রাজধানীতে নিম্নবিত্ত নারীদের আত্মনির্ভরশীলতার সংগ্রাম
একসময় তারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন৷ এখন ক্ষুদ্রব্যবসার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন৷ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার এমন কয়েকজন সংগ্রামী নারীর কথা থাকছে ছবিঘরে৷
হাত পাততে হয় না
ঢাকার আফতাবনগরে সড়কের ধারে বসে গরুর দুধ বিক্রি করেন সাত-আটজন নারী৷ তারা মেরাদিয়ার বাসিন্দা৷ খামার থেকে বোতলে করে গরুর দুধ নিয়ে আসেন৷ প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাস্তার পাশে বসেন৷ যানবাহনের আরোহী কিংবা পথচারীরা তাদের কাছ থেকে দুধ কিনে নিয়ে যান৷
রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ
ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন খালেদা৷ থাকেন ঢাকার সিপাহীবাগে৷ ১০ বছর বয়সে ঝিয়ের কাজ নেন এই অনাথ৷ লাঞ্চনা সইতে না পেরে একসময় পালিয়ে এক নারীর আশ্রয়ে থাকেন৷ শুরুতে কাপড়, চা ও চাদর বিক্রি করে লোকসানের মুখে পড়তে হয়৷ বিয়ে করার পর সন্তানকে রেখে স্বামী চলে যায়৷ একসন্তানকে নিয়ে তার জীবন সংগ্রামের অবলম্বন এখন এই রিকশা৷ সকালে বেরিয়ে রাত ১১টা পর্যন্ত ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন৷
গৃহকর্মী থেকে ‘পথের হোটেলের’ মালিক
স্বামী খুলনার রূপসায় ট্রেনে কাটা পড়ে এক পা হারিয়েছেন৷ গৃহকর্মীর কাজে করে সংসার চালাতেন আকলিমা বেগম৷ চার বছর হলো মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে ভাত-তরকারি বিক্রি করেন৷ সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকে তার এই দোকান৷ বাজার করেন নিজেই৷ রিকশা চালক, ভ্যানগাড়ি চালক ও নিম্ন-আয়ের মানুষেরা খেতে আসেন এখানে৷ দৈনিক তিনশ থেকে চারশ টাকা আয় হয় তার৷
অন্যকে খাইয়ে সংসার চালান নাজমা
উত্তর কমলাপুরে পাঁচ-ছয় বছর ধরে ভাত-তরকারি বিক্রি করেন নাজমা বেগমও৷ নিজেই বাজার ও রান্না করেন৷ হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষ এখানে খেতে আসেন৷ প্রতিদিন ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকার বিক্রি হলে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা লাভ হয় তার৷ বাসায় তাকে সহযোগিতা করেন স্বামী৷ একসময় তিনিও গৃহকর্মীর কাজ করতেন৷ তার আয়েই সংসার ও সন্তানের পড়াশোনা চলে৷
গ্রামে ফিরতে চান ফাতেমা
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের পাশে রুটি, গুড়, ডিম ভাজি ও সবজি বিক্রি করেন ফাতেমা বেগম৷ তাকে রুটির খামি করে দেন স্বামী৷ ফাতেমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা বিক্রি হইলে ৮০০-১০০০ টাকা লাভ হইতো৷ কিন্তু এহন জিনিসপত্রের দাম বাইড়া যাওয়ায় পেরেশানিতে আছি৷ তাই ব্যবসা ছাইড়া নওগাঁয় গ্রামে চইলা যামু কয়দিন পর৷’’
‘খিদা থাকলে সবই শিখতে হয়’
ওয়ারীর নবাব স্ট্রিটে চার-পাঁচ বছর ধরে ডাব বিক্রি করেন মাকসুদা বেগম৷ প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা-১১টা পর্যন্ত বিক্রি শেষে ঘরে ফিরে সংসারের কাজ করেন৷ তার স্বামীও ডাব বিক্রি করেন৷ তাদের আয়ে দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ পাঁচজনের সংসার চলে৷ ডাব কাটা শেখা প্রসঙ্গে মাকসুদা বলেন, ‘‘পেটে খিদা থাকলে সবই শিখতে হয়৷’’ দিনে ৫০ থেকে ৬০টি ডাব বিক্রি করলে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয় তার৷
‘খাইয়া লইয়া হমান’
নাছিমা আক্তার একসময় ছাপাখানায় কাজ করতেন৷ কিন্তু ঠিকঠাক মজুরি না পেয়ে নিজেই ক্ষুদ্র ব্যবসায় নেমেছেন৷ ওয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে রিকশা মেরামতের অস্থায়ী গ্যারেজ চালান তিনি৷ স্বামী রিকশা মেরামত করেন৷ এক মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে৷ আরেক মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে৷ ছেলের বয়স দেড় বছর৷ তবে গ্যারেজের আয় নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নন নাছিমা৷ তার কথায়, ‘‘খাইয়া লইয়া হমান৷’’
