মহারাষ্ট্র পুলিশ বিভাগে নিজের অস্ত্রোপচারের জন্য ছুটির আবেদন করলেন৷ পত্রপাঠ আবেদন ফিরিয়ে দেয় পুলিশ বিভাগ৷ এমন একটা কারণে ছুটির আবেদনে ঢি-‌ঢি পড়ে যায় চারিদিকে৷ আবেদন নাকচ করার পাশাপাশি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরামর্শ দেয়, ‘‌উদ্ভট চিন্তা' বাস্তবায়িত করতে হলে কিছুদিনের জন্য নয়, বরং চিরকালের জন্য ছুটি নিতে পারেন ললিতা৷

এই ঘটনায় প্রথমটায় বেশ ভেঙে পড়েন হতদরিদ্র শ্রমিক পরিবারের ললিতা৷ কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে বেশি সময় নেননি৷ এক সময় অস্ত্রোপচার করানোর লড়াইয়ে নেমে পড়েন তিনি৷

এ বিষয়ে মতামত জানার জন্য ডয়চে ভেলে কথা বলেছে ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে৷ তিনি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা৷ বাংলার অধ্যাপক সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মানবী হয়ে উঠতে কঠিন লড়াই লড়তে হয়েছে তাঁকেও৷ ললিতকে তিনি চেনেন না৷ তবে বললেন, ‘‌‘আমাদের জন্মের জন্য আমরা তো কোনোভাবেই দায়ী নই৷ অবশ্যই সাধারণ মানুষের মানসিকতা বদলাচ্ছে৷ কিন্তু, লড়াইটা আমাদের লড়তে হয়৷ এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‌লড়াইটা অসম হয়৷ যে মানুষটা ভেতর থেকে ছিন্নভিন্ন, যাঁকে নিজের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে, তাঁর ক্ষেত্রে অন্য সবার সঙ্গে, চাকরিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হওয়া ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়৷ ললিতার ললিত হয়ে ওঠার জন্য আজ হয়ত ভালো লাগছে, কিন্তু, নিজের জীবন দি্যে বলতে পারি, এক সময় মনে হয়, চাকরি ছাড়বো, নাকি জীবন ছেড়ে দেবো!‌ তবে, শেষমেশ প্রমাণ হয়েছে ললিতার জীবন বৃথা নয়৷ আমিও আজ একটা ভালো জায়গায় এসেছি৷ সবটার পেছনে আছে অসম্ভব লড়াই৷ তবে, মিডিয়া সবসময় বড় ভূমিকা নেয়৷ আমার লড়াইয়ে সবসময় পাশে ছিল মিডিয়া৷''

‘সবটার পেছনে আছে অসম্ভব লড়াই আর লড়াইয়ে সবসময় পাশে ছিল মিডিয়া’‌

ললিতার প্রথম ধাপের সার্জারির জন্য এক মাসের লম্বা ছুটির প্রয়োজন ছিল৷ পুলিশ কর্তৃপক্ষ ছুটি দিতে নারাজ৷ নিজে থেকেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ললিতা৷ তাঁর দায়ের করা মামলা পৌঁছায় মুম্বই হাইকোর্ট পর্যন্ত৷ আদালতের খরচ সামলানো তাঁর পক্ষে অসাধ্য হয়ে ওঠে৷ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাশে এসে দাঁড়ায়৷ দীর্ঘ শুনানির সময় আদালত একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেয় রাজ্য সরকারকে৷ ওই বোর্ডে রাখা হয় একজন স্ত্রী-‌রোগ বিশেষজ্ঞ, একজন ইউরোলজিস্ট, একজন প্লাস্টিক সার্জেন, একজন রেডিওলজিস্ট, একজন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ, একজন সাধারণ চিকিৎসক এবং একজন মনোবিদকে৷ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দল বহু পরীক্ষার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ললিতার শরীরে পুরুষের জিন রয়েছে৷ তখনই তাঁকে লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেয় ওই চিকিৎসক দল৷ তবে চিকিৎসার সমস্ত খরচ সালভেকেই বহন করার কথা বলা হয়৷ আদালতের নির্দেশের পর চিকিৎসকদের ছাড়পত্র পেয়ে বেজায় খুশি সালভে৷ তারপর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ তাঁকে অস্ত্রোপচারের লিখিত অনুমতি দেন৷ সেইসঙ্গে তাঁর ছুটিও মঞ্জুর করা হয়৷

গত ২৫শে মে সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে ললিতার শরীরে৷ ললিতা এখন ললিত৷ তিনি আপাতত সুস্থ৷ তাঁর শরীরে যে অস্ত্রোপচার হয়েছে তার ডাক্তারি নাম, ‘‌সেক্স রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি'‌৷ আরো কয়েকটি অস্ত্রোপচার করানোর প্রয়োজন৷ দ্বিতীয় দফার অস্ত্রোপচার হবে ছ'‌মাস পর৷

অভিজ্ঞ প্লাস্টিক সার্জন রজত কাপুর অস্ত্রোপচার করে ললিতাকে ললিত করে তুলেছেন৷ আপাতত তাঁর পর্যবেক্ষণেই থাকবেন ললিত৷ কাজে যোগদানের আগে এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷

এই বিষয়টিতে স্থানীয় পুলিশ কর্তা জি শ্রীধর বলেছেন, ‘‌‘‌লিখিত ভাবে মহিলা কর্মীর পরিবর্তে পুরুষ কর্মী হিসেবেই সালভেকে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এরপর পুরুষ হিসেবেই কাজ করবেন তিনি৷ বদলে যাবে তাঁর সার্ভিসবুক৷'‌'‌ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতেই ঘরের মেয়ে ললিতার পরিবর্তে ঘরের ছেলে ললিতকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা৷ তাঁকে ঘিরে আনন্দে মেতেছেন পাড়াপড়শিরা৷ এমনকি তাঁর অপারেশনের সময় ব্রত পালন করেছেন প্রতিবেশী মহিলারা৷ সকলের স্নেহ ও আশীর্বাদে স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত ললিত৷ সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ জানাচ্ছেন সংবাদমাধ্যমকে৷ তাঁর কথায়, ‘‌‘‌সবার আগে সংবাদমাধ্যমের সমর্থন পেয়েছিলাম৷ সেইসঙ্গে আমার অনুভূতি ও যন্ত্রণা বুঝতে পেরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র খড়নবিশ, পুলিশ দপ্তর, আমার পরিবার এবং প্রায় সব্বাই৷ তাঁদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ৷'‌' আরও বলেছেন, ‘‌‘২৯ বছর ধরে ললিতা নামটা বয়ে বেড়িয়েছি, আর নয়৷ এবার সরকারিভাবে আমি ললিত৷'‌'

‌ ললিতা থেকে ললিত হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘‘‌এবার প্রাণ খুলে বাঁচবো'‌'‌                                      

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য