1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যৌনপেশা আইনি হলেও সম্মান মিলবে তো?

রোশনি চক্রবর্তী
২৮ মে ২০২২

যৌনপেশা একটি পেশা৷ স্বেচ্ছায় এই পেশায় যারা এসেছেন, তাদের কাজে বারবার পুলিশি হস্তক্ষেপ আর চলবে না৷ অকারণে ফৌজদারি আইন প্রয়োগ? উঁহু, সেটাও একেবারে চলবে না৷

https://p.dw.com/p/4Bz4g
Indien Sexarbeiterinnen leiden während der COVID19-Pandemie unter Schulden
ছবি: DW

কারো মা পেশায় যৌনকর্মী বলে, সেই সন্তানকে মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া যাবে না আর কখনো৷ যৌনহেনস্থার অভিযোগ আনলে, পদক্ষেপ করতে হবে দ্রুত৷ এসব কথা শুনে সমাজের নীতিপুলিশরা চমকে উঠবেন ঠিকই৷ কিন্তু ঠিক এমনটাই রায় দিয়েছে ভারতের শীর্ষ আদালত৷

‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে জাতের কী ক্ষতি হয়’

লালন ফকির, কত শত বছর আগে লিখেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পতিতা' কবিতায় লিখেছেন, ‘‘আমি কি তোমার গুপ্ত অস্ত্র?/হৃদয় বলিয়া কিছু কি নেই?/ছেড়েছি ধরম, তা বলে ধরম/ছেড়েছে কি মোরে একেবারেই৷''

কিন্তু এ এক অদ্ভুত পৃথিবী যেখানে আপনি ‘রাজকাহিনী', ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' কিংবা ‘গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি' দেখে হয়ত দুই ফোঁটা চোখের জল ফেললেন৷ পরমুহূর্তেই সিঙ্গল মাদার কোনো নারীকে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে কফি খেতে দেখলেও ‘পতিতা', ‘রক্ষিতা' ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেন না৷ কিন্তু এই শব্দ কি আদৌ গালিগালাজের অংশ?

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এই রায় যুগান্তকারী৷ বিচারপতি এল নাগেশ্বর রায়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চের এই রায়ে বলা হয়েছে যৌনপেশা একটি পেশা৷ যৌনকর্মীরা সম্মান এবং আইনের কবচ পেতে পারেন৷ এ ছাড়াও সংবাদমাধ্যমে কোনোভাবেই যৌনকর্মীর পরিচয়প্রকাশ করা যাবে না৷ যৌনপল্লি চালানো আইনের চোখে বেআইনি৷ কিন্তু কেউ যদি নিজে থেকে এই কাজ করতে চান, তিনি যদি সাবালিকা হন, তবে কোনোভাবেই তাকে আইনের আওতায় আনা যাবে না৷

এই রায়ের পরই একাধিক প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে৷ সামাজিক মাধ্যমে তথাকথিত ‘খোলামেলা পোশাক' পরে কোনো নারী একটি ছবি পোস্ট করেছেন৷ ধরে নিলাম, তিনি কোনো সাধারণ মানুষ কিংবা কোনো তারকা৷ সবার প্রথমেই তার দিকে আঙুল তোলা হবে, একটি বিশেষ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে৷ কোনো নারী একাধিকবার বিবাহবিচ্ছেদ হল৷ তার ক্ষেত্রেও বিষয়টা ঘুরেফিরে সেই একই দাঁড়ায় কখনো ৷ ‘আরে ও তো বহুগামিনী' ইত্যাদি৷

বাংলা সাহিত্যে কোনো পতিতার লেখা প্রথম আত্মজীবনী ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’৷ সেখানে মানদা দেবী তো প্রায় ১০০ বছর আগে লিখেছেন ‘‘...আমার মত পাপরতা, পতিতা নারীর পদতলে যে সকল পুরুষ তাহাদের মান, মর্যাদা, অর্থসম্পত্তি, দেহমন বিক্রয় করেছে... তাদের সমাজ মাথায় তুলে রেখেছে, তারা কবি ও সাহিত্যিক বলিয়া প্রশংসিত, রাজনীতিক ও দেশসেবক বলিয়া বিখ্যাত, ধনী ও প্রতিপত্তিশালী বলিয়া সম্মানিত৷’’

যৌনকর্ম স্বীকৃতি পাওয়া উচিত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে সারা পৃথিবীতে৷ নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ডেনমার্ক, ফ্রান্সেও যৌনপেশার বৈধ স্বীকৃতি রয়েছে৷ ইউরোপের একাধিক দেশে পরিস্থিতিটা অনেকটা এমন৷ যৌনকর্মীরা রীতিমতো কর দেন জার্মানিতে৷ তাদের জন্য বিশেষ ভাতাও রয়েছে৷ যৌনকর্মীদের জন্য রয়েছে বিশেষ স্বাস্থ্য বিমা৷