মরিয়ম বিবির চায়ের দোকান
গোপীবাগ খোকা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দুই মাস ধরে একটি চায়ের দোকান চালাচ্ছেন মরিয়ম বিবি৷ সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানদারি করেন তিনি৷ মাসে তিন হাজার টাকা দিতে হয় ভাড়া৷ প্রতিদিন লাভ হয় ২০০-৩০০ টাকা৷ স্বামী ভাঙারির ব্যবসা করেন৷ তাদের দুই ছেলে দুই মেয়ে৷ এক মেয়ে কলেজে পড়ে৷
জমানো টাকায় ব্যবসা করেন জমিরন
একসময় তিনি ইট ভাঙতেন৷ গৃহকর্মীর কাজও করেছেন৷ সেখান থেকে টাকা জমিয়ে পরে ব্যবসায় নামেন৷ ওয়ারী ফোল্ডার স্ট্রিটে আড়াই বছর ধরে ফ্লাক্সে চা বিক্রি করেন জামিরন৷ তার দোকানে রুটি, গুড়, পানও আছে৷ প্রতিদিন ৩০০ টাকার মতো আয় হয় তার৷ ১০ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি৷ দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন৷ ছেলে একটি কারখানায় কাজ করে৷
পিঠা বানিয়ে স্বাবলম্বী ফাতেমা
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে চিতই, তেলে ভাজাসহ নানান রকম পিঠা বিক্রি করেন ফাতেমা খাতুন৷ কিডনিতে সমস্যার কারণে গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে দেন৷ প্রতিদিন হাজার দেড়েক টাকার পিঠা বিক্রি করে ৪০০-৫০০ টাকা লাভ করেন৷ বড় ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজ করে৷ মেজ ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে আর ছোট ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে৷ আরেক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন৷
‘খাইয়া-পইড়া বাঁইচা আছি
ওয়ারীতে ভ্যানগাড়ির ওপর বসে চা-পান বিক্রি করেন বৃদ্ধা আমিনা বেগম৷ আগে একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করতেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘অসুস্থ হইয়া চাকরিটা আর করতে পারি নাই৷ এহন দোকানদারি কইরা খাইয়া-পইড়া বাঁইচা আছি৷ দিনে হাজার ১২০০ টাকা বিক্রি হইলে ২০০ থেকে ৩০০ ট্যাকা লাভ থাকে৷ তয় ভালাই আছি৷’’
শীতে ধোঁয়া ওঠা পিঠা
আফতাবনগর কমিউনিটি সেন্টারের পাশে মাসখানেক ধরে পিঠা বিক্রি করছেন আলো৷ প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকেন তিনি৷ দুই-আড়াই হাজার টাকা বিক্রি হলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়৷ প্রথম স্বামী মারা গেছেন৷ তাদের তিন ছেলে এক মেয়ে৷ সবার বিয়ে হয়ে গেছে৷ পরে আবার বিয়ে করেছেন আলো৷ দ্বিতীয় স্বামী থাকেন গ্রামে৷
সুঁই-সুতায় জীবনের বুনন
দর্জির কাজ করে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন অনেক নারী৷ শনির আখড়ার কদমতলীতে একটি কারখানায় চার-পাঁচ বছর ধরে পতাকা তৈরি করছেন শিরিন বেগম৷ বছরের নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে৷ এজন্য প্রতিদিন ৮০০ টাকা পর্যন্ত মেলে৷ তার স্বামী ট্যানারিতে কাজ করেন৷ তাদের দুই ছেলে৷
কাপড় বিক্রেতা আরজু
ঢাকার মতিঝিলে আইডিয়াল স্কুলের সামনে বিভিন্ন ধরনের পোশাক বিক্রি করছেন আরজু৷ তার বাসা কামরাঙ্গীরচরে৷ বিভিন্ন জায়গা থেকে কাপড় এনে গাছের নীচে চৌকিতে বসেন তিনি৷ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ক্রেতারা এগুলো কিনে নিয়ে যান৷ প্রতিদিন ১০০০ থেকে ৪০০০ টাকার বিক্রি হয়৷ স্বামীর সঙ্গে আরজুর বিচ্ছেদ হয়েছে৷ তাদের এক মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে৷ আরেক মেয়ের বয়স পাঁচ বছর৷
হাড়ভাঙা খাটুনি
খিলগাঁও রেললাইনের পাশে ১০-১২ বছর ধরে ইট-সুড়কি ভাঙেন শাহনাজ৷৷ একবস্তা ২০ টাকা করে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আসে তার হাতে৷ শাহনাজের স্বামী ভ্যানগাড়িচালক৷ তাদের এক ছেলে এক মেয়ে৷ মেরাদিয়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন তারা৷
শহরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী আরজাম্মা প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ঝাড়ু দেন৷ ওয়ারীতে জয়কালী মন্দিরের সামনে তাকে দেখা যাচ্ছে৷ তিনি বিয়ে করেননি৷ স্বামীবাগের তিন নম্বর তেলগু সিটি কলোনিতে তার বাসা৷