1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘আলু-পটলের ব্যবসাও ব্যবসা, বইয়ের ব্যবসাও ব্যবসা'

নোমান মোহাম্মদ
১৬ এপ্রিল ২০২১

এবারের মেলায় এমন কিছু বইয়ের কাটতি দেখা গেল যা অতীতে বেশি দেখা যায়নি। এ বিষয়ে ডয়েচে ভেলের মুখোমুখি ‘ভাষাচিত্র' প্রকাশনীর প্রকাশক এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার মনিরুল ইসলাম সোহেল।

https://p.dw.com/p/3s89K
ছবি: Mortuza Rashed/DW

ডয়চে ভেলে : করোনার প্রকোপের মধ্যে বিশেষ পরিস্থিতিতে এবারের বইমেলা হলো। কেমন হলো মেলা?

খন্দকার মনিরুল ইসলাম সোহেল : এবার ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা হয়নি, লন্ডন বইমেলা হয়নি, বিশ্বের বড় বড় দেশের বইমেলা হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় যারা অনেক বড় প্রতিষ্ঠান, তারা ভার্চুয়ালি বইমেলার আয়োজন করেছে। কারণ, আন্তর্জাতিক বইমেলাগুলোয় প্রকাশক থেকে প্রকাশকে কপিরাইট কেনাবেচা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্রটা ভিন্ন। এখানে বইমেলা হয় পাঠকের জন্য। সরাসরি পাঠক বই হাতে নিয়ে তা কেনেন। এ ধরনের বইমেলা ভার্চুয়ালি করা সম্ভব হয় না। তবে সব মিলিয়ে আমি বলবো, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্তটি একেবারে সঠিক ছিল না। শুধু আবেগের জায়গা থেকে তা করা হয়েছে।

অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের বইমেলার পার্থক্যের কথা আপনি উল্লেখ করলেন। এ আয়োজনের মাধ্যমে অল্প কিছু পাঠকের কাছে হলেও তো বই পৌঁছেছে। সে হিসেবে এ বইমেলাকে মন্দের ভালো বলা যায় না?

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনার কিছু পরিসংখ্যান নিতে হবে। সত্যিই কি এবারের বইমেলায় পাঠক গিয়েছে কিনা? এবং কত সংখ্যক পাঠক বইমেলায় গেলে বলবেন যে, হ্যাঁ, পাঠক বই কিনেছে?

সে পরিসংখ্যানটা যদি একটু জানান...

গত বছরের মেলায় বই প্রকাশের সংখ্যা পাঁচ হাজার অতিক্রম করেছিল। এ বছর তা সাতাশ'শ'র মতো; তিন হাজারের নীচে। মানে অর্ধেকেরও কম। যেসব প্রকাশক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বই প্রকাশ করেন, তাদের অনেক বই বইমেলার আগেই বেরিয়ে গেছে। কারণ, প্রকাশকদের মধ্যে শঙ্কা ছিল শেষ পর্যন্ত বইমেলাটি হবে কিনা। আর যেহেতু এখন বই বিক্রির জন্য অনেকগুলি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে, আগে প্রকাশিত বই পাঠকের হাতে আগেই পৌঁছে গেছে। এরপর যে সংখ্যক পাঠক বইমেলায় গেছেন, সে সংখ্যক পাঠকের জন্য বইমেলা আয়োজন একেবারেই কোনো সুস্থ চিন্তা না। কারণ, স্টল ভাড়া, স্টল বানানো, এক মাসের কর্মী নিয়োগ মিলিয়ে প্রকাশকদের যে খরচ, তাতে বইমেলায় বই বিক্রি করে সে খরচ উঠে এসেছে, এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। দু-একটি ব্যতিক্রম হতে পারে। অংশ নেয়া ৪১৩টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে হিসেব নিয়ে দেখেছি, বইমেলা থেকে সব মিলিয়ে ৩ কোটি টাকার মতো বই বিক্রি হয়েছে এবার।

রুচিবোধসম্পন্ন প্রকাশক হলে প্রমোশন ‘রকমারি'র মতো করবো না: খন্দকার মনিরুল ইসলাম সোহেল

গতবার?

গতবার আমরা নিজেদের মতো হিসাব করিনি। বাংলা একাডেমির বক্তব্য ছিল, ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। তবে আমাদের প্রকাশনী সংস্থা থেকে বারবার বলেছি, এ অংকটা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, বাংলা একাডেমি কয়েকটি স্টল থেকে সংখ্যা নিয়ে একটা গড় করে ঘোষণা দিয়ে দেয়। আমরা অনুমান করি, গতবার হয়তো ওই ঘোষণার ৫০ শতাংশ, মানে ৪০ কোটি টাকার মতো বই বিক্রি হয়েছে।

তাহলেও তো ৪০ কোটি থেকে এবার বই বিক্রি নেমে এসেছে ৩ কোটিতে। আপনার ‘ভাষাচিত্র' প্রকাশনী থেকে গত বছর এবং এ বছরের বইমেলায় বিক্রির পরিসংখ্যানটি কেমন?

