1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা ও সরকারের করণীয়

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৩ ডিসেম্বর ২০২২

কূটনীতিকদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জন্য স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকারকে আরও কৌশলী হতে বলেছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা৷

https://p.dw.com/p/4LNBx
বাংলাদেশ নিযুক্ত কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশ নিযুক্ত কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতছবি: CGS

একজন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব৷ মন্ত্রীরা যাই বলুন না কেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে যাওয়ার বিষয়টি সরকার আগে থেকেই জানতো৷ সেখানে যেন কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেটা আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল৷ সরকার বিষয়টি যেভাবে দেখভাল করেছে তা সঠিক হয়নি বলেই মনে করছেন কয়েকজন সাবেক কূটনীতিক৷ এতে বিভেদ বেড়েছে, গণতন্ত্রের কোন লাভ হয়নি৷

বাংলাদেশে ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত ‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলির শাহীনবাগের বাসায় গত ১৪ ডিসেম্বর গিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস৷ সেখানে বাইরে অবস্থান করছিলেন ‘মায়ের কান্না' নামের পৃথক একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা৷ ‘মায়ের কান্না’ হলো ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের নামে বিমানবাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য ‘গুমে’র ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সংগঠন৷ তুলির বাসায় ২৫ মিনিট অবস্থান করে বের হওয়ার পর অনেকটা ধস্তাধস্তির মধ্যে পড়েন মার্কিন দূত৷ এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন৷ দ্রুত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন৷

মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে তার ব্যাখা দিতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত সাইফুল ইসলাম সবুজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন কূটনীতিক যে দেশে থাকেন সেখানে তিনি যে কোন কাজ করতে পারেন৷ আপনার তার কাজ পছন্দ না হলে আপনি তাকে বের করে দিতে পারেন৷ আইনে তাকে সেই সুরক্ষা দিয়েছে যে, সে দিনে দুপুরে খুন করলেও আপনি তাকে কিছু করতে পারবেন না৷ বিদেশি কূটনীতিকরা যে দেশে যান তার নিজের দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও তার দেশের বৈদেশিক নীতি যেগুলো আছে সেটা দেখা তার দায়িত্ব৷ ট্রাম্প যাওয়ার পর বাইডেন প্রশাসনের কাছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ এখানে তো বিদেশি কূটনীতিকরা নিয়মিত কথা বলেই যাচ্ছেন৷ এই কথা বলা তো ভিয়েনা কনভেশন পারমিট করে না৷ কোনটা বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য আর কোনটা গ্রহণযোগ্য না সেটা দেখার অধিকার কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের আছে৷ কেউ বেশি করে ফেললে সরকার তাকে বের করে দিতে পারে৷ কিন্তু এখানে তো তেমন কিছু হয়নি৷ মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো মানবাধিকার দেখতে গেছেন৷ তার কাজ আপনার পছন্দ না হলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে ডাকতে পারেন৷ মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে ওইদিন সেখানে গেছেন সেটা তো সরকার জানত৷ তার সঙ্গে তো বাংলাদেশের সিকিউরিটি থাকে৷ সরকার তার যাওয়াটাকে পছন্দ করেনি৷ সরকারের উচিৎ ছিল, তার সঙ্গে কথা বলা৷ তার যাওয়াটাকে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে সেটা আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি৷’’

তার যাওয়াটাকে বাংলাদেশ সরকার যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে সেটা আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি: সাইফুল ইসলাম সবুজ

যে দিনটাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই বাসায় গেছেন, সেটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন৷ কেন তিনি এই দিনটাতেই সেখানে গেলেন? জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৪ ডিসেম্বর নিয়ে যে কথা হচ্ছে, সেটা আমরা বলতে পারি৷ কিন্তু সেটা তো উনার স্বাধীনতার প্রশ্ন৷ আমরা তো উনাকে বলতে পারি না উনি কোথায় যাবেন৷ তবে হ্যাঁ, উনি যদি সকালে বধ্যভূমিতে গিয়ে তারপর ওখানে যেতেন তাহলে হয়ত সেটা শোভন দেখাতো৷ তবে উনি কোথায় যাবেন বা যাবেন না সেই সিদ্ধান্ত তো আমরা দিতে পারি না৷’’ জনাব হোসেন বলেন, কোন কূটনীতিক অভিযোগ শুনতে যেতে পারেন কিনা সেটা বলা কঠিন৷ তবে নিষিদ্ধ নয় কোন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ বা তাদের বাসায় যেতে কূটনীতিকদের কোন বাধা নেই৷