DW Bengali Korrespndentin - Roshni Kuhu Chakraborty
রোশনি কুহু চক্রবর্তী, সাংবাদিক, ডয়চে ভেলে৷ছবি: Roshni Kuhu Chakraborty/DW

যৌনকর্মী হিসেবে পরিশ্রমের স্বীকৃতি চেয়েছেন অনেকেই৷ কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে উচ্ছ্বসিত দুর্বার৷ যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজে যুক্ত দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি দীর্ঘসময় ধরে এ নিয়ে আন্দোলনও সংগঠিত করেছে পশ্চিমবঙ্গে, সারা ভারতেও৷ এশিয়ার বৃহত্তম যৌনপল্লি, কলকাতার শোভাবাজারের যৌনপল্লিতে একটা দুর্গাপুজো করার জন্যও হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল তাদের৷ কারণ পাড়ার পুজোমণ্ডপেও প্রবেশের অধিকার ছিল না যৌনকর্মীদের৷ আদালতে গিয়ে সেই অধিকার আদায় করেছিলেন তারা৷

এই কমিটির তরফে মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ তো ঐতিহাসিক রায়৷ দুর্বার এ কথাই বলে এসেছে এতদিন৷ দীর্ঘদিন যৌনকর্মীদের জন্য এই লড়াই চলছে৷ ২৭ জুলাই কেন্দ্র কী বলে তার অপেক্ষা করছি৷ পেশার স্বীকৃতি চেয়ে আন্দোলন, তা আজ সার্থক৷ সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় এ কথা ভেবেছেন৷ এমন তো হয়, আচমকা কোনো রাতে পুলিশ চলে এসেছে৷ কখনো দুষ্কৃতীও হানা দিয়েছে৷ যৌনকর্মীদের নানাভাবে হেনস্থা করতে চেয়েছে৷ এ জিনিস বন্ধ হোক, এমনটাই চেয়েছি আমরা৷ আমরা আশাবাদী সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে সম্মতি দেবে কেন্দ্র এবং তা আইন হবে৷ পরবর্তী শুনানি ২৭ জুলাই৷ তারই অপেক্ষা করছি৷

এশিয়া থেকে এবার একটু ইউরোপের দিকে ফিরি৷ মাস দুয়েক আগে আমস্টারডামের রেডলাইট এরিয়ায় ‘উইন্ডো ব্রথেল'- এ গিয়েছিলাম৷ একটা গির্জা, পাশেই বাচ্চাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ আঁধার নামতেই দেখা যায়, কাচের দরজার মধ্যে সারি সারি ম্যানিকুইন সাজানো যেন৷ যৌনকর্মীরা খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছেন৷ প্রাচীন বাড়িঘরের মাঝে সেই কাচের দরজা৷ সেখানে লালবাতি জ্বলে৷ অর্থ রোজগারের নিরিখে নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে বড় জায়গা বললে ভুল হবে৷ দুই নারী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন,সন্তানের স্কুলের খরচ, ‘সামার হলিডে' সবটাই এখন সহজলভ্য৷ আর রেডলাইট এরিয়া? এ তো জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র৷ সবাই আসে৷ ঘুরেফিরে দেখে, কোনো সমস্যা নেই৷ রীতিমতো সুরক্ষিত যৌনকর্মীরা৷

পাওলা (নাম পরিবর্তিত) স্পষ্ট বললেন, ‘‘এটা আমার কাজ৷ আমার নামও নথিভুক্ত করা আছে৷ আর পাঁচটা কাজ যেমন৷ তা ছাড়া এখানে পুলিশি টহলদারি আছে৷ নজরদারি ক্যামেরা আছে৷ আপনি বেশিক্ষণ কথা বললে আমার মুশকিল৷ খদ্দের আসবে এবার৷ এটা এখানকার সবথেকে অভিজাত এলাকা ম্যাডাম৷’’

বুঝেছিলাম, পেশাদার একজন মানুষ নিজের সময় নষ্ট করতে আর রাজি নন৷ বেশ কয়েকজন পর্যটক ছিলেন সেখানে৷ রাস্তা ধরে খানিকটা এগোতেই দেখা পেয়েছিলাম, লিথুয়ানিয়ার কারোলিনার৷ এই পেশা বেছে নিলেন কেন প্রশ্ন করতেই বলেছিলেন, ‘‘আগে আর্থিক টানাটানি ছিল৷ কয়েক বছর খুব আনন্দে আছি৷ প্রচুর বেড়াতে যাই৷ শিফটে কাজ করি৷ জোর করে কোনো কাজ করাতে কেউ পারবে না৷ অফিস আওয়ার্স মেইনটেন করি বলতে পারেন৷ বয়ফ্রেন্ড জানে আমি কী কাজ করি৷ এটা তো বৈধ৷ সমস্যা কীসের৷ আমার মেয়ে এই কাজে আসতে চাইলে আসবে৷ এখন সবে স্কুলে যাচ্ছে৷’’