এবার বই বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ টাকার কাছাকাছি। অন্যান্যবার ১৫-২০ লাখ টাকার মতো হতো।

বইমেলায় বই বিক্রি এত কমে যাওয়ার মূল কারণ কি করোনা পরিস্থিতি, নাকি বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যে বই বিক্রি হয়, এটিও বড় কারণ?

না, আমি সেটিকে বড় কারণ মনে করি না। সৃজনশীল কাজের পৃষ্ঠপোষক আসলে কারা? মধ্যবিত্ত শ্রেণি। গত এক বছরের টানা করোনা-বিপর্যয়ের কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পকেটে কি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস খাবার-ঔষধ-পোশাক কেনার পর সে টাকা আছে, যা দিয়ে তারা বই কিনবেন? বইমেলার জন্য অনেকের বাজেট থাকে পাঁচ হাজার, দশ হাজার টাকা। এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা একটি টাকার বইও কেনেননি। শুধু চিহ্নিত করে রেখেছেন, করোনা পরবর্তী সময়ে কিনবেন। আপনি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কথা যে বলেছেন, সেটি একটি কারণ হতে পারে। তবে বইমেলায় বিক্রি কম হওয়ার মূল কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির পকেটে টাকা নেই।

আরেকটি প্রসঙ্গে আসতে চাই। শুধু এবার না, গত কয়েক বছর ধরেই পাঠরুচির পরিবর্তনের ট্রেন্ড কি আপনারা বুঝতে পারছেন? কারণ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তো দেখছি, বেস্ট সেলারের তালিকায় ‘সৃজনশীল' বইয়ের তুলনায় স্পোকেন ইংলিশ, মোটিভেশনাল, মার্কেটিং, ধর্ম বিষয়ক বইয়ের প্রাধান্য।

এটি খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় যে, পাঠক কী বই কিনছে এখন। তবে এ পরিসংখ্যান বিস্মিত হবার মতো কিছু না। কারণ, পুরো পৃথিবীর দিকে তাকালেও দেখবেন, বেশিরভাগ মোটিভেশনাল বইয়ে লেখা থাকে ‘হান্ড্রেড মিলিয়ন কপি সোল্ড'। ওগুলোই বেস্ট সেলার। এটা তাই আমাদের জন্য অবাক হবার মতো বিষয় না। অবাক হবার মতো বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য দেশে বেস্ট সেলার সৃজনশীল লেখক আছেন, বেস্ট সেলার ঔপন্যাসিক আছেন, বেস্ট সেলার গল্প লেখক আছেন। মানে বিভিন্ন সেক্টরে বেস্ট সেলার আছেন। আমার মতে, একজন প্রকাশক বই ছাপেন না, বরং বই প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রকাশক একজন লেখককেও প্রকাশ করেন। অর্থাৎ, একটি বই ছাপার পাশাপাশি লেখকের ব্র্যান্ডিং করার জন্য, লেখককে পাঠকের কাছে নিয়ে যাবার জন্য প্রকাশকের আরো অনেক দায়িত্ব রয়েছে। বিদেশে এমন অনেক ধরনের প্রোগ্রাম আছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের সিনিয়র প্রকাশকদের দিকে তাকালে বুঝবেন, বাংলাদেশে পাঠক-বান্ধব বই প্রকাশের নজির একেবারেই নেই। আমি অগ্রজদের অবশ্যই দায়ী করবো। কারণ, বাংলাদেশে বই প্রকাশ হয় সাপ্লাই-কেন্দ্রিক। বড় বড় প্রকাশকরা বই প্রকাশ করেন না, বরং বই ছাপেন। যা খুশি তা ছাপেন। ঢাউস ঢাউস বই বের করেন। কারণ, সে বই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাবলিক লাইব্রেরি, এনজিও, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে বিক্রি করবেন; বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সাপ্লাই দেবেন। এজন্যই বাংলাদেশে পাঠক-বান্ধব কোনো প্রকাশনা তৈরি হয়নি। এটি একটি সংকট। আর যেটা বলছিলাম, ইসলামিক বই, মোটিভেশনাল বই, স্পোকেন ইংলিশের বইয়ের বিক্রি এমনিতেই বেশি। এবার ঝামেলা হয়েছে, ‘রকমারি' নামে প্রতিষ্ঠান ইদানিং অনলাইনে যে জনপ্রিয় হয়ে গেল, ওরা সকল ধরনের বই বিক্রির ক্যাটাগরি একসঙ্গে করে ফেলেছে, যে কারণে দেখা গেছে ইসলামিক, স্পোকেন ইংলিশ এসব পেরিয়ে একটা সাহিত্যের বই হয়ত ১৮ নম্বরে চলে গেছে। এটার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী ‘রকমারি'।

‘রকমারি' ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, তারা তো ব্যবসা-কেন্দ্রিক চিন্তাই করবে। কিন্তু পাঠকদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরিতে বাংলাদেশের প্রকাশকরা যে ব্যর্থ, তা আপনি স্বীকার করলেন। এখন যে সৃজনশীলতার সংকট, সেটি তাই অবধারিত ছিল বলে মনে করেন?