কেন আমাদের বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে যেতে হয়? জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘এর দু'টো কারণ আছে৷ এক. এটা আমাদের পুরনো রোগ৷ আমরা দীর্ঘদিন থেকেই এটাতে অভ্যস্ত৷ আমাদের এখানে নির্বাচন যখন হয়েছেও তখনও কিন্তু পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি৷ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে সবসময়ই দুর্বল ছিল৷ অনেক সময় মানুষ যখন প্রতিকার পায় না, তখন খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো তাদের কাছে যায়৷ যেহেতু গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের ব্যাপারে তারা সোচ্চার, কাজেই অনেকে মনে করেন তাদের কাছে বললে সুরাহা হতে পারে৷ আর দুই. যখন সরকারের কাছ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায় না তখন অনেকেই তাদের কাছে যান৷ এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে৷ তবে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা একেবারেই কাঙ্খিত না৷’’

বধ্যভূমিতে না গিয়ে মার্কিন দূতের নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোনের বাসায় যাওয়ার সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷ ওই দিনই এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘‘আজ সকালে দেখলাম ২০১৩ সালে ‘গুম’ হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় গেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস৷ আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস৷  রাষ্ট্রদূত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গেলে বেশি খুশি হতাম৷ আমরা কিন্তু সিএনএনে দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে কত মানুষ গুম হয়, কত নারী ধর্ষিত হয়, কত মানুষ খুন হয়৷’’

আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘তিনি যে ওখানে গিয়েছেন তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জানা ছিল না৷ মার্কিন দূতকে জানিয়েছি আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের৷ মার্কিন দূত অধিকতর নিরাপত্তা চাইলে আমরা সে ব্যবস্থা করবে৷ ওই ঘটনায় তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছেন৷’’

ঘটনার পরদিন ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন দূতাবাসের এক টুইট বার্তায় বলা হয়, ‘‘মর্কিন দূত পিটার হাস ‘মায়ের ডাকে'র সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন তাদের কথা শোনার জন্য৷ বিশ্বে যারা গুমের  শিকার হয়েছেন তারা ও তাদের পরিবারের পাশে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রে রয়েছে মানবাধিকার৷ রাষ্ট্রদূত হাস মায়ের ডাক-এর সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন হচ্ছে মায়ের ডাক, সেখানে রাষ্ট্রদূত ওই পরিবারের সদস্যদের কথা শুনেছেন৷’’