ওদের সঙ্গে কথা বলে মনে পড়ে গেল, অন্য একটা ছবি৷

যৌনকর্মীদের সন্তানের মা হাজেরার গল্প

করোনা কালের অনেক আগে কটাক্ষের কারণে ভারতের একাধিক স্কুল থেকে ‘ড্রপ আউট'-এর খাতায় নাম লিখিয়েছে যৌনকর্মীর সন্তানেরা৷ সুশীল সমাজ বার বার যৌনকর্মীদের অধিকারের কথা বলেছে৷ কিন্তু আসল ছবিটা ওই উত্তম কুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘নিশিপদ্ম' চলচ্চিত্রের মতো৷ সেই ছবির এক চরিত্র যেমন বলেই ফেলেছিলেন তার ছোটবেলার পাড়ার বোন সাবিত্রীকে৷ ‘ভদ্রলোকের পাড়ায় এমন কেন!'

যৌনকর্মী এবং ট্রান্সজেন্ডার এক যৌনকর্মীকে নিয়ে গবেষণামূলক শর্ট ফিল্ম বানিয়েছিলেন পরিচালক সুদীপ্ত কুণ্ডু৷ একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মান পায় সেই ছবি৷ ইসলাম সম্প্রদায়ের এক ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মী যিনি নিজেকে নারী বলে ভাবেন, ‘লাডলি'-তে সেই সাকিনার কথা তুলে ধরেছিলেন সুদীপ্ত৷সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে তিনি কী ভাবছেন এই প্রশ্নের উত্তরে সুদীপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মানসিকতার বদল দরকার৷ খাতায়-কলমে পরিবর্তনের পাশাপাশি ভাবনার পরিবর্তন জরুরি, সেটা হয়তো আসতে সময় লাগবে৷ এই মুভমেন্ট আসলে কমিউনিটিকেন্দ্রিক এখনও৷ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো জরুরি৷ তাই এই রায়টা সত্যি ঐতিহাসিক৷’’

ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মী সাকিনার মনে অবশ্য খুব একটা প্রভাব ফেলেনি সুপ্রিম কোর্টের এই রায়৷ বিহারের বেগুসরাইয়ের প্রত্যন্ত গ্রামের এই যৌনকর্মী দিল্লিতে থাকেন মূলত৷ বিশ্বাস করেন ভালবাসায়৷ প্রেমিকও রয়েছে তার৷ সাকিনার কথায়, ‘‘‘সবটাই তো কাগজেকলমে৷ কেউ কি আর সম্মান দেবে আদৌ?’’

আর আমারও সবথেকে বড় চিন্তাটা ঠিক এই জায়গাতেই৷ তথাকথিত সামাজিক বাবুবিবিরা এই রায় হজম করতে পারবেন তো? কী বলবে কেন্দ্র? আদৌ আইন হবে?

সময়ের ঘড়িটা একটু যদি পিছিয়ে নেয়া যায়৷ তাহলে আমরা কী দেখেছি? ১২৮০ বঙ্গাব্দের ১৫ মাঘ সুলভ সমাচার পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘‘সন্তান কামনা করিয়া লোকে কার্ত্তিক পূজা করে এবং বিদ্যালাভের জন্য সরস্বতী পূজা করে৷ বেশ্যাদের পক্ষে এ প্রকার কামনা নিতান্ত অনধিকার চর্চ্চা৷''

পাশাপাশি, কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নকশায় লিখেছেন, ‘আজব শহর কলকেতায় ‘খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা'৷ জগদীশ গুপ্তের ‘লঘু গুরু' উপন্যাস কিংবা শরৎচন্দ্রের কলমে রাজলক্ষ্মী হিসেবে তাদের ছবি ধরা পড়েছে৷ সে সব উপন্যাস কিংবা নটী বিনোদিনীর লেখা ‘আমার কথা' অলস দুপুরে ভাবনার খোরাক জোগালেও  একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে৷ কেন্দ্র আইনি স্বীকৃতি যদি দিয়েও দেয়, তারপরেও কি সামাজিক অবস্থানে আদৌ বদল ঘটবে?

তবুও এই রায় ঐতিহাসিক৷ এই রায় যুগান্তকারী৷ গণতন্ত্রের প্রতি এখনও আস্থা রাখার জন্য একচিলতে আশার আলো সুপ্রিম কোর্টের এই রায়৷ এবার হয়তো যৌনকর্মী মানেই তাঁকে যৌন হেনস্থা করা যায়, এ জাতীয় পুরুষতান্ত্রিক বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাবে সমাজ৷যেখানে ‘দেহোপজীবিনী', ‘সেক্স ওয়ার্কার’ শুধুমাত্র একটি পেশা৷ কোনো আপত্তিকর শব্দ নয়৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য