আমি আপনার সঙ্গে একমত। এবং সেজন্য একজন প্রকাশক হিসেবেও আমি প্রকাশকদেরই দায়ী করবো। আবার আপনি যে ‘রকমারি'র কথা বললেন, ওরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এখানে একটু দ্বিমত করি। অল্প দ্বিমত করার সুযোগ আছে। আমরা কিন্তু বলি, বই কোনো আলু-পটলের ব্যবসা না। এ ব্যবসায় একটু রুচিবোধের ব্যাপার আছে। ধরুন, আমার প্রকাশনা থেকে একটি বই বের করলাম, ‘লাউ চাষের পদ্ধতি' এবং তা এক লক্ষ কপি বিক্রি হলো। আমি যদি রুচিবোধসম্পন্ন প্রকাশক হই, তাহলে এই বইটির প্রমোশন অবশ্যই ‘রকমারি'র মতো করবো না। বলবো না, এটি বেস্ট সেলার বুক। সেভাবে ব্র্যান্ডিং বা প্রমোশন করবো না। কারণ, এর সঙ্গে রুচিবোধের ব্যাপার আছে। রুচি তো আর যুদ্ধ করার ব্যাপার না। আপনি আপনার রুচিমতো করবেন, আমি আমার রুচিমতো করবো। ‘রকমারি'র কাছে আলু-পটলের ব্যবসাও ব্যবসা, বইয়ের ব্যবসাও ব্যবসা। ওরা যা খুশি তাই করবে। তাদের ওই রুচির সঙ্গে আমি একমত না। কিন্তু ইদানিং অনেক পাঠকও সেটার সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন; কোনো কোনো লেখকও সুর মেলাচ্ছেন। আর ওই যে আপনি প্রশ্ন করেছিলেন, এমনটা হওয়া অবধারিত ছিল কিনা, প্রকাশকদের ব্যর্থতা তো আমি নিজেই স্বীকার করেছি। প্রকাশক ঢাউস একটা বই ছেপে মন্ত্রণালয়ে সাপ্লাই দিয়েই নিজের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন। এটা হচ্ছে বলেই বাংলাদেশে পাঠক শ্রেণির মধ্যে এত রকম অসংগতি তৈরি হয়েছে। এবং ‘রকমারি' সর্বশেষ পেরেকটা মেরে দিয়েছে সব রকমের বই জেনারেলাইজ করে ফেলার মাধ্যমে। অথচ সেলিনা হোসেনের বই ৩০০ কপি বিক্রি হলে আমার কাছে সেটির গুরুত্ব বেশি, স্পোকেন ইংলিশের বই ১ লক্ষ কপি বিক্রি হলেও।

এই সৃজনশীলতার হাহাকারে মূল সংকট কোনটি?

সৃজনশীল লেখকের অভাব? সৃজনশীল লেখার পাঠকের অভাব? অথবা সৃজনশীল লেখককে প্রমোট করার মতো প্রকাশকের অভাব?

সৃজনশীল উদ্যোগের অভাব। সৃজনশীল লেখকের অভাব নেই, প্রকাশকের অভাব নেই, প্ল্যাটফর্মের অভাব নেই। মূল সংকট উদ্যোগের অভাব। আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় একটি উদ্যোগ আছে, গ্রন্থনীতি আছে। এর সঙ্গে তো কিছু প্রতিষ্ঠান জড়িত। পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ কী? তাদের জন্মই হয়েছে সৃজনশীল চর্চাকে সারা বছর পরিচর্যা করার জন্য। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আমাদের প্রকাশকগণ। ‘পড়ুয়া সমাজ' তৈরির জন্য তারা সবাই কী কাজ করেছেন? যদি সে উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে সমগ্র বাংলাদেশে সৃজনশীল পাঠক কেন তৈরি হবেন না? সৃজনশীল লেখক কেন তৈরি হবেন না? আমি তো ‘ভাষাচিত্র' থেকে এখন পর্যন্ত ১০০-র বেশি নতুন লেখকের বই প্রকাশ করেছি; প্রমোট করেছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জনপ্রিয়ও হয়েছেন। বাংলাদেশের কোন বড় প্রকাশক নতুন লেখকের বই প্রকাশ করেছেন? আমাদের বড় প্রকাশকরা শুধু জনপ্রিয় লেখকের পেছনে ছোটেন, ব্যবসা করতে চান। নতুন একজন প্রকাশক নতুন একজন লেখককে ওঠায়, বড় বড় প্রকাশকরা সে লেখককে ছিনতাই করেন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যদি নতুন নতুন লেখক সৃষ্টি করে, তাদের যদি পাঠকের কাছে নিয়ে যায়, তাহলে অবশ্যই বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।