একজন রাষ্ট্রদূত এভাবে অভিযোগ শুনতে কারও বাসায় যেতে পারেন কিনা? জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যেহেতু আমাদের রাজনীতিতে বিভাজন আছে৷ বিরোধী দলে যারা থাকেন তাদের একটা ধারণা বিদেশিদের কাছে যদি অভিযোগগুলো করা যায় তাহলে তাদের অবস্থানটা শক্ত হয়৷ বিভাজনের রাজনীতির কারণে বহু বছর ধরে এই ধারণাটা আছে৷ রাজনীতিতে যত বেশি বিভাজন থাকবে তত তাদেরও লাভ৷ কারণ এতে তাদের অর্থনৈতিকসহ যেসব সুবিধা বা জাতীয় স্বার্থ সেগুলো সহজেই তারা নিতে পারবে৷ কতখানি গণতন্ত্রের জন্য, কতখানি মানবাধিকারের জন্য সে প্রশ্ন থাকে৷ কারণ পৃথিবীর অনেক জায়গায় এমন আছে কিন্তু সেখানে তো সম্ভব নয়৷ একই জিনিস ভারতে বা চীনে করাতো সম্ভব না৷ বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতির কারণে একটা জায়গা তৈরি হয়৷ তবে এবার যেটা ঘটেছে তার মধ্যে অনেকগুলো সমস্যা রয়ে গেছে৷ যে তারিখে তিনি গেছেন ১৪ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাস অল্প যারা জানেন তারাও ভালো করে জানেন যে, ওই দিনটা বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস৷ ৭১ এর সঙ্গে অন্যতম সম্পর্কিত একটা দিন৷ এই দিনটাকে তিনি কেন বাছাই করে নিলেন সেটাও প্রশ্ন থাকবে৷ আবার মায়ের কান্না নামের সংগঠনের যারা সেখানে সেদিন গেলেন তারাও কেন ওইদিনই সেখানে গেলেন, পরদিনও যেতে পারতেন সেটাও একটা বিষয়৷ এতে বোঝা যাচ্ছে তার এই সফরে বিভাজন বাড়ল, কমল না৷ কূটনৈতিক মহল বিভাজন বাড়াবে কেন? তারা তো কমাতে চেষ্টা করবে৷ আমি বুঝি না, এটা গণতন্ত্রের জন্য কতটা লাভ হল? আমার প্রশ্ন এটা করে তিনি কী পেলেন? তাই আমি মনে করি, যারা গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত৷ সেই দেশের ইতিহাস আরও ভালো করে জানা দরকার৷ এই বিভাজনটা যত বাড়বে তাতে আমাদের দেশের ক্ষতি, তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ মূল কথা হল গণতন্ত্রের কোন লাভ হলো না৷ গণতন্ত্রের কথা বলতে হলে তাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার৷’’

যারা গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন তাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত: ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

ওই দিনটা বদলে অন্য কোন দিন মার্কিন দূত শাহীনবাগে গেলে ভালো হতো বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘উনি যে কারও বাসায় যেতে পারেন, এতে কোন বাধা নেই৷ উনাকেই পছন্দ করতে হবে, তিনি কার বাসায় যাবেন, আর কার বাসায় যাবেন না৷ উনার কোথায় যেতে নিষেধাজ্ঞা নেই৷ ঢাকার বাইরে গেলে নিরাপত্তার জন্য সরকারকে জানাতে হবে৷ ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জনগনের জন্য একটা হৃদয়বিদারক একটা দিন৷ ওই দিনটাতে কূটনীতিকদের যদি কোথায় যেতে হয় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের বাসায় যাওয়া বা বধ্যভূমিতে যাওয়াই উচিৎ৷ ওইখানে উনি যাওয়ার পর যে ঘটনাটি ঘটেছে তখন কিন্তু সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছে৷ রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সরকার সবসময় যথার্থ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে৷ আমার মনে হয়, ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের যে বিষয়টা সেটা তিনি সঠিকভাবে মাথায় রাখেননি৷’’

একটা গুমের বিচার তো এমনিতেই হওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সারা বিশ্বেই কূটনীতিকদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে কোন বাধা বিপত্তি ছাড়া৷ আমাদের রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনে থাকলে তাকেও দিতে হবে, আবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে থাকলে তাকেও দিতে হবে৷ প্রচলিত আইনের মধ্যে থেকে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন৷ আমি মনে করি, একটা অপরাধ হলে তো আইনি কাঠামো আছে৷ এখন বিচার হয় না বলে যে লোকজন ওইদিকে যায় কিনা সেটা আমি বলতে পারব না৷ শহরের মধ্যে কারও বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে বা কোন বন্ধুর বাসায় গেলে সেটা সরকারকে জানিয়ে যেতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই৷ তবে নিরাপত্তার ইস্যু থাকলে অবশ্যই সরকারকে বলতে হবে, সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে৷ আমি যখন ওয়াশিংটনে বা দিল্লিতে ছিলাম তখনও এইভাবেই দায়িত্ব পালন করেছি৷’’

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৮ সালের আগস্টে ঢাকার মোহাম্মদপুরে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছিল এক দল সশস্ত্র যুবক